২০২২ সালটি ছিল ভয়াবহ বন্যা ও ইন্টারস্টেলার আবিষ্কারের বছর। এবং অবশেষে এই বছরেই পৃথিবীর মানুষ গত তিন বছর ধরে আমাদের বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারকারী করোনা ভাইরাস সাথে নিয়ে বাঁচতে শিখেছে।
কোভিড-১৯
এই বছর অস্ট্রেলিয়া কোভিড-১৯ মহামারীর অনেক প্রতিকূলতা অতিক্রম করা শুরু করে। যেমন, অনেক বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়, অতিরিক্ত বুস্টার টিকা সরবরাহ করা হয় এবং বাধ্যতামূলক আইসোলেশনের সময়সীমা সংক্ষিপ্ত করা হয়, যা পরবর্তীতে সম্পূর্ণরূপে বাতিল করা হয়।
তবে একই সাথে ২০২২ সালটি অস্ট্রেলিয়ার জন্য মহামারীর সময়কালীন সবচেয়ে প্রাণঘাতী বছর ছিল। কারণ এই সময়েই ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। মূল ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা হ্রাস পাবার কারণে অন্যান্য নতুন স্ট্রেনগুলি বেশি ছড়িয়ে পড়ে।
READ MORE
নতুন এসবিএস রেডিও অ্যাপ ডাউনলোড করুন
সায়েন্স মিডিয়া সেন্টারের ড: জো মিল্টন আমাদের মনে করিয়ে দেন যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার বৈশিষ্ঠ্যই ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টকে এত চ্যালেঞ্জিং করে তুলেছে।
এর ফলে অস্ট্রেলিয়া জুলাই মাসে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ১০ হাজার মৃত্যুর ভয়াবহ মাইলফলক অতিক্রম করে।
ক্যারোলিন কক্স এ বছরের শুরুর দিকে এসবিএস নিউজকে বলেছিলেন যে তার বাবা জ্যাক মুলোস, যিনি জানুয়ারিতে কোভিডে প্রাণ হারিয়েছিলেন, মৃত্যুর আগে তাঁর ইচ্ছা ছিল, প্রিয়জনের সান্নিধ্যে শেষ মূহুর্ত কাটানো, যা সম্ভব হয়নি।
মাঙ্কিপক্স
আর কোভিড-১৯-এর গভীর ক্ষতের পর অনেক অস্ট্রেলীয় নাগরিকই আশঙ্কা করেছিলেন যে, আফ্রিকা থেকে আমাদের দেশে একটি নতুন রোগ ছড়িয়ে পড়ার খবর আরেকটি মহামারীর দিকে আমাদের নিয়ে যেতে পারে।
মাঙ্কিপক্স, যা ১৯৭০-এর দশক থেকে বেশ কয়েকটি মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলিতে প্রচলিত ছিল, মে মাসে এটি রূপান্তরের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল।
ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী মাঙ্কিপক্সের কেসের সংখ্যা ৮১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে, যার মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৬০ জনের। অস্ট্রেলিয়ায় ১৪৩ টি নিশ্চিত কেসের সন্ধান মিলেছে।
ড. মিল্টন বলেন, উদ্বেগের কারণ থাকলেও বিজ্ঞানীরা এখনও এই রোগের মহামারী-পর্যায়ের বিস্তার নিয়ে চিন্তিত নন।
জলবায়ু সঙ্কট বাড়ছে
যদিও আমরা এই বছর আরেকটি মহামারী এড়িয়ে যেতে পেরেছি, তবে এই বছরটি আমাদের গ্রহের ভবিষ্যত সম্পর্কে কিছু গুরুতর কিছু সতর্ক-বার্তাও নিয়ে এসেছে, যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে জলবায়ু সঙ্কট।
গত নভেম্বরে জাতিসংঘের COP-27 শীর্ষ সম্মেলনে কয়লা বিদ্যুৎ ও জীবাশ্ম জ্বালানিতে ভর্তুকি বন্ধ করার পূর্ববর্তী প্রতিশ্রুতির অবসান ঘটে, কিন্তু কিছু নেতা এখনও সতর্ক করে যাচ্ছেন।
জাতিসংঘের মহাসচিব‑আন্তোনিও গুতেরেস সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, জলবায়ু সঙ্কট নিয়ে এরকম নিষ্ক্রিয়তা বজায় থাকলে তা বিশ্বব্যাপী বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করবে।
২০২২ সালে গ্রীনহাউস গ্যাসের মাত্রা, সমুদ্রে অম্লের মাত্রা এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে যা নতুন রেকর্ড স্থাপন করেছে।
আবহাওয়া
এদিকে, পর পর তিন বছর লা নিনা জলবায়ুর কারণে, আমরা ফেব্রুয়ারি, মার্চ, মে, জুলাই, অক্টোবর এবং নভেম্বরে অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা দেখতে পেয়েছি, যা অনেক মানুষের জীবনকে বিশৃঙ্খল ও সঙ্কটাপন্ন করে তুলেছে।
লিসমোরের এক বাসিন্দা ফেব্রুয়ারির বন্যায় তার বাড়ি ডুবে যাওয়ার পরে তার পিতামাতার বাড়ির ছাদে ক্যাম্প করে থাকতে বাধ্য হয়েছিল।
বিপন্ন প্রজাতির তালিকাভুক্ত হয়েছে কোয়ালা
এই চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার ঘটনাগুলি অনেক নেটিভ প্রাণীকে আবাসস্থল ছাড়া করেছে এবং আমাদের সবচেয়ে প্রিয় এবং উল্লেখযোগ্য প্রাণীগুলির মধ্যে একটিকে সঙ্কটে ঠেলে দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে।
এই বছরের শুরুর দিকে ফেডারেল সরকার কোয়ালাকে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি বিপন্ন প্রজাতি হিসাবে ঘোষণা করেছিল, বিশেষ করে কুইন্সল্যান্ড, নিউ সাউথ ওয়েলস এবং অস্ট্রেলিয়ান ক্যাপিটাল টেরিটরিতে কোয়ালার সংখ্যা সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
সায়েন্স মিডিয়া সেন্টারের ড: জো মিল্টন বিশ্বাস করেন যে আমাদের এখনও বিলুপ্ত হওয়ার মত পরিস্থিতির আশঙ্কা করা উচিৎ নয়, কারণ এখনও দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়া এবং ভিক্টোরিয়াতে প্রচুর পরিমাণে কোয়ালা রয়েছে।
মৌমাছি বিনাশকারী মাইট
এই বছর অস্ট্রেলিয়ার মৌমাছিগুলো অন্য একটি আক্রমণাত্মক প্রজাতির দ্বারা হুমকির মুখে পড়েছে।
Varroa destructor নামের মাইট জুন মাসে আমাদের সীমানায় প্রবেশ করে। অনেক বছরের সফল প্রতিরোধ ব্যবস্থার কারণে নিউক্যাসলে প্রথম এদের সনাক্ত করা সম্ভব হয়।
এই মাইটগুলি, যা মূলত শ্রমিক মৌমাছিদের খেয়ে ফেলে, সারা বিশ্বের কলোনি কলাপ্স ডিজঅর্ডারের পেছনে তারা অন্যতম প্রধান কারণ বলে সন্দেহ করা হয়। এগুলি বিশ্ব জুড়ে মৌমাছির থাকার জায়গাগুলিকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
সরকার ও কর্তৃপক্ষ সংক্রামিত জায়গাগুলিকে চিহ্নিত করার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে, যার ফলে ৬০০ টি হাইভ এবং লক্ষ লক্ষ সম্ভাব্য সংক্রামিত মৌমাছি ধ্বংস করতে হয়েছে।
এই মাইটগুলি যদি অস্ট্রেলিয়ার বাকি অংশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে তবে এটি অস্ট্রেলিয়ান অর্থনীতিকে প্রতি বছর ৭০ মিলিয়ন ডলার থেকে ১৪.২ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ক্ষতি করতে পারে, কারণ ফসল পরাগায়ন প্রক্রিয়ায় মৌমাছিরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
নাসা গ্রহাণু
আক্রমণাত্মক মাইট থেকে শুরু করে গ্রহাণু, ২০২২ সালে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিলুপ্তি প্রতিরোধের ব্যবস্থা দেখা গেছে, এবার নাসা থেকে।
সেপ্টেম্বরে নাসা সফলভাবে গ্রহাণু ডাইমরফাস-কে বিচ্যুত করে যেটিকে ডবল Asteroid Redirection Test মিশন বলে অভিহিত করা হয়।
গ্রহাণুটি যদিও পৃথিবীর সাথে সংঘর্ষের পথে ছিল না, তবে বিশেষজ্ঞদের জন্য এটি একটি পরীক্ষামূলক ক্ষেত্র হিসাবে কাজ করেছিল, যারা পৃথিবী থেকে ১১ মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে একটি নভোযানকে এর সাথে সংঘর্ষের মাধ্যমে সফলভাবে এর গতিপথ বদলে দিতে সক্ষম হয়েছিল।
এই প্রযুক্তি ভবিষ্যতের সম্ভাব্য প্রলয়ঙ্করী ঘটনার মুখে মানবতার বেঁচে থাকা নিশ্চিত করতে সহায়তা করেছে।
শুক্রাণু সংখ্যা হ্রাস পেলেও বিশ্বের জনসংখ্যা ৮ বিলিয়ন ছাড়িয়েছে
গত নভেম্বরে বিশ্বের জনসংখ্যা আট বিলিয়নের মাইলফলক অতিক্রম করে। সাত বিলিয়নে পৌঁছানোর মাত্র বারো বছর পরেই বিশ্বের জনসংখ্যা আরও এক বিলিয়ন বৃদ্ধি পেয়েছে।
তবে, শুক্রাণুর সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাওয়ার কারণে, বর্তমানে অনুমান করা হচ্ছে যে ২০৮০ এর দশকে বিশ্বের জনসংখ্যা ১০.৪ বিলিয়ন হয়ে যাবার পরে তা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাওয়া শুরু করবে।
ড. জো মিল্টন বলেন, আমরা দেখতে পাচ্ছি শুক্রাণুর সংখ্যা নাটকীয়ভাবে হ্রাস পাচ্ছে।
যদিও বিজ্ঞানীরা এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতির কারণ খুঁজতে চেষ্টা করে চলেছেন, তবে ধারণা করা হচ্ছে যে অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা এটির পেছনে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।
এদিকে যখন বিশ্বের অনেক বিজ্ঞানী নক্ষত্রের কাছে পৌঁছে গিয়ে এই প্রজন্মের আসন্ন প্রতিকূলতার সমাধান করার চেষ্টা করছেন, তখন কেউ কেউ মনোযোগ দিচ্ছেন আরও হালকা ব্যাপারগুলোয়।
গোল্ডফিশ মাছ শিখেছে কীভাবে ছোট গাড়ি চালাতে হয়
২০২২ সালের জানুয়ারী মাসে ইসরায়েলি কয়েকজন বিজ্ঞানী কিছু অপ্রচলিত চালকের জন্য নতুন ধরণের যানবাহন তৈরি এবং পরীক্ষা করেছেন। সেই চালকেরা হচ্ছে আসলে গোল্ডফিশ।
মাছগুলি তাদের ফিশ-অপারেটেড ভিহিকলস বা এফ-ও-ভিস চালাবে যে দিকে তারা গাড়িটিকে নিয়ে যেতে চায় সেই দিকে সাঁতার কেটে।
গবেষকরা, যারা অপরিচিত পরিবেশে প্রাণীরা কীভাবে দিক খুঁজে নেয় তা নিয়ে গবেষণা করছিলেন, তারা অবাক হয়ে দেখলেন গোল্ডফিশ মাছেরা তাদের গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য অসংখ্য বাধা অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছিল।
মানুষের মস্তিষ্কের কোষেরা পং খেলছে
কেবল ইসরায়েলি গোল্ডফিশেরাই খবরের শিরোনাম হওয়ায় এগিয়ে ছিল এমনটা নয়, কারণ বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে সৃষ্ট মস্তিষ্ক কোষকে অনেক পুরনো একটি ভিডিও গেম খেলা শিখিয়ে দিয়েছেন।
অস্ট্রেলীয় বিজ্ঞানীরা তাদের ইউকে এবং ক্যানাডিয়ান বন্ধুদের এই "ডিশব্রেইন" নামের কোষগুলি সৃষ্টি করে সহায়তা করেছেন, যেটি মূলত একটি ৮ লক্ষ কোষের তৈরি মস্তিষ্ক, যেটিকে তারা ভিডিও গেম পং কীভাবে খেলতে হয় তা শিখিয়েছিলেন।
ভিডিও গেম খেলা ছাড়াও বিজ্ঞানীরা আশা করছেন যে এই "ডিশব্রেইনগুলি" প্রাণীদের পরিবর্তে মানুষের উপরে চিকিৎসার পরীক্ষা চালানোর জন্যে নতুন দরজা খুলে দিতে পারে।
সুতরাং, ২০২২ সাল বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর ছিল, যে-সময়ে অদ্ভুত আবিষ্কার হয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি ঘটেছে এবং সম্ভাব্য বিপর্যয় সম্পর্কে ভয়ানক সতর্ক-বার্তা গোচরে এসেছে।
আসন্ন ২০২৩-এও আমাদের সাথেই থাকুন, কারণ এসবিএস নিউজ আগামীর সব প্রধান বৈজ্ঞানিক খবর নিয়ে আসবে আপনাদের কাছে।
এসবিএস বাংলার অনুষ্ঠান শুনুন রেডিওতে, এসবিএস বাংলা রেডিও অ্যাপ-এ এবং আমাদের ওয়েবসাইটে, প্রতি সোম ও শনিবার সন্ধ্যা ৬ টা থেকে ৭ টা পর্যন্ত। রেডিও অনুষ্ঠান পরেও শুনতে পারবেন, ভিজিট করুন: