হলিউড সুপারস্টার ক্রিস হেমসওয়ার্থ 'এক্সট্রাকশন' সিনেমার অন্যতম প্রযোজকও, সিনেমাটি নিয়ে দর্শকদের মাঝে বেশ আগ্রহ ছিল অনেক আগে থেকেই, বিশেষ করে বাংলাদেশী দর্শকদের। এর মূল কারণ ছবির প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার একটি অংশ। তবে ছবির শুটিং হয়েছে ভারতের আহমেদাবাদে এবং থাইল্যান্ডে, ঢাকার শুধু কিছু প্লেটশট জুড়ে দেয়া হয়েছে।
কয়েকজন বাংলাদেশী কলাকূশলীও এতে কাজ করেছেন, এ সত্ত্বেও বাংলাদেশী দর্শকরা হতাশ হয়েছেন যেভাবে ঢাকা শহরকে এবং শিশু-কিশোর সন্ত্রাসকে বিকৃত ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়াতে অনেক বাংলাদেশী দর্শকই সিনেমাটি নিয়ে তাদের বিরক্তি প্রকাশ করেছেন।
ছবিটিতে দেখানো হয় মুম্বাইয়ের এক আন্ডারওয়ার্ল্ড ড্রাগ লর্ডের কিশোর পুত্র অভিকে ঢাকার আরেক আন্ডারওয়ার্ল্ড রিং লিডার অপহরণ করে ঢাকায় নিয়ে আসে। তাকে উদ্ধার করতে নিয়োগ দেয়া হয় একজন মার্সেনারি টেইলর রেইককে (ক্রিস হেমসওয়ার্থ)। এই উদ্ধার প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই চলতে থাকে ব্যাপক সংঘাত-রক্তারক্তি যা এক পর্যায়ে রূপ নেয় ত্রিমুখী সংঘর্ষে। সারা সিনেমা জুড়ে আছে ধুন্ধুমার মারপিট, ভাঙচুর, গোলাগুলি, গাড়ি এবং হেলিকপ্টার নিয়ে ধাওয়া-ধাওয়ি যা হলিউডের টিপিক্যাল অ্যাকশন সিনেমায় দেখা যায়।এখন কথা হচ্ছে ‘এক্সট্রাকশন (২০২০)’ সিনেমায় যেভাবে ঢাকা এবং বন্দুক হাতে শিশু-কিশোর গ্যাংটিকে দেখানো হয়েছে তা কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য?
'এক্সট্রাকশন' সিনেমায় ক্রিস হেমসওয়ার্থ ও সহশিল্পী Source: Jasin Boland/Netflix via AP
এই প্রসঙ্গে ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি সিডনির পিএইচডি গবেষক এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা ইমরান ফিরদাউস এসবিএস বাংলাকে বলেন, "এক্সট্রাকশন সিনেমার মধ্য দিয়ে অ্যাকশন দৃশ্য পরিচালনা থেকে পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্রে স্যাম হারগ্রেভের বউনি (debut) ঘটেছে। নেটফ্লিক্স অরিজিনাল ফিল্ম বলে প্রযোজিত-পরিবেশিত ১১৭ মিনিটের চলচ্চিত্রে যদিও অরিজিনাল বা মৌলিক উপাদানের ঘাটতি মাছের কাঁটার মতন গলায় খচখচ করতে থাকে পুরো দৈর্ঘ্য জুড়েই। অভিযোগ উঠছে প্রযোজক-পরিচালক বাংলাদেশকে নেতিবাচক অর্থেই হাজির করে ক্ষান্ত হন নাই বরং কিম্ভূতকিমাকার ও অযৌক্তিক চিত্র নির্মাণ করেছেন।"
তিনি বলেন, চলচ্চিত্রের পর্দায় ইন্ডিয়া ও বাংলাদেশে ঘটমান বর্তমান বলে যে কাহিনি চালিয়ে দেয়া হয়েছে, তাতে রুগ্ন গবেষণা ও দুর্বল চিত্রনাট্যের দগদগে ছাপ বাংলাদেশে বসবাসকারী নাগরিকদের জন্য যথেষ্ট বিরক্তির উদ্রেক করেছে।"দুর্ধর্ষ মারপিট ও জুলুম-জবরদস্তিময় এই সিনেমার আখ্যান সিউদাদ নামক গ্রাফিক নভেল থেকে ধার করা হয়েছে। গ্রাফিক নভেলটির কাহিনি বিস্তৃত হয়েছে দক্ষিণ আমেরিকার প্যারাগুয়ের সিউদাদ দেল এস্তে শহরে। ইতিহাস সাক্ষী দেয় যে, সামরিক শাসনে জেরবার দক্ষিণ আমেরিকার অনেক দেশেই মাদক ব্যবসায়ীদের সাথে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সামরিক বাহিনীর আঁতাত থেকে থাকে এবং সেখানে কিশোর বন্দুকবাজদের উপস্থিতি জাহির আছে। যেমন মনে করা যাক কলম্বিয়ার পাবলো এস্কোবারের কথা। অথবা মনে করা যাক ২০০২ সনে অস্কার মনোনীত ব্রাজিলিয় চলচ্চিত্র সিদাদ দি দেউস (পরিচালনায ফারনান্দো মেইরেলেস এবং কাটিয়া লান্ড)। যেখানে, রিও ডি জেনিরোর ফাভেলা বা বস্তিতে জন্ম নেয়া কিশোরদের গ্যাংস্টার হিসেবে উত্থান-পতনের টানটান গল্প তুলে ধরা হয়েছে।"
চলচ্চিত্র নির্মাতা ইমরান ফিরদাউস Source: Supplied
চলচ্চিত্র নিয়ে পিএইচডি গবেষণারত মিঃ ফিরদাউস মনে করেন, এইসবের কোনটাই বাংলাদেশের অপরাধ সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
"হ্যাঁ অবশ্যই বাংলাদেশে দুর্নীতি হয়, একপেশে নির্বাচন হয় - তাই বলেই ড্রাগলর্ডের সাইডকিক হিসেবে কোন এলিট ফোর্সের প্রধান হুকুম তামিল করবেন এইটা আকাশকুসুম কল্পনা তো বটেই।"
নিউ মিডিয়া বিস্তারের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "খুচরা আলাপ হিসেবে বলে রাখা যাক, নেটফ্লিক্স এখন মরিয়া হয়ে আছে ইন্ডিয়ার অনলাইন স্ট্রিমিং ব্যবসায় ভাগ বসানোর জন্য। যার শতকরা ২৯ ভাগ দখল করে আছে হটস্টার (কিছুদিন আগে ডিজনি এই সাইটটি কিনে নেয়) এবং ১০ ভাগ দখল করে আছে অ্যামাজন প্রাইম। তো, স্বভাবতই বোঝা যাচ্ছে গল্পের খাতিরে বাংলাদেশ এই প্রকল্পে একটি ভৌগলিক সীমানা মাত্র। কিন্তু সান্ত্বনা পুরস্কার হিসেবে কলাকুশলীদের মাঝে ভাষিক পরামর্শদাতা, স্থানীয় সমন্বয়ক হিসেবে বাংলদেশের নাগরিকদের অংশগ্রহণ সত্ত্বেও সিনেমায় ভাষার প্রশ্নে মেক বিলিভের উড়োজাহাজ মুখ থুবড়ে পড়েছে।"
সিনেমার আঙ্গিক প্রসঙ্গে মিঃ ফিরদাউস বলেন, "হলিউডের জ্যাকি চ্যান হতে চাওয়া স্যাম হারগ্রেভের এক্সট্রাকশন -এ থাকতে পারে সিঙ্গেল টেকে নেওয়া ১২ মিনিটের অ্যাকশন দৃশ্য, দেখা যেতে পারে চিরাচরিত সাদা মানুষের বাদামি মানুষকে বিপদ থেকে উদ্ধারের উত্তর-ঔপনিবেশক গল্প... শুধু থাকে না বাস্তবতার সাথে কোন সাযুজ্য। এমতাবস্থায়, নিছক দেশপ্রেম বা জাতীয়তাবাদের ভুয়ো ঝাণ্ডা দিয়ে এহেন পরিস্থিতির মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। আরো সম্ভব নয় প্লেটশটে আঁটা ট্রু-মোশনে আঁকা এক টুকরা সোনার বাংলাদেশের বিশ্ব মানচিত্রে ঠাঁই পাওয়ার মেকী অর্জনে উদ্বলিত হয়ে।”
'এক্সট্রাকশন (২০২০)’ সিনেমাটি সম্পর্কে চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং প্রযোজক আনোয়ার আহমেদ এসবিএস বাংলাকে বলেন, হলিউড বরাবরই স্টেরিওটাইপিং-এর জন্য 'কুখ্যাত' এবং এ ছবিটিও তার ব্যতিক্রম নয়।
"স্টেরিওটাইপিং ফিল্মে গল্প বলার জন্য কস্ট এফেক্টিভ এবং এফিসিয়েন্ট, সহজে দর্শকদের আকৃষ্ট করা যায়, এই ছবিতে নির্মাতা বাংলাদেশকে শুধু একটি প্রেক্ষাপট হিসেবে ব্যবহার করলো, সেইসাথে বাংলাদেশের ইমেজকে স্টেরিওটাইপ করলো।"তিনি মনে করেন ছবিটি করতে নিয়ে তারা কোন গবেষণা করেনি, "ছবিটি নিয়ে গবেষণা করার কোন ইন্টারেস্ট ছিল কিনা আমার সন্দেহ আছে, ছবির নির্মাতা অ্যাকশন ছবির স্ট্যান্টম্যান ছিলেন, এটিই তার প্রথম ছবি, তাই এটি করতে গিয়ে ছবিটিকে কালচারালি অথেনটিক করতে তার কোন আগ্রহ ছিল কিনা কিংবা আদৌ চেষ্টাই করেছে কিনা আমার সন্দেহ আছে।"
চলচ্চিত্র নির্মাতা আনোয়ার আহমেদ Source: Supplied
মিঃ আহমেদ বলেন, "ছবিটি বিভিন্ন স্ট্যান্ট আর অ্যাকশন দৃশ্য দিয়ে পূর্ণ, থ্রিল ছিল ছবিটার মূল ড্রাইভ, তাই এটিকে কালচারালি অথেনটিক করা, সেনসেটিভ করা, অথবা রিয়ালিস্টিক করার বিষয়ে তাদের কোন ইন্টারেস্ট ছিল বলে মনে হয় নি।"
"তারা মূলত ছবিটিকে এন্টারটেইনমেন্ট থ্রিলার হিসেবেই ফোকাস করেছে, এটি অনেকটা ভিডিও গেম খেলার যে মজা ঠিক সেভাবেই তৈরী করেছে; এখানে যে জায়গায় ছবিটি নির্মিত হয়েছে সেখানকার সমাজের কোন রিফ্লেকশন এখানে দেখা যায় নি।"
এদিকে ইন্টারনেটের প্রসারের ফলে নিউ মিডিয়ার যে বিস্তার ঘটেছে তা ইতিবাচক বলে মনে করেন চলচ্চিত্র নির্মাতা আনোয়ার আহমেদ।
তিনি বলেন, "আগে বাংলাদেশের নির্মাতারা শুধু বাংলাদেশ এবং বিভিন্ন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে তাদের ছবি দেখাতে পারতেন, সেখানে সুযোগ ছিল সীমিত। কিন্তু এখন নেটফ্লিক্সসহ বিভিন্ন অনলাইন প্লাটফর্মে সারা বিশ্বে আরো বেশি দর্শকের কাছে যেতে পারার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।"
পুরো সাক্ষাৎকারটি শুনতে ওপরের অডিও প্লেয়ারটিতে ক্লিক করুন।
আরো পড়ুন:
READ MORE
অকালেই চলে গেলেন ইরফান আলি খান