অস্ট্রেলিয়া দিবসের দিন সারা দেশে বিভিন্ন স্থানে চার’শটি নাগরিকত্ব প্রদান উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক হবার জন্য ১৫০টি জাতিরাষ্ট্রের ১৬ হাজার জন মানুষ এই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। তেমনি একটি অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়েছে ক্যানবেরায়। ক্যানবেরার বার্লি গ্রিফিন হ্রদের তীরে ঐদিন ২৯ জন নতুন অস্ট্রেলীয় নাগরিককে বরণ করে নেওয়া হয়।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন। তিনি নতুন নাগরিকদের বরণ করে স্বাগত জানিয়ে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে অস্ট্রেলিয়া বন্যা, খরা, অতিমারী সহ বিভিন্ন সংকট পেরিয়ে এসেছে। এই সংকটকালে দেশের সবার ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের জন্য তিনি দেশবাসীকে ধন্যবাদ জানান।সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ থেকে বেঁচে আসা একটি আরমেনিয়ান পরিবার এবার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। পরিবারের বধু ,দুই সন্তানের জননী নায়িরি ইনজেজিকিয়ান অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব পাওয়ার অভিব্যক্তি প্রকাশ করে বলেন,
Prime Minister Scott Morrison poses for photo with a new citizen family during the National Australia Day Flag Raising and Citizenship Ceremony in Canberra. Source: AAP Image/Mick Tsikas
আমি অস্ট্রেলিয়ার সবার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই যারা আমাদেরকে এদেশে স্বাগত জানিয়েছেন এবং এই সুন্দর দেশটিকে আপন করে ভাবাতে সাহায্য করেছেন। আমরা এখানে নিরাপদে বাঁচার সুযোগ পেয়েছি। সুযোগ পেয়েছি পড়ালেখা করার, কাজ করার এমনকি প্যারাম্যাটায় প্রথম বাড়ী কেনার সুযোগও পেয়েছি। আমরা নিশ্চয় এই বিস্ময়কর দেশকে প্রতিদান দেবার সুযোগও পাবো।
নিজের শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদানের সময়ে প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন দেশের ঐতিহ্যগত স্বত্বাধিকারী অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান এবং আদিবাসী অধিকারের স্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন।
এই দিনটিতে সিডনী হার্বারের কূলে, অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় সংগীত ইংরেজী ও আদিবাসী ইওরা জাতির ভাষা— এই দুই ভাষাতেই গাওয়া হয়। ইওরা ভাষায় অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় সংগীত শুনতে উপরের অডিও প্লেয়ারে ক্লিক করুন।
READ MORE
অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের ইতিকথা
নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যের প্রিমিয়ার ডমিনিক পেরোটে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীর ইতিহাস স্বীকৃতি দেবার পাশাপাশি আরও বলেন, তিনি তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং কল্যানের জন্য সরকার ঘোষিত “ক্লোজ দ্য গ্যাপ” শীর্ষক কর্মসূচীর অগ্রগতি দেখতে চান।, তিনি বলেন,
“আমরা পৃথিবীর প্রত্যেক কোনা থেকে আসা মানুষের ঐক্যবদ্ধ একটি জাতি। এই ঐক্যই আমাদের শক্তি। নতুন প্রজন্ম এই ঐক্যের সন্নিকটে। কিন্তু এই ঐক্য সংহত করতে হলে আমাদের অতীতকে স্বীকার করতে হবে। আমাদের এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, যে আজকের দিনটি একাধারে আদিবাসীদের অপূরণীয় ক্ষতি এবং গভীর ক্ষতের দিন। আমাদের তাদের সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা জানাতে হবে, যে সংস্কৃতি আজো বহমান।”
READ MORE
নতুন এসবিএস রেডিও অ্যাপ ডাউনলোড করুন
