আপনি ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি সিডনিতে স্ক্রীন স্টাডিজে পিএইচডি করছেন, এ সম্পর্কে কিছু বলবেন?
আমার গবেষণার বিষয়বস্তু হচ্ছে আলোচিত-সমালোচিত আর্জেন্টাইন-ফ্রেঞ্চ চলচ্চিত্র নির্মাতা গ্যাসপার নোয়ে'র চলচ্চিত্র নিয়ে যিনি সমসাময়িক নির্মাতাদের মধ্যে একটি নিজস্ব ভাষা নির্মাণ করতে পেরেছেন। এই ভাষার কাঠামোটা কেমন, কি অনুপ্রেরণা এখানে কাজ করে, কিভাবে এই প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকছেন সেটা অনুধাবনই এই গবেষণা উদ্দেশ্য।আপনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সংসদ কার্যক্রমের সাথে যুক্ত ছিলেন, চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং লেখালেখি করেছেন, বাংলাদেশে স্বাধীন ধারা বা আর্ট হাউজ ফিল্মের চিত্রটি এখন কেমন?
চলচ্চিত্র নির্মাতা, গবেষক, লেখক ইমরান ফিরদাউস Source: Supplied
বাংলাদেশের স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্রের সংখ্যা তাত্ত্বিক পরিসংখ্যান বেশ ভালো; শর্ট ফিল্ম, ডকুমেন্টারী, ফিচার সব শাখাতেই সরকারি অনুদান আছে, বিকল্প লগ্নিকারকরা আছেন, বিভিন্ন উৎসবভিত্তিক বা যৌথ প্রোডাকশনের বাজার তৈরী হয়েছে। সব মিলিয়ে অর্থের যোগান, ফিল্মমেকারদের উপস্থিতি আছে। তবে যা পাচ্ছি সেটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে।
চলচ্চিত্র নির্মাণে ডিজিটাল প্রযুক্তি অনেকের জন্য চলচ্চিত্র নির্মাণ সহজ করে দিয়েছে, কিন্তু সেই ভাবে মান সম্পন্ন ফিল্ম কি তৈরি হচ্ছে?
একটি জটিল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ যাচ্ছে। ডিজিটাল টেকনোলজি আসার আগ পর্যন্ত যন্ত্রপাতির সমস্যা ছিলো। আরো ছিল এবং এখনো আছে আর্ট হাউজ আর এফডিসি কেন্দ্রিক চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব। একসময় প্রযুক্তিগত বিষয়টিকে বড়ো করে দেখা হতো, এখন ডিজিটাল প্রযুক্তি আসার পর আরো অনেক নির্মাতা আসছেন, এবং ফিল্ম মেকিং একটি গণতান্ত্রিক রূপ পাচ্ছে। কিন্তু প্রযুক্তি নিয়ে বেশি ভাবার ফলে ছবির দর্শন, ভাবনা বা শিল্প হিসেবে একটি ছবি কিভাবে জীবনযাপনের বা জীবন যুদ্ধের অংশ হয়ে উঠবে, বা তাকে সাহস যোগাবে বা তার তৃষ্ণার খোরাক যোগাবে, সেই বিষয়টি অনেকখানি মলিন হয়ে উঠতে থাকলো। তার সাথে যুক্ত হলো ডিস্ট্রিবিউশন, কো-প্রোডাকশন, বিকল্প লগ্নিকারকদের অংশ গ্রহণ। কিন্তু এতে একজন নির্মাতা তার কাজকে শিল্পমান উত্তীর্ণ বলে ধরে নিচ্ছেন, কিন্তু ছবিটি প্রযুক্তিগত ভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েও দর্শকদের কাছে কতটুকু পৌঁছাচ্ছে বা তাদের সংকটের নিদান হয়ে কতটুকু জরুরি ভূমিকা রাখছে সেটি এখনো স্পষ্ট নয়।
বাংলাদেশে তিন-চার বছরে হয়তো দুয়েকটি ছবি নির্মাণ হয় যেগুলি সমালোচকদের প্রশংসা পায়। বেশিরভাগ সিনেমাতেই ফিল্ম মেকিঙ টেকনিকের একটা স্পষ্ট ঘাটতি দেখা যায়। নির্মাতাদের কিসের অভাব বলে আপনার মনে হয়?
নির্মাতাদের এখানে একধরণের বোঝাপড়ার সংকট আছে; তাছাড়া এই যে ছবিগুলিকে আমরা স্বাধীন বলছি সেগুলি আসলে স্বাধীন কিনা সেই প্রশ্নের উত্তরে সংকট রয়েছে, কারণ এই ছবিগুলি আমার দৃষ্টিতে একধরণের মেইনস্ট্রিম ইনডিপেনডেন্ট ছবি। এখানে মেইনস্ট্রিমের সুবিধা ব্যবহার করা হয় কিন্তু গল্পটা থাকে আর্ট হাউজের বা ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল উপযোগী যেখানে উন্নয়ন সংস্কৃতির অংশ হিসেবে যে সব ইস্যুগুলো বাজারে চালু আছে যেমন সাম্প্রদায়িকতা, নারীর ক্ষমতায়ন, বৈষম্য ইত্যাদি মূল বিষয়। তাই ইস্যু ভিত্তিক ফিল্ম নির্মাণ করতে গিয়ে তারা পপুলিস্ট বা জনপ্রিয় ধারার ফিল্ম নির্মাণের কৌশলটা হারিয়ে ফেলেছেন। সিনেমার মাধ্যমে বৃহত্তর জনপরিসরে যোগাযোগ স্থাপন, দেশের বা সমাজের ভিতর সংকটকে অটো সেন্সরশিপের ভিতরে না রেখে সিনেমার যে রাজনৈতিকতা আছে সেটিকে সর্বাংশে ব্যবহার করা, এই বিষয়গুলো এখনো আমাদের চলচ্চিত্র চর্চার অন্তর্ভুক্ত নয়। দুৰ্ভাগ্যবশতঃ এফডিসির বাণিজ্যিক সিনেমায় শোষক-শাসিতের দ্বন্দ্ব, বা শোষককে শাসিতের চ্যালেঞ্জ যতটা দেখা যায় প্রতিনিয়ত, স্বাধীন ধারার সিনেমায় তা দেখা যায় না।এফডিসি কেন্দ্রিক বাণিজ্যিক বা বিনোদনধর্মী চলচ্চিত্র সম্পর্কে আপনার কি মূল্যায়ন?
বাংলাদেশী মূলধারার ছবির একটি পোস্টার Source: Eskay Movies
বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র ব্যতিক্রম যেখানে এফডিসির মতো প্রতিষ্ঠানকে সরকারের দেয়া ইনসেনটিভ দিয়ে চালু রাখা হয়েছে। কিন্তু জাতীয় চলচ্চিত্র নীতিমালা না থাকার কারণে অবকাঠামোগত সুযোগ সুবিধা কিভাবে সমবন্টন হবে সে বিষয়ে স্পষ্ট দিক নির্দেশনা নেই। তাছাড়া চলচ্চিত্র নির্মাণের যে ইতিহাস তা ধারাবাহিক আর্কাইভেশন স্পষ্টকরণের বিষয়টি এখনো ঘটেনি। এই ছবি গুলি এখনো জগদ্দল পাথরের মতো হয়ে আছে যেটি আসলে ঠেলে ঠেলে চালাতে হচ্ছে, এবং এই ছবিগুলির অবস্থাও এখন মৃতপ্রায়, যা আমাদের সামাজিক জীবনে তেমন ভূমিকা রাখছে না।
যেভাবে সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তাতে কি মনে হয় আগামি দিনগুলোতে আমরা কি অনলাইনেই সিনেমা দেখবো ?
এখন সময়টাই টেকনোলজির, তাই অনলাইনেই ছবি দেখার সুযোগ বেশি, তবে সিনেমা বরাবরই পুঁজির ব্যবসা, এর সম্প্রসারণ ঘটছে, সেই দিক থেকে দেখতে গেলে অনলাইনে মানুষ ছবি দেখবে কিন্তু সিনেমা হলের গুরুত্ব ফুরিয়ে যাবে না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একটা দুষ্টচক্র কাজ করে যেখানে একজন নির্মাতা তার টাকাটা তুলে আনতে পারে না, সেখানে যদি জাতীয় চলচ্চিত্র নীতিমালার মাধ্যমে সরকারি ভাবে দেখভাল করা হয় তখন আমার মনে হয় সিনেমা হলগুলি দর্শকের অভাবে বন্ধ হয়ে যাবে না। ফিল্ম মেকাররা দর্শকের কথা মাথায় রেখে এবং নিজেদের শিল্পচর্চার তাগিদ থেকে আরো ছবি নির্মাণ করবেন যেটি আসলে সিনেমা হল ধারণাটিকে জিইয়ে রাখবে।বাংলাদেশে অনেকেই বিদেশী ফান্ড নিয়ে কো-প্রোডাকশন করছেন, এই ধারাটি সম্পর্কে আপনার মতামত কি?
স্বাধীন ধারার চলচ্চিত্র 'লাইভ ফ্রম ঢাকা' সমালোচকদের প্রশংসা পেয়েছে Source: Live from Dhaka/ Facebook
এটি বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে চলচ্চিত্র নির্মাণ ব্যবসার উল্লেখযোগ্য ঘটনা এ মুহূর্তে। এখানে উৎসব গুলো এবং ফিল্ম মেকাররা নিজেরাই বিপণন, ডিস্ট্রিবিউশনে অংশ নিচ্ছেন। তাছাড়া ট্যালেন্ট ক্যাম্পাস, পিচিং সেশন, প্রজেক্ট ফান্ডিং, ডিস্ট্রিবিউশন, অনলাইন স্ট্রিমিং ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে আসলে কি ঘটছে? চলচ্চিত্র উৎসবগুলো প্রদর্শনের উপায় হিসেবে নিজের চরিত্র জারি রাখতে পারছে না। তারা বরং চলচ্চিত্র ধারণার বিকাশ , উন্নয়ন, সমপ্রসারণ এবং বিপণন প্রশ্নে আরো জটিল ভূমিকা পালনে সক্রিয় হয়ে উঠছে। এখানে দর্শককেন্দ্রিক এজেন্ডার চেয়ে ব্যবসায়িক এজেন্ডা বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। এর ফলে বিকল্প লগ্নিকারকদের সাথে যুক্ত হয়ে একজন ব্যক্তি চলচ্চিত্র নির্মাতা হয়ে উঠছেন ঠিকই কিন্তু এখানে দর্শকদের যোগাযোগ ঘটছে না। আমরা শুধু কো-প্রোডাকশনের কথিত ছবিটির ব্যাপারে পত্রিকাতেই পড়ছি, দেখতে পাচ্ছি না, তা এক ধরণের মিথ বা রহস্য হয়ে উঠছে। এর মাধ্যমে একটি দেশকে প্রেস্ক্রাইবড আকারে দেখানো হয় যা আরেক কর্পোরেট পুঁজির খেলা। বিদেশী ফান্ড বা কো-প্রোডাকশনের অন্বেষণে থাকা উৎসবমুখী নির্মাতারা তাই সিনেমার গল্প খুঁজে পান না। তারা সবসময় বলেন গল্প নিয়ে ভাবছি, গল্প কোথায় ?
পুরো সাক্ষাৎকারটি শুনতে ওপরের অডিও প্লেয়ারটিতে ক্লিক করুন