অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের নামের সাথে অপ্রাপ্তি, বঞ্চনা আর বৈষম্য যেন এক হয়ে গেছে ,
তাই তাদেরকে ‘ডিসএডভান্টেজড ইন্ডিজেনাস’ বা সুবিধাবঞ্চিত আদিবাসী বলা হয়ে থাকে।
অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসীরা দেশের বাকি নাগরিকদের তুলনায় স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কাজ সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রেই অনগ্রসর।
দেশের বাকি নাগরিকদের তুলনায় তাদের স্বাস্থ্যের অবস্থা ভাল নয় — প্রত্যাশিত আয়ু বা লাইফ এক্সপেক্টেন্সি কম।
তাদের মধ্যে শিশু মৃত্যুর হার বেশি । এর সাথে যোগ হয়েছে আত্মহত্যার উচ্চ হার, ট্রমা বা মনোবৈকল্য এবং অপরাধপ্রবণতা।
পরিসংখ্যানের সব তথ্য, উপাত্ত অনুযায়ী তাদের অবস্থা খুবই নাজুক ও ভয়ঙ্কর বলা যায়।
প্রতি ছয়জনের একজন আদিবাসী এখন জেলে আছেন বা জীবনে একবার হলেও জেলে গিয়েছেন।
এবরিজিন ও টরে’ স্ট্রেইট দ্বীপবাসীর দুরবস্থার কথা প্রোডাক্টিভিটি কমিশন এর রিপোর্ট থেকে জানা যায়। প্রতি চার বছরে প্রোডাক্টিভিটি কমিশন জাতীয় পর্যায়ে নীতি নির্ধারণ করতে এই তথ্যনির্ভর প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে।
এই কমিশনের কমিশনার রোমলি মোকাক প্রোডাক্টিভিটি রিপোর্ট প্রসঙ্গে বলেন,
এই রিপোর্ট আদিবাসীদের জীবনব্যবস্থার তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে।এই প্রতিবেদনে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন দিক যেমন স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ, এবং অপরাধ ও বিচার বিষয়ে আলোকপাত করা হয়। কমিশনার মোকাক আরও জানান —
Romlie Mokak, Commissioner, Productivity Commission Source: Productivity Commission
কমিউনিটির সাংস্কৃতিক পটভূমি, ভাষা, ভৌগলিক দূরত্ব, পারিবারিক কাঠামো সহ সব মিলিয়ে ৫২টি পদক্ষেপে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর সমীক্ষা চালানো হয় যাতে গোটা জনজীবনের একটা সামগ্রিক চিত্র তুলে আনা যায়।
২০২০ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট বা শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ, স্কুলে অংশগ্রহণ এবং নিম্ন শিশু মৃত্যুর হারের দিক দিয়ে আদিবাসীদের অগ্রগতি দেখা গেছে।
তবে চিন্তিত হবার বিষয় যে শিশুদের আউট অফ হোম কেয়ার বা গ্রৃহসেবা বঞ্চিত শিশুর সংখ্যা বেড়ে গেছে ।
পরিবার ও আত্মীয়পরিজন থেকে শিশুদের সরিয়ে নেওয়া আর বিচারব্যবস্থায় তাদের সংখ্যাধিক্যের সরাসরি সম্পর্ক আছে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এখন যাদের ইয়ুথ জাস্টিস সিস্টেম এবং পরিণত বয়সীদের কারাগারে দেখা যায়, তাদের বড় অংশই শিশুকালে পরিবারের যত্ন-মমতা পায়নি।
এন আই টিভির নতুন প্রামাণ্যচিত্র ইনকারসিরেশন নেশন এর প্রযোজক হেলেন মরিসন এর মতে, স্বজন হারানোর মনোবেদনার সাথে যোগ হয়েছে আরও স্বজন যারা কারাভোগ করতে চলেছে।
এই সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয় সংকট জনিত বহুমুখী আঘাত তাদেরকে যেন
প্রজন্মান্তরের অন্তঃক্ষরন বা ইন্টারজেনারেশনাল ট্রমায় ফেলে দেয়।
ফার্স্ট নেশন বা অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা পৃথিবীর সর্বোচ্চ সংখ্যক কারাদন্ড ভোগী জনগোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম।
এই বিপুল সংখ্যক আদিবাসীর কারাবাসের খরচ বছরে প্রায় আট বিলিয়ন ডলার।
উপনিবেশ স্থাপনকাল থেকে চলে আসা ঔপনিবেশিক নীতিমালার প্রয়োগে আদিবাসী জনগোষ্ঠী বৈষম্য এবং সিস্টেমেটিক ডিসএডভান্টেজ বা পদ্ধতিগত প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে।
আদিবাসীদের মাটি ও সংস্কৃতি কেড়ে নেওয়া হয়েছিলো।
নিপীড়ন, জুলুম আর বৈষম্যের কারণে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আদিবাসীরা সুবিধাবঞ্চিত ও দরিদ্র হয়ে আছে।রোমলি মোকাক এর মতে, অতীতে যা হয়েছে তার কারণেই আদিবাসীরা বর্তমানে এই অবস্থায় উপনিত হয়েছে।