অন্যদিকে ক্যানবেরা শহরের যেখানে নাগরিকত্ব প্রদানের অনুষ্ঠান হচ্ছিল, তার অদূরে,পার্লামেন্ট হাউজের সামনে আরেকটি অনুষ্ঠান হচ্ছিল। নাগরিকত্বের মাইলফলক নয়, ইতিহাসের অন্য এক মাইলফলক রচিত হচ্ছিল সেখানে।
আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবীতে আদিবাসীর দূতাবাস তাঁবু গড়ার ৫০ বর্ষপূর্তি স্মরণ করা হচ্ছিল সেখানে। পার্লামেন্টে অবস্থানরত নেতৃবৃন্দের উদ্দেশ্যে তারা বিভিন্ন দাবী নিয়ে সম্মিলিত হয়েছিলেন।
সেই জমায়েতের অন্যতম মাইকেল এন্ডারসন এনআই টিভির উদ্দেশ্যে বলেন, তিনি “গুরিনজি ওয়াক অফ” আন্দোলন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে সেই জমায়েতে সামিল হয়েছেন। নর্দার্ন টেরিটোরির এই আন্দোলন ছিল নয় বছর ব্যাপী একটি শ্রমিক ধর্মঘট যা ১৯৬৬ সাল থেকে শুরু হয়েছিল আর আদিবাসীর ভূমি অধিকার ছিনিয়ে এনেছিল।তিনি মনে করেন দীর্ঘ আদিবাসী আন্দোলন সরকারের প্রতিশ্রুত পরিষেবার সীমিত যোগানে পর্যবসিত হয়েছে। আদিবাসীদের দাবীনামা সরকার আর আবাসন কোম্পানীর কাছে উপেক্ষিত হচ্ছে।
Source: AAP Image/Daniel Pockett
অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা প্রতিবছর দিনটিকে সার্ভাইভ্যাল ডে এবং ইনভ্যাজন ডে হিসাবে পালন করে থাকেন। এই দিনটিকে তারা স্মরণ করেন শোকের দিন হিসাবে, উপনিবেশিক দখলদারের কাছে জন্মভূমি হারানোর দিন হিসাবে। প্রতিবছরের মত এবছরও অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন শহরে ২৬ জানুয়ারি “অস্ট্রেলিয়া দিবস” পালনের বিপক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী পালিত হয়েছে।
১৭৮৮ সালের এই দিনটিতে ব্রিটিশ অভিযাত্রী দল সিডনী কোভে প্রথম পৌঁছায় এবং এই দেশকে ব্রিটিশ উপনিবেশ হিসাবে ঘোষণা করে।
উপনিবেশ গড়ে তোলার পর্বে, ১৭৮৮ থেকে ১৯৩০ সাল সময়কালে বিপুল আদিবাসীরা অর্থাৎ এদেশের এবোরিজিনাল এন্ড টরেস স্ট্রেট আইল্যান্ডাররা গণহত্যায় মারা যান। ব্রিটিশরা আসার আগে এদেশে প্রায় সাত লক্ষ পঞ্চাশ হাজার আদিবাসীর বসবাস ছিল। ১৭৮৮ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে তাদের জনসংখ্যার প্রায় ৯০% নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
নিউ ক্যাসল ইউনিভার্সিটির গবেষকরা অস্ট্রেলিয়াজুড়ে ৩৫০ থেকে ৪০০ টি ম্যাসাকার সাইট বধ্যভূমি খুঁজে পেয়েছেন। আদিবাসীরা অনেক প্রজন্ম ধরেই সবকিছু হারানোর মানসিক আঘাত বয়ে বেড়াচ্ছেন, যাকে ইন্টারজেনারেশনাল ট্রমা বলা হয়ে থাকে। সারা বিশ্বে এদেশের আদিবাসীরাই সবচেয়ে কারাবন্দী জনগোষ্ঠী। এক অবর্ণনীয় আঘাত নিয়ে তারা বন্দী হয়ে আছেন ঔপনিবেশিক কারাগারে।
সিডনীতে অস্ট্রেলিয়া ডে বিরোধী বিক্ষোভে সামিল পলা সিলভা জানান, ছয় বছর পূর্বে পুলিশী হেফাজতে তাঁর আংকেল ডেভিড ডুংগে জুনিয়রের মৃত্যু হয়েছিল। সিসিটিভি ফুটেজে পুলিশী নির্যাতনের ভিডিও দেখা গেছে। পলা ফ্রান্সিস সিলভার মত হাজারো আদিবাসীর কাছে এই দিনটি শোকের দিন।
১৮৯০ সালে অস্ট্রেলিয়ার সংবিধান রচনাকালে আদিবাসীদের বাদ দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯৬৭ সালের রেফারেন্ডাম অনুযায়ী সংবিধান সংশোধন করা হয়। সংসদে ৯০.৭৭ ভাগ হ্যাঁ ভোট নিয়ে তাদের যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ফলশ্রুতিতে আদিবাসীরা আদমশুমারীতে গণ্য হবার যোগ্যতা লাভ করেন; পাশাপাশি তাদের কল্যানের জন্য ফেডারেল তহবিল বরাদ্দ করা হয়। তথাপি আজও অনেক বিষয় অমিমাংসিত রয়ে গেছে। আদিবাসীরা আজও বিভিন্ন অধিকার ও সাংবিধানিক স্বীকৃতির জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন।
পুরো প্রতিবেদনটি শুনতে উপরের অডিও-প্লেয়ারটিতে ক্লিক করুন।
এসবিএস বাংলার অনুষ্ঠান শুনুন রেডিওতে, এসবিএস বাংলা রেডিও অ্যাপ-এ এবং আমাদের ওয়েবসাইটে, প্রতি সোম ও শনিবার সন্ধ্যা ৬ টা থেকে ৭ টা পর্যন্ত। রেডিও অনুষ্ঠান পরেও শুনতে পারবেন, ভিজিট করুন: