স্টোলেন জেনারেশনস: অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘটনার সাক্ষী যারা

এবরোজিনাল কমিউনিটির কাছে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কেভিন রাডের জাতীয়ভাবে ক্ষমা প্রার্থনার ১৩ বছর হতে চলল। তবে স্টোলেন জেনারেশনস যুগের সদস্যরা তাদের বিষাদময় অতীত এখনো ভুলতে পারেননি। পরিবার এবং কমিউনিটি থেকে বিচ্ছিন্নতা এবং মানসিক নির্যাতনের ট্রমা এখনো তাদের প্রভাবিত করে।

Stolen Generations survivors

A Stolen Generations members listen to Prime Minister Kevin Rudd deliver the Apology in 2008 Source: AAP

গুরুত্বপূর্ণ দিক

  • অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘটনাগুলোর অন্যতম হলো হাজার হাজার ইন্ডিজিনাস শিশুদের তাদের পরিবার থেকে জোর করে সরিয়ে দেওয়া। 
  • যেসময়ে স্টোলেন জেনারেশনের বেশিরভাগ শিশুদের জোর করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে তার ব্যাপ্তিকাল হচ্ছে ১৮৬৯ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত।
  • অস্ট্রেলিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন ১৯৯৭ সালের এপ্রিলে ইন্ডিজিনাস এবং টরে' স্ট্রেইট দ্বীপপুঞ্জের শিশুদের পৃথকীকরণের বিষয়ে 'Bringing them Home' নামে একটি জাতীয় তদন্তের প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
'স্টোলেন জেনারেশনস’  কি? 

অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘটনাগুলোর অন্যতম হলো হাজার হাজার ইন্ডিজিনাস শিশুদের তাদের পরিবার থেকে জোর করে সরিয়ে দেওয়া। যে প্রজন্মের শিশুরা এই ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত তাদেরকে বলা হয়ে থাকে স্টোলেন জেনারেশনস। 

এই স্টোলেন জেনারেশনস নীতিমালাগুলো এবং ইন্ডিজিনাস সমাজে তার প্রভাব এবং পরবর্তীতে ক্ষমা প্রার্থনা, দুঃখজনক অতীতের জন্য ক্ষতিগ্রস্তদের মানসিক নিরাময় ও ক্ষতিপূরণের বিষয়ে এই প্রতিবেদনে আলোকপাত করা হয়েছে। 

স্টোলেন জেনারেশনস হলো এবরোজিনাল এবং টরে' স্ট্রেইট দ্বীপপুঞ্জের শিশুদের প্রজন্ম, যাদেরকে অস্ট্রেলিয়ান সরকারের নীতি অনুযায়ী বিভিন্ন রাজ্য ও টেরিটোরিতে তাদের পরিবার এবং সম্প্রদায় থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।

যেসময়ে স্টোলেন জেনারেশনের বেশিরভাগ শিশুদের জোর করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে তার ব্যাপ্তিকাল হচ্ছে ১৮৬৯ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত। তবে এই সময়ের আগে এবং পরেও অপসারণের ঘটনা ঘটেছিল।

এই শিশুদের বেশিরভাগই শ্বেতাঙ্গ পরিবার দ্বারা পালিত হয়েছিল বা গৃহীত হয়েছিল, কিংবা তাদেরকে এতিমখানা, সরকারি আশ্রম, গীর্জা এবং কল্যাণ সংস্থা দ্বারা পরিচালিত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে লালন-পালন করা হয়েছিল।

Stolen Generations Accept Apology From Kevin Rudd On Sorry Day
A group of Stolen Generation descendants holding images of their relatives. Canberra, 2008. Source: Getty Images AsiaPac


'স্টোলেন জেনারেশনস' কথাটি কিভাবে এলো 

১৯১৫ সালের প্রথম দিকে আদিবাসী শিশুদের অপসারণের নীতিকে বোঝাতে 'স্টোলেন' বা 'চুরি হয়ে যাওয়া' কথাটি ব্যবহারের সূচনা করেন নিউ সাউথ ওয়েলসের সংসদ সদস্য প্যাট্রিক ম্যাকগ্যারি। 

কোন কারণ ছাড়াই মা-বাবার কাছ থেকে শিশুদেরকে সরিয়ে নিতে অ্যাবরিজিনস প্রোটেকশন সংশোধন আইন ১৯১৫ বোর্ডকে যে ক্ষমতা দিয়েছিলো তার সমালোচনা করে তিনি বলেন এটি হচ্ছে 'মা-বাবাদের কাছ থেকে বাচ্চাদের চুরি করে নেয়ার মতো'।

এছাড়া ১৯৮১ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অধ্যাপক পিটার রিড প্রথম 'স্টোলেন জেনারেশনস' কথাটি ব্যবহার করেন।

‘Bringing them Home’ প্রতিবেদন

অস্ট্রেলিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন ১৯৯৭ সালের এপ্রিলে ইন্ডিজিনাস এবং টরে' স্ট্রেইট দ্বীপপুঞ্জের শিশুদের পৃথকীকরণের বিষয়ে 'Bringing them Home' নামে একটি জাতীয় তদন্তের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই রিপোর্টে স্টোলেন জেনারেশনের বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে যার মধ্যে আছে ব্যক্তিগত সাক্ষ্য। 

Children on a reserve or mission
The National Redress Scheme has paid out just 313 survivors of institutional abuse across the nation. Source: SBS


এবরোজিনাল শিশুদের অপসারণ নীতি 

এবরোজিনাল শিশুদের তাদের পরিবার থেকে অপসারণ করা ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ায় একটি সরকারী নীতি ছিল এবং এমনকি কিছু রাজ্যে এটি ১৯৭০-এর দশকেও অব্যাহত ছিল। তবে, এই অনুশীলন ইউরোপীয় সেটেলমেন্টের প্রথম দিনগুলো থেকেই শুরু হয়েছিল।

তখন শিশুদের গাইড, কর্মচারী এবং খামারের শ্রমিক হিসাবে ব্যবহার করা হতো। পারামাটায় প্রথম 'নেটিভ প্রতিষ্ঠান' গড়া হয়েছিল ১৮১৪ সালে আদিবাসী শিশুদের 'সভ্য' করে তোলার জন্য।

বিভিন্ন রাজ্য ভেদে এই নীতিমালায় পার্থক্য থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নীতি ছিল যে ১৪ বছরের বেশি বয়সী বাচ্চাদের অবশ্যই কাজ করতে হবে বা আশ্রমে যেতে হবে এবং অন্যান্য শিশুদের কেবল 'এবরোজিনাল' থাকার কারণে বা মিশ্র বংশোদ্ভূত হবার কারণে অপসারণ করা হতো।

নিউ সাউথ ওয়েলসে অপসারণের জন্য প্রদত্ত কয়েকটি কারণের মধ্যে ছিল: 'এবরোজিনাল বংশোদ্ভুত হওয়া', '১৪ বছর হওয়া', 'অনৈতিকতার ঝুঁকিতে থাকা', 'অবহেলিত বা এতিম হওয়া' ইত্যাদি। 

যে শিশুদের নেওয়া হয়েছিল তাদের প্রায়শই বাসা থেকে অনেক দূরের প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হত। 

Demonstrators rally on the 11th anniversary of the National Apology to stolen generations in Sydney, Wednesday, February 13, 2019
Demonstrators rally on the 11th anniversary of the National Apology to Stolen Generations in Sydney, Wednesday, February 13, 2019 Source: AAP


এবরোজিনদের মূল সমাজের সাথে সংহতকরণ 

এবরোজিনদের (বিশেষত মিশ্র ঐতিহ্যের) অস্ট্রেলিয়ান সমাজের সাথে সংহত করার প্রয়াসেও আত্মীকরণের নীতি ব্যবহৃত হয়েছিল। জোর করে অপসারণ করা অনেক শিশুকে বলা হয়নি যে তারা এবরোজিনাল, বরং তাদের আদিবাসী ঐতিহ্য প্রত্যাখ্যান করতে এবং শ্বেতাঙ্গ সংস্কৃতি গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। কিছু ক্ষেত্রে তাদের নাম পরিবর্তন করা হয়েছিল এবং তাদের নিজ ভাষায় কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছিল।

একীকরণের এই নীতিটি গ্রহণ করা হয়েছিল 'শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বের' ধারণার উপর ভিত্তি করে। এই নীতির লক্ষ্য আদিবাসীদের 'প্রাকৃতিকভাবে নির্মূলকরণ’ (the dying/doomed race theory), অথবা তাদের শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত করা।

এবরোজিন শিশুদের সাথে আচরণ 

স্টোলেন জেনারেশনের সরিয়ে নেওয়া অনেক শিশুর যেসব অভিজ্ঞতা হয়েছিল তাতে তারা প্রচন্ড মানসিক আঘাতের শিকার হয়েছিল। 

শিশুরা কেবল তাদের বাবা-মায়ের কাছ থেকে পৃথক ছিল না বরং পরে তাদের ভাই-বোনদের থেকেও আলাদা করা হয়েছিল। শিশুদের একাধিক বাড়ি বা পালক পরিবারগুলোর মধ্যে ছেড়ে দেয়া হতো যা পৃথকীকরণ প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তুলতো এবং তাদের পক্ষে পরিবারগুলোর সাথে পুনরায় একত্রিত হওয়া আরও কঠিন হয়ে উঠতো।

National Reconciliation Week to focus on truth telling
An Indigenous Australian woman cries in federal parliament as she listens to former PM Kevin Rudd deliver an apology to the Stolen Generations Source: AAP


যেসব শিশুদের সরানো হয়েছিল তাদের পরিবারের সাথে প্রায়শই যোগাযোগ ছিল না এবং কিছু ক্ষেত্রে অভিভাবকদের প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করতে বাধা দেওয়া হতো এবং তাদের চিঠিগুলো ধ্বংস করা বা সেন্সর করা  হতো যাতে তাদের যোগাযোগ সীমাবদ্ধ হয়ে পরে। কিছু ক্ষেত্রে বাচ্চাদের বলা হতো তাদের বাবা-মা বা ভাই-বোন মারা গেছে, যদিও ঘটনা তা ছিল না।  

বাচ্চারা যেসব ঘরবাড়ি এবং প্রতিষ্ঠানে থাকতো সেখানে জীবনযাত্রা এবং থাকার পরিস্থিতি প্রায়শই কঠোর ছিল, সীমিত সংস্থান, কঠোর রুটিন এবং সেইসাথে নির্বিচারে শাস্তি।

বাসাবাড়ি বা প্রতিষ্ঠানে বসবাসকারী শিশুরা যৌন নিপীড়ন, নির্যাতন এবং শোষণের শিকার হযতো। তাদের খুব সামান্য আনুষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহনের সুযোগ থাকতো এবং স্টেশনে ফার্ম সহকারী হিসাবে বা অল্প বয়সে গৃহকর্মের জন্য কাজে প্রেরণ করা হতো। এই শিশুদের অনেকেই তাদের কর্মসংস্থানের জন্য প্রাথমিক মজুরিও পেতো না।

পরবর্তীকালে স্টোলেন জেনারেশনের সদস্যরা তাদের সাথে এই আচরণের জন্য বিচার এবং স্বীকৃতির জন্য দীর্ঘ এবং কঠিন লড়াই করেছে।

স্টোলেন জেনারেশনের সদস্যদের সাথে আচরণের জন্য সরকারের ক্ষমা প্রার্থনা 

'Bringing them Home' প্রতিবেদনের মূল পরামর্শগুলির মধ্যে একটি ছিল সমস্ত অস্ট্রেলিয়ান সংসদ সদস্যদের বাধ্যতামূলক অপসারণের আইন, নীতি ও অনুশীলনের জন্য তাদের পূর্বসূরীরা যে দায়ী ছিল তা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করা।

যদিও বেশিরভাগ রাজ্য এজন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা করেছিল, কিন্তু জন হাওয়ার্ডের দেওয়া ফেডারেল সরকারের বিবৃতিতে যে অন্যায় হয়েছে তার জন্য 'গভীর ও আন্তরিক অনুশোচনা' প্রকাশ করে যা বলা হয়েছে তাতে বহু মানুষ হতাশ হয়েছেন। 

Former prime minister Kevin Rudd
Former prime minister Kevin Rudd and wife Therese hug stolen generation Elaine Randall. Source: AAP Image/Mick Tsikas


এরপর ২০০৮ সালে অস্ট্রেলিয়ান সরকারের পক্ষে একটি আনুষ্ঠানিক ক্ষমা প্রার্থনা করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কেভিন রাড।

'Bringing them Home' প্রতিবেদন প্রকাশের পর চার্চ এবং অন্যান্য কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানগুলোও তাদের জড়িত থাকার জন্য ক্ষমা চেয়েছিল।

ক্ষতিপূরণ এবং নিরাময় 

ওই রিপোর্টের আরেকটি সুপারিশ ছিল যাদেরকে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল তাদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ। 

স্টোলেন জেনারেশনের সদস্যদের সাথে আচরণের ফলে তারা যে মানসিক ক্ষতি এবং ট্রমার শিকার হয়েছিলেন তার জন্য নিরাময় কর্মসূচি বা হিলিং প্রোগ্রাম চালু করা হয়।  

স্টোলেন জেনারেশনের কাছে কেভিন রাডের ক্ষমা প্রার্থনার পরের বছর অস্ট্রেলিয়ান সরকার হিলিং ফাউন্ডেশন গঠন করে যার জন্য ব্যয় ধরা হয় ২৬.৬ মিলিয়ন ডলার।  

স্টোলেন জেনারেশনের সদস্য আন্টি জুলি ব্ল্যাক যা বলেন

জন্মের পরপরই বারকিন্ডজি নারী এবং স্টোলেন জেনারেশনের সদস্য আন্টি জুলি ব্ল্যাককে তার মায়ের কাছ থেকে নিয়ে যাওয়া হয়।  

৬৪ বছর বয়স্ক এই নারী বলেন, তার পালক মায়ের কাছে তার যে অভিজ্ঞতা হয়েছিলো তা তাকে এখনো তাড়িত করে।  

হিলিং ফাউন্ডেশনের সাথে এক সাক্ষাৎকারে আন্টি জুলি বলেন, "আমাকে চার বছর বয়স থেকেই বাড়ির বাইরে টয়লেটে আটকে রাখা হতো।" 

Barkindji woman Julie Black was taken from her mother shortly after she was born.
Barkindji woman Julie Black was taken from her mother shortly after she was born. Source: Healing Foundation


"আমি কাঁদতাম কারণ আমি বের হতে চাইতাম এবং আমার টেডি বেয়ারটিকে বাঁচাতে চাইতাম। উপর থেকে পানি পড়তো, সে (পালিত মা) আমাকে ঠেলে ভেতরে ঢুকিয়ে দিতো।" 

তিনি বলেন, "হয়তো কিছু তাকে বিচলিত করতো, যে কারণে সে আমাকে বাড়ির বাইরে টয়লেটে আটকে রাখতো।"

"কখনো কখনো ঘন্টার পর ঘন্টা, ভিন্ন দিন, ভিন্ন সময়ে।" 

তিনি বলেন, "আমি প্রার্থনা করতাম যাতে আমার প্রকৃত মা আসে এবং আমাকে নিয়ে যায়।  আমাকে বাড়ি নিয়ে যাও। আমি সেখানে থাকতে চাইতাম না।" 

পরবর্তীকালে আন্টি জুলি ২৫ বছর বয়সে তার নিজ মা এবং কমিউনিটির সদস্যদের সাথে পুনরায় মিলিত হতে পেরেছিলেন। কিন্তু সেই বিচ্ছিন্নতা এবং নির্যাতনের ট্রমা এখনো তাকে প্রভাবিত করে।  

নিজ কমুউনিটির সাথে মিলতে পেরে তিনি বলেন, "আপনি যখন আপনার নিজ লোকদের সাথে মিলিত হতে পারেন, সেটা আপনাকে আপনার এবরোজিনাল আত্মাকে নিরাময় করে।"

 শুনুন প্রতি সোমবার এবং শনিবার সন্ধ্যা ৬টায় এবং আরও খবরের জন্য আমাদের  ভিজিট করুন। 

আরো দেখুন:



 

 


Share
Published 6 April 2021 10:20pm
Updated 12 August 2022 3:03pm
By Karina Marlow, Shahan Alam
Presented by Shahan Alam
Source: NITV, SBS News

Share this with family and friends