Latest

ইন্ডিয়া না ভারত, জোর বিতর্ক দিল্লিজুড়ে

জি-টোয়েন্টি সামিট-এর জন্যে প্রস্তুত ভারতের রাজধানী দিল্লি। আর এর মধ্যে রাষ্ট্রপতির আয়োজনে জি-২০ বৈঠকের নৈশভোজের আমন্ত্রণপত্রে, ইন্ডিয়া'র পরিবর্তে 'ভারত' নামবদল নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে। কংগ্রেসের দাবি, ঐ আমন্ত্রণপত্রে চিরাচরিতভাবে ‘প্রেসিডেন্ট অব ইন্ডিয়া’-র পরিবর্তে লেখা হয়েছে ‘প্রেসিডেন্ট অব ভারত’। এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন উঠছে, আসন্ন সংসদের বিশেষ অধিবেশনে কি এই সংক্রান্ত প্রস্তাব পেশ করতে চলেছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার?

India G20

An Indian para-military force soldier stands guard ahead group of G20 nations meeting in Delhi, India, Thursday, Aug. 7, 2023. (AP Photo/Channi Anand) Source: AAP / Channi Anand/AP

৯ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু জি-২০ সমাবেশে অংশ নেওয়া রাষ্ট্র নেতাদের একটি নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। সেই উপলক্ষে আমন্ত্রণপত্রও যাচ্ছে নিমন্ত্রিতদের কাছে। যে আমন্ত্রণপত্র ঘিরে তোলপাড় পড়ে গিয়েছে ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে। কারণ, ভারতের রাষ্ট্রপতি কাউকে কোনও চিঠি লিখলে তাতে চিরাচরিতভাবে লেখা থাকে ‘প্রেসিডেন্ট অব ইন্ডিয়া’ কথাটি। কিন্তু, জি-২০ নেতাদের আমন্ত্রণ জানানোর চিঠিতে লেখা হয়েছে ‘প্রেসিডেন্ট অব ভার ‘ কথাটি। এরপরেই প্রশ্ন উঠেছে, আচমকা এমন বদলের কারণ কী?

বিরোধী দল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক জয়রাম রমেশ কটাক্ষ করেছেন, তাহলে যেটা শুনেছিলেন, সেটাই সত্যি? এরপরেই, সরকারি নথিতে বদলে গিয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পদের পরিচয়লিপি। তবে তাৎপর্যপূর্ণভাবে সরকারি ঘোষণাপত্রে নয়, শাসকদল বিজেপির দেওয়া সরকারি তথ্যে।
বিজেপি নেতা সম্বিত পাত্র এক্স হ্যান্ডলে প্রধানমন্ত্রী মোদীর আসন্ন ইন্দোনেশিয়া সফরের ঘোষণা সংক্রান্ত একটি সরকারি নথি প্রকাশ করেছেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পদ লেখা হয়েছে প্রাইম মিনিস্টার অব ভারত। যদিও সরকারি প্রথা অনুযায়ী তাঁর পদটিকে প্রাইম মিনিস্টার অব ইন্ডিয়া লেখা হয়। ৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ইন্দোনেশিয়ায় যাওয়ার কথা রয়েছে ২০তম আশিয়ান-ইন্ডিয়া শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে। সরকারি নথিতে অবশ্য ওই সম্মেলনের নামের ক্ষেত্রে ইন্ডিয়া শব্দটি রাখা হয়েছে। এক্ষেত্রে কূটনৈতিক বিভ্রাট এড়াতেই এই পদক্ষেপ বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও সরকারিভাবে এখনও এই বিষয়ে কোনও ব্যাখ্যা দেওয়া হয় নি।

‘ইন্ডিয়া' বনাম ‘ভারত’ নিয়ে মন্তব্য করার বিষয়ে সতর্কতা বজায় রাখতে হবে, দলের মন্ত্রীদের এমনই নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এই সংক্রান্ত সংবিধান সংশোধনী বিল পাশের জন্যই ১৮-২২ ডিসেম্বর সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকা হয়েছে বলেও জল্পনা বাড়ছে। এই আবহে বৈঠক করেছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। সূত্রের খবর বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, ইন্ডিয়া' বনাম 'ভারত' বিষয়টি নিয়ে সব নেতার কথা বলার কোনও প্রয়োজন নেই। যারা এই সংক্রান্ত বিষয়ে বিবৃতি দেওয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত তাদেরও সতর্কভাবে মন্তব্য করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। বিজেপি সূত্রের খবর, জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের আগে মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নির্দেশ, ইতিহাস ঘাঁটতে যাবেন না মন্ত্রীরা। কিন্তু, ভারতীয় সংবিধান অনুসরণ করে বাস্তব অবস্থা তুলে ধরতে হবে। সমসাময়িক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে হবে তাদের।
প্রসঙ্গত, জি-২০ শীর্ষ বৈঠকে অংশ নেওয়া বিদেশি রাষ্ট্রনেতাদের কাছে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর নৈশভোজের আমন্ত্রণপত্র প্রকাশ্যে আসার পরেই জল্পনা শুরু হয়, লোকসভা ভোটের আগে দেশের নাম শুধুই ‘ভারত’ করতে চলেছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। এদিকে, সংবিধানেই উল্লেখ আছে ‘ইন্ডিয়া’ মানেই ভারত। এই পরিপ্রেক্ষিতে, বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেছেন, সংবিধানেই ভারত শব্দটির উল্লেখ রয়েছে। সংবিধানে লেখা ইন্ডিয়া, যা হচ্ছে ভারত। তাই এটা সংবিধানেই রয়েছে।

বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের মতে, এটা আরও আগেই হওয়া উচিত ছিল। এতে মনে দারুণ তৃপ্তি এনে দেয়। ভারত-ই হচ্ছে সবার মুখ্য পরিচয়। দেশবাসী এর জন্য গর্বিত। রাষ্ট্রপতিও এই ভারত'কে গুরুত্ব দিয়েছেন। ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে এটা একটা বড় পদক্ষেপ। অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর বলেছেন, সংসদের বিশেষ অধিবেশনে যে ইন্ডিয়া-র নাম পাল্টে ভারত করার জন্য বিশেষ প্রস্তাব করা হবে বলে যে আলোচনা চলছে, তা পুরোপুরি ভিত্তিহীন। কারণ, খবরটি পুরোপুরি গুজব।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি দেশের বিজেপি বিরোধী দলগুলি যে জোট তৈরি করেছে তার নাম দেওয়া হয়েছে ইন্ডিয়া। তাতে কংগ্রেস, তৃণমূল, শিবসেনা (উদ্ধব শিবির), এনসিপি, এসপি, জেডিইউ, ডিএমকের মতো একাধিক বিজেপি-বিরোধী দল রয়েছে। প্রথমে পাটনা, তার পর বেঙ্গালুরু হয়ে ইন্ডিয়ার নেতারা সম্প্রতি মুম্বইয়েও বিশদে আলোচনা সেরেছেন। তৈরি হয়েছে সমন্বয় কমিটিও। আগামী লোকসভা ভোটে ইন্ডিয়া মোদীর বিজেপিকে কড়া টক্করের মুখে ফেলতে চলেছে বলে বিশ্বাস বিরোধী নেতাদের। চুপ নেই বিজেপিও। ইন্ডিয়া নামটি নিয়ে একাধিকবার সরাসরি কটাক্ষ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তাতে গলা মিলিয়েছেন বিজেপির তাবড় নেতারাও। এ বার কি সেই ইন্ডিয়া নাম বদলে দেশের নাম শুধুমাত্র ভারত করার লক্ষ্যে হাঁটতে শুরু করল নরেন্দ্র মোদী সরকার? জল্পনা তাই বাড়ছে।
অন্যদিকে, ইন্ডিয়া শব্দটিকে সংবিধান থেকে সরিয়ে দেওয়া উচিত, এমনই মন্তব্য করেছেন বিজু জনতা পার্টি। বিজেডি সাংসদ ভর্তৃহরি মহতাব বলেছেন, ভারতের অর্থ হল, জ্ঞানের নিরন্তন সাধনার দেশ। তাই দেশকে ভারত হিসেবে উল্লেখ করা উচিত। ভারত একটি প্রাচীন নাম। অন্যদিকে, ব্রিটিশ শাসনকালে ইন্ডিয়া নামের উৎপত্তি হয়েছিল। যার কোনও অর্থ নেই। শ্রীলঙ্কা-মায়ানমারের মতো দেশগুলি তাদের ঔপনিবেশিক নামগুলি অনেক আগেই পরিবর্তন করে ফেলেছে। এবার দেশের নাম পরিবর্তনের উপযুক্ত সময় এসেছে।

পাল্টা হিসাবে, তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ইন্ডিয়া বনাম ভারত হল বিজেপির দ্বারা সংগঠিত একটি বিভ্রান্তি মাত্র। আকাশ ছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব, সীমান্ত সংঘাত নিয়ে ডবল ইঞ্জিন সরকারের বিরুদ্ধে সরব হতে সবাইকে। এর আগে, দেশের নাম ইন্ডিয়ার পরিবর্তে পাকাপাকিভাবে ভারত করে দেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছে, অভিযোগ করে প্রশ্ন তুলেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেছেন, ইন্ডিয়া নাম বদলে দেওয়া হচ্ছে। ভারত তো সবাই বলে, এতে নতুন কী আছে। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, হঠাৎ করে কী হল যে, দেশের নাম বদলে দেওয়া হবে। আমরা তো ইংরেজিতে বলি ইন্ডিয়া আর হিন্দিতে বলা হয় ভারত কা সংবিধান। সবাই বলে ভারত আমার ভারতবর্ষ, স্বদেশ আমার স্বপ্ন গো। কিন্তু, তা বলে ইন্ডিয়া নাম ত্যাগ করতে হবে? ঐ নামে তো সারা বিশ্ব চেনে?
এখন ঘটনা হলো ইন্ডিয়া’র পরিবর্তে বাধ্যতামূলকভাবে ভারত নামে দেশকে চিহ্নিত করার আবেদন জানিয়ে দায়ের করা একটি জনস্বার্থ মামলা সাত বছর আগে খারিজ করে দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। আর তা করেছিল নরেন্দ্র মোদী সরকারের সম্মতিতেই। নিরঞ্জন ভটওয়াল নামে মহারাষ্ট্রের এক ব্যক্তি ২০১৫ সালে ইন্ডিয়া নাম বাতিল করে কেবলমাত্র ভারত নামটিকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিতে জনস্বার্থ মামলা করেছিলেন। কিন্তু সেই সময়, সুপ্রিম কোর্টের তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি টিএস ঠাকুর এবং বিচারপতি ইউইউ ললিত সেই আবেদন খারিজ করে দেন। ২০১৬ সালের ওই মামলার রায় ঘোষণা করতে শীর্ষ আদালত জানিয়েছিল, দেশের প্রতিটি নাগরিকের ইন্ডিয়া এবং ভারত দু’টি নামই ব্যবহারের অধিকার রয়েছে। ঘটনাচক্রে ওই রায়ের আগে ২০১৫-এর নভেম্বরে সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছিল, ভারতীয় সংবিধানের ১ নম্বর অনুচ্ছেদে, ইন্ডিয়া এবং ভারত দু’টি নামই রয়েছে। তার পরিবর্তন ঘটনোর প্রয়োজন নেই।
আর, 'ইন্ডিয়া' না 'ভারত' নিয়ে বিতর্কের আবহে বিখ্যাত অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন এক্স পোস্টে বলেছেন, ভারতমাতা কী জয়। যা নিয়ে নতুন করে জল্পনা শুরু হয়েছে। গত সপ্তাহেই ইন্ডিয়া জোটের বৈঠকে যোগ দেওয়ার আগে অমিতাভ বচ্চন-জয়া বচ্চনের বাড়ি জলসায় গিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এরপরেই অমিতাভ বচ্চনের পোস্ট দেখে অনেকেই মনে করছেন, ভারত প্রসঙ্গে অভিনেতার এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত ভিন্ন। অন্যদিকে, ইন্ডিয়া-ভারত নিয়ে স্পষ্ট মত প্রকাশ করেছেন প্রাক্তন ভারতীয় ব্যাটসম্যান বীরেন্দ্র সেহওয়াগ। এক্স হ্যান্ডলে জানিয়েছেন, এই দেশের আসল নাম ভারত। আনুষ্ঠানিকভাবে সেই নাম ফিরিয়ে আনার সময় এসে গিয়েছে। দেশের নাম এমন হওয়া উচিত যা সবাইকে গর্বিত করবে। সবাই ভারতীয়। ইন্ডিয়া নাম ব্রিটিশদের দেওয়া। দেশের আসল নাম ভারত। বীরেন্দ্র সেহওয়াগ বিসিসিআই এবং জয় শাহকে অনুরোধ করছেন যাতে আসন্ন বিশ্বকাপে ভারতীয় খেলোয়াড়দের জার্সিতে ভারত লেখা থাকে।

এসবিএস বাংলার অনুষ্ঠান শুনুন রেডিওতে, এসবিএস বাংলা অডিও অ্যাপ-এ এবং আমাদের ওয়েবসাইটে, প্রতি সোম ও শনিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে ৭টা পর্যন্ত।

রেডিও অনুষ্ঠান পরেও শুনতে পারবেন, ভিজিট করুন: 

আমাদেরকে অনুসরণ করুন 

Share
Published 7 September 2023 9:48pm
Updated 7 September 2023 9:57pm
By Partha Mukhopadhyay
Source: SBS

Share this with family and friends