Explainer

নরেন্দ্র মোদীকে নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্র নিষিদ্ধ করেছে কেন ভারত

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে বিবিসির একটি তথ্যচিত্র নিষিদ্ধ করা হয়েছে ভারতে। এ কারণে বৃহৎ সামাজিক-যোগাযোগ-মাধ্যম টুইটার এবং ইউটিউব তাদের সাইট থেকে লিঙ্কগুলি সরাতে বাধ্য হয়েছে।

A man speaking at a podium waving his finger

Indian Prime Minister Narendra Modi. Source: AP / Rafiq Maqbool

গুরুত্বপূর্ণ দিক:
  • বিবিসি’র ডকুমেন্টারি ‘ইন্ডিয়া: দ্য মোদি কোয়েশ্চেন’ নিষিদ্ধ করেছে ভারত সরকার।
  • টুইটার এবং ইউটিউবকে তাদের সাইট থেকে ফুটেজ অপসারণ করতে বাধ্য করার জন্য জরুরি ক্ষমতাও ব্যবহার করেছে দেশটির সরকার ৷
  • ফিল্মটি প্রদর্শনের চেষ্টাকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আটক করা হয়েছে এবং তাদের ওপরে হামলা করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে নিয়ে বিবিসির একটি তথ্যচিত্রের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়েছে ভারতে; যার অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন এবং এ বিষয়ক টুইটার লিঙ্কগুলো সেন্সর করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

ভারতের সরকার গত শনিবার দেশটির বিতর্কিত তথ্য প্রযুক্তি আইনের অধীনে তার জরুরি ক্ষমতা ব্যবহার করে দুই-পর্বের ডকুমেন্টারি "ইন্ডিয়া: দ্য মোদি কোয়েশ্চেন"-এর ফুটেজ সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করা থেকে ব্লক করে দেয়।

গার্ডিয়ান জানিয়েছে, প্রায় ৫০টি টুইটার অ্যাকাউন্টের তথ্যচিত্রের লিঙ্ক সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া একটি অনির্দিষ্ট সংখ্যক ইউটিউব চ্যানেলের লিঙ্কও সরিয়ে দেয়া হয়েছে।

সোশ্যাল মিডিয়া জায়ান্টদের এই সম্মতিকে অধিকার কর্মীরা সমালোচনা করেছে, বিশেষত, যেখানে টুইটারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এলন মাস্ক নিজেকে একজন "নিরঙ্কুশ" বাক স্বাধীনতার প্রচারক হিসেবে বর্ণনা করেন এবং এই প্ল্যাটফর্মের পূর্ববর্তী মালিকরা কন্টেন্ট সংক্রান্ত বিষয়ে মার্কিন সরকারের দাবির প্রতি নতি স্বীকার করেছে বলে অভিযোগ করেন।
A man waving a flag
Police detain an activist outside the Jamia Millia Islamia university in New Delhi, India, Wednesday, January 25, 2023. Source: AP / Manish Swarup
নয়াদিল্লির একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ-মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়াতে ব্রিটিশ সম্প্রচার সংস্থার নির্মিত ওই ডকুমেন্টারি স্ক্রীনিংয়ের পরিকল্পনার আগে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য কিছু ভারতীয় ছাত্রকেও আটক করা হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা পরে বলেছিলেন যে, অনুমতি ছাড়া কোনও চলচ্চিত্র প্রদর্শনের অনুমতি দেওয়া হয় নি।

জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়াদিল্লি ক্যাম্পাসের ছাত্রছাত্রীরা মঙ্গলবার রাতে ছবিটি দেখানো থেকে বিরত রাখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দেওয়ার অভিযোগ করেন। কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, তাদের দিকে ঢিলও ছোড়া হয়।

তথ্যচিত্রটি কী নিয়ে?

বিবিসি ডকুমেন্টারিতে গুজরাট স্টেটের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদির শাসনকালে ২০০২ সালের মারাত্মক দাঙ্গার সময়ে তার কার্যকলাপ বিস্তারিত এবং সতকর্তার সাথে অনুসন্ধান করা হয়েছে। ওই দাঙ্গায় অন্তত এক হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল, যাদের অধিকাংশই সংখ্যালঘু মুসলিম।

একটি ট্রেনে অগ্নিকাণ্ডে ৫৯ জন হিন্দু তীর্থযাত্রী নিহত হওয়ার পর দাঙ্গা শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে অভিযোগ করা হয়, মুসলিম বিক্রেতারা ট্রেনটি পুড়িয়ে দিয়েছে কিন্তু পরে দেখা যায় অগ্নিকাণ্ডের বিষয়টি ছিল নিছক দুর্ঘটনা।

এই ট্র্যাজেডির পর ডান-পন্থী হিন্দু জনতা মুসলিমদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে লক্ষ্যবস্তু করে, যেখানে অন্তত এক হাজার মানুষ নিহত হয়। আক্রমণকারীদের মধ্যে ১১ জন পুরুষকে বিলকিস বানো নামে একজন গর্ভবতী মুসলিম মহিলাকে গণধর্ষণ এবং তিন বছরের মেয়েসহ ওই নারীর পরিবারের ১৪ সদস্যকে হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
An old photo showing a large group of men picking up rocks and throwing them
Men pelting stones during the Gujarat riots in 2022. Source: Getty / Dipam Bhachech
মি. মোদি একজন হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতা। ডকুমেন্টারিতে অভিযোগ করা হয়েছে যে, কয়েকদিন ধরে চলা ওই সহিংসতার সময়ে তিনি পুলিশকে চোখ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সূত্রের বরাত দিয়ে বিবিসি ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্বের গোপন একটি প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে বলেছে যে, মোদি ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করেছেন এবং মুসলিম বিরোধী সহিংসতায় তাদের 'হস্তক্ষেপ না করার নির্দেশ দিয়েছেন'।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সহিংসতা ছিল 'রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত' এবং লক্ষ্য ছিল 'হিন্দু এলাকা থেকে মুসলমানদের নির্মূল করা'। 

প্রতিবেদনের উপসংহারে বলা হয়েছে, 'সহিংসতার পরিকল্পিত অভিযানে জাতিগত নির্মূলের সমস্ত বৈশিষ্ট্য রয়েছে' এবং 'স্টেট গভর্নমেন্টের তৈরি দায়মুক্তির পরিবেশ ছাড়া'...এটি (সহিংসতা) অসম্ভব ছিল...'(যেখানে) নরেন্দ্র মোদী সরাসরি দায়ী'।

মি. মোদি ২০০১ থেকে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন এবং ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার আগে পর্যন্ত ওই সহিংসতার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার মধ্যে ছিলেন।
A man sitting in the front passenger seat of a car looking at the camera
Narendra Modi (then Chief Minister of Gujarat) heading to riot affected areas in Ahmedabad Gujarat India on 28 February 2002. Source: Getty / Dipam Bhachech
তবে দাঙ্গা থামাতে তিনি যথেষ্ট কাজ করেন নি বলে যে অভিযোগ আছে তা তিনি অস্বীকার করেছেন।

সহিংসতায় মি. মোদী এবং অন্যদের ভূমিকা তদন্তের জন্য ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত একটি বিশেষ তদন্তকারী দল ২০১২ সালে বলেছিল যে, তারা তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য কোনও তথ্য-প্রমাণ খুঁজে পায় নি।

ভারত কেন ডকুমেন্টারিটি নিষিদ্ধ করেছে?

ভারত সরকার বলেছে যে, তারা বিবিসি ডকুমেন্টারির লিঙ্ক শেয়ার করার ভিডিও এবং টুইটগুলো ব্লক করেছে। তারা এটিকে 'বিদ্বেষমূলক প্রচারণা এবং ভারতবিরোধী আবর্জনা' বলে অভিহিত করেছে।

সরকারের উপদেষ্টা কাঞ্চন গুপ্তা শনিবার টুইট করে বলেছেন যে, ভারত সরকার এই তথ্যচিত্রটি এবং এর ক্লিপগুলোকে সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করা থেকে বিরত রাখতে আইটি নীতিমালার অধীনে জরুরি ক্ষমতা ব্যবহার করেছে।

টুইটে বলা হয়, 'বিবিসি ওয়ার্ল্ডের শত্রুতামূলক প্রচারণা এবং ভারতবিরোধী আবর্জনা, ইউটিউবে 'ডকুমেন্টারি'র ছদ্মবেশে ভিডিও শেয়ার করা এবং বিবিসি ডকুমেন্টারির লিঙ্ক শেয়ার করা টুইটগুলো ভারতের সার্বভৌম আইন ও নিয়মের অধীনে ব্লক করা হয়েছে'।

মি. গুপ্তা বলেছেন যে, একাধিক মন্ত্রণালয় ডকুমেন্টারিটি পরীক্ষা করেছে এবং 'এটি ভারতের সুপ্রিম কোর্টের কর্তৃত্ব এবং বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে, বিভিন্ন ভারতীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভাজনের বীজ বপন করেছে এবং অপ্রমাণিত অভিযোগ করেছে'।
A man wearing a white shirt and chequered vest waves
Indian Prime Minister Narendra Modi. Source: AAP
'বিবিসি ওয়ার্ল্ডের এই জঘন্য প্রোপাগান্ডা ভারতের সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতাকে ক্ষুণ্ন করছে এবং বিদেশীদের সাথে ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরে জনশৃঙ্খলার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে বলে প্রমাণিত হয়েছে,' তিনি বলেন।

বিবিসি বলেছে যে, ডকুমেন্টারিটি 'নিবিড় গবেষণা' করে নির্মিত হয়েছে এবং এতে বিভিন্ন ব্যক্তি এবং বিশেষজ্ঞদের মতামত যুক্ত করা হয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, 'আমরা ভারত সরকারকে সিরিজে উত্থাপিত বিষয়গুলো নিয়ে উত্তর দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলাম - তবে তারা প্রতিক্রিয়া জানাতে অস্বীকার করে'।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে যে, ডকুমেন্টারিটি ব্লক করা 'প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের সমালোচনা আটকানোর সর্বশেষ প্রচেষ্টা মাত্র'।

সংস্থাটি থেকে বলা হয়েছে যে, 'মোদি সরকার মুসলমানদের বিরুদ্ধে বৈষম্যমূলক আইন ও নীতি গ্রহণ করেছে এবং স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলিকে আটকানোর চেষ্টা করেছে। এটি সমালোচকদের জেলে দেওয়ার জন্য প্রায়ই কঠোর আইন ব্যবহার করেছে'।

With additional reporting by AFP.

এসবিএস বাংলার অনুষ্ঠান শুনুন রেডিওতে, এসবিএস বাংলা রেডিও অ্যাপ-এ এবং আমাদের ওয়েবসাইটে, প্রতি সোম ও শনিবার 
সন্ধ্যা ৬ টা থেকে ৭ টা পর্যন্ত। রেডিও অনুষ্ঠান পরেও শুনতে পারবেন, ভিজিট করুন: 

আমাদেরকে অনুসরণ করুন 

Share
Published 1 February 2023 4:18pm
Updated 1 February 2023 4:37pm
Presented by Shahan Alam
Source: SBS


Share this with family and friends