Leetona Dungay and Karina Hogan, Incarceration Nation participants Source: Joseph Mayers
এই ঐতিহাসিক অতীতকে অস্বীকারের কোন উপায় নেই ।
সরকারী নীতিতে ১৯১০ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত শিশুদের জোর করে বাবা মার কোল থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে।
এভাবে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে শেকড়চ্যুত করা হয়। শ্বেতাঙ্গ সমাজে এসিমিলেট বা আত্মীকৃত করতে এই নীতির বাস্তবায়ন করা হয়।
কয়েক প্রজন্ম ধরে এই জবরদস্তি আত্মীকরণ প্রক্রিয়া চালানো হয়।
শৈশব চুরি হয়ে যাওয়া সেই প্রজন্মকে স্টোলেন জেনারেশন বলে।
শিশুদের এভাবে নিজের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করার ফলে তাদের মধ্যে মানসিক অসুস্থতা দেখা দেয়। এই শিশুরা বড় হয়েও নিজের শেকড়ের সন্ধান করতে থাকে। তার পরিবার ও তার হারিয়ে যাওয়া দেশের তালাশ করতে থাকে যা তার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিলো।
মানসিক ভারসাম্যতা হারানোর ফলে তাদের মধ্যে নেশার প্রবণতা ও পারিবারিক সহিংসতা বেড়ে যায়।
স্টোলেন জেনারেশনের আজও অনেকে বেঁচে আছেন যাদের শৈশব চুরি হয়েছে বা যাদের কাছ থেকে শিশুদের উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
সেই সময়ে আদিবাসীদের
- শিক্ষা গ্রহনের অধিকার ছিলো না,
- তাদের মজুরী দেওয়া হতো না,
- স্বাস্থ্যসেবার অধিকার ছিলো না
- পাবলিক প্লেসে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিলো তাদের,
- এমনকি ভোটের অধিকার ছিলো না ।
এই ঐতিহাসিক অন্যায় অবিচারকে আদিবাসীদের উচ্চ অপরাধ প্রবনতা ও কারাদন্ডের কারণ বলে মনে করেন হেলেন মরিসনবিশ বছর আগে যেখানে আদিবাসী প্রাপ্তবয়স্ক কারাভোগীর সংখ্যা ছিল চার হাজার জন, বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ১২ হাজার। নন-ইন্ডিজেনাস অস্ট্রেলিয়ানদের চাইতে এটা ১২ গুণ বেশি আর তরুণ আদিবাসীদের ক্ষেত্রে তা ২২ গুণ বেশি।
Indigenous men make up 27 per cent of prisoners in Australia. Source: Joseph Mayers
এই বিপুল পরিসংখ্যান দেখে হেলেন মরিসন ‘ইনকারসিরেশন নেশন’ বা হাজতবাসী জাতি শিরোনামে তথ্যচিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেন। কারাভোগী আদিবাসীদের বর্তমান অবস্থা বোঝার জন্য তার অতীত অনুধাবন জরুরী বলে মনে করেন তিনি।
অনেক অস্ট্রেলিয়ান অতীতের কথা স্বীকার করতে দ্বিধা করেন না। অস্ট্রেলিয়ার অনেকে অতীতে সংঘটিত অবিচার, অনাচারকে সামনে তুলে আনতে চান। সহজ যুক্তিতে হেলেন মরিসন আজকের সুবিধাবঞ্চিত আদিবাসীর কথা, তাদের প্রতিকূল জীবনব্যবস্থার কথা তুলে ধরতে চান।
আদিবাসী ও বাদবাকি জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্বাস্থ্য ও প্রত্যাশিত আয়ুর ক্ষেত্রে সমতা আনতে
সরকার ‘ক্লোজিং দ্য গ্যাপ’ বা দূরত্ব মোচন শীর্ষক কর্মসূচির উদ্যোগ নিয়েছে। এই কর্মসূচিতে বিভিন্ন সংস্কারমূলক উদ্যোগ আছে।
‘দ্য ন্যাশনাল এগ্রিমেন্ট অন ক্লোজিং দ্য গ্যাপ’ এর আওতায় এবরিজিনাল ও টরে’ স্ট্রেইট দ্বীপের আদিবাসীদের সাথে সরকারের সকল স্তরে যৌথ সিদ্ধান্ত গ্রহনে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অগ্রগতির জন্য সরকারের সাথে যৌথ নীতি ও কৌশল প্রণয়ন করতে হবে,
তবে সবকিছুর উর্ধ্বে আদিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকারকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ন মনে করেন রোমলি মোকাক।
আপনার বা আপনার আশপাশের কারোর যদি জরুরী সাহায্যের দরকার হয় তবে কল করুন লাইফ লাইন নাম্বারে ১৩১১১৪
অথবা যোগাযোগ করুন বিয়ন্ড দ্য ব্লু ১৩০০ ২২৪ ৬৩৬ নাম্বারে।
'ইনকারসিরেশন নেশন’ বা হাজতবাসী জাতি প্রচারিত হবে এনআই টিভি এবং এসবিএস অন ডিমান্ডে আগামী রোববার ২৯ আগস্ট রাত সাড়ে আটটায়
**ইনকারসিরেশন নেশন’ বা হাজতবাসী জাতির ট্রেলার দেখতে ক্লিক করুন। সতর্কতাঃ এই ভিডিওর কনটেন্ট দর্শকদের সংবেদন মনে আঘাত করতে পারে। **
প্রতিবেদনটি শুনতে উপরের অডিও-প্লেয়ারটিতে ক্লিক করুন।
আরও দেখুন: