কোরবানি: উদ্বেগ-উত্তেজনা-আশঙ্কা ভারতে

কোরবানির ঈদে মুসলমানদের ছাগল কোরবানি দেওয়া উচিত বলে মনে করেন ভারতের তেলেঙ্গানার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী।

An Indian Hindu devotee offers prayers to a sacred cow

An Indian Hindu devotee offers prayers to a sacred cow on the eve of Gopastami in Hyderabad October 31, 2014. Source: NOAH SEELAM/AFP/Getty Images

এবারের ঈদুল আজহায় মুসলমানদেরকে কোরবানি দিতে নিষেধ করেছেন দক্ষিণ ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, গরু কোরবানি দিলে হিন্দু ভাবাবেগে আঘাত করা হবে। কারণ, তারা গরুকে দেবতা হিসেবে পূজা করে। তাই, দেশের একটা বিরাট অংশের মানুষের ভাবাবেগে আঘাত দিয়ে গরু কোরবানি করা উচিত নয়। সেজন্য এবারের ঈদুল আজহায় বা কোরবানির ঈদে মুসলমানদের ছাগল কোরবানি দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তেলেঙ্গানার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী। টিআরএস বা তেলেঙ্গানা রাষ্ট্রীয় সমিতির সদস্যপদ গ্রহণের অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেছেন।

এবারের ঈদে গরু কোরবানি দেওয়াকে কেন্দ্র করে তেলেঙ্গানায় কোনো অশান্তি ও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি চান না বলে জানিয়ে রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেছেন, গরু কোরবানিকে কেন্দ্র করে রাজ্যে কোথাও যদি অশান্তি হয় তাহলে পুলিশ তা কড়া হাতে দমন করবে। এই প্রসঙ্গে, রাজ্যে সম্প্রীতির উদাহরণ হিসেবে ঐতিহাসিক চার মিনারের কথা উল্লেখ করেছেন তেলেঙ্গানার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী। তিনি বলেছেন, হায়দ্রাবাদের বিখ্যাত চার মিনার হিন্দু, মুসলমান, শিখ ও খ্রিস্টানদের ঐক্য ও সম্প্রীতির প্রতীক। চার মিনারের চারটি পিলার এই চার ধর্মের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
Cattle Smuggling: Illegal And Highly Profitable Trade Between India And Bangladesh
Cattle Smuggling: Illegal and highly profitable trade between India and Bangladesh in border area on 22 September 2016. Source: Masfiqur Sohan/NurPhoto via Getty Images
অন্যদিকে, এবারের ঈদুল আজহার বা কোরবানির ঈদের আগে গরু নিয়ে উত্তর প্রদেশে বিবাদ অব্যাহত। বারাবাঙ্কির এক বিজেপি নেতা রঞ্জিত শ্রীবাস্তব গরুর ধর্মও নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, গরু মুসলিম নয়, হিন্দু ধর্মের। তাই এর শেষকৃত্য হিন্দু রীতি অনুযায়ীই হওয়া উচিত। জানা যাচ্ছে, গরু নিয়ে বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে ঐ নেতা বলেছেন, হিন্দু রীতিনীতি এবং বৈদিক রীতি অনুযায়ী যেভাবে হিন্দুরা মায়ের শেষকৃত্য করে, শ্মশানে নিয়ে দাহ করে, সেভাবেই গরুর শেষকৃত্য হওয়া উচিত। এই ব্যবস্থা প্রচলিত না হলেও এর সূচনা উত্তর প্রদেশের বারাবাঙ্কি থেকে করা হবে।

বিজেপি নেতা রঞ্জিত শ্রীবাস্তব আরও বলেছেন, বোর্ডে সভাসদদের মাধ্যমে এই প্রস্তাব রাখবেন, যেখানে গরুর জন্য পৃথক শ্মশান-ঘাটের দাবি জানানো হবে। তবে এই পৃথক শ্মশান-ঘাট আবশ্যক নয়। কারণ, হিন্দুরা মায়েদের যখন পৃথক শ্মশান-ঘাটে নিয়ে যায় না, তখন গরুর জন্যও তার প্রয়োজন নেই। কিন্তু, সংখ্যা বেড়ে গেলে এর প্রয়োজন হবে।

এখানেই শেষ নয়। বারাবাঙ্কির বিজেপি নেতা রঞ্জিতের মতে, মুসলমানদের বাড়িতে গরু থাকার অর্থ, ‘লাভ জিহাদ’। তিনি বলেছেন, সরকারের কাছে আবেদন জানাবেন এবং সেই সঙ্গে হিন্দুদের কাছেও আবেদন জানাবেন, যাতে যে-সব মুসলমানের বাড়িতে গরু আছে, সে-সব গরু যেন হিন্দুদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়। কারণ, হিন্দুরা ভাই-বোনদের মুসলমানদের বাড়িতে যাওয়াকে যদি ‘লাভ জিহাদ’ বলে তাহলে গরু বা গো-মাতা মুসলমানদের বাড়িতে থাকলে তাও ‘লাভ জিহাদ’। তাই গো-মাতাকে মুসলমানদের বাড়ি থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে।

এদিকে আবার ডেথ সার্টিফিকেট ছাড়া সৎকার করা যাবে না কোনো গরুর দেহ। ঐ সনদ দাখিল করার পরই গরুর দেহ সৎকারের অনুমতি মিলবে। গরু পাচার রুখতে সম্প্রতি এমনই নিয়ম চালু করেছে ভারতের অর্থনৈতিক রাজধানী বলে পরিচিত মুম্বাইয়ের বৃহম্মুম্বই পুর নিগম। যুক্তি, অনেক সময় শহরের বাইরে মৃত গরুর দেহ মাটি-চাপা দিতে গেলে সাধারণ মানুষ সৎকারকারীদেরকে গরু পাচারকারী ভেবে গণপিটুনি দেয়। এবার সেই বিভ্রান্তি দূর করবে পুর নিগমের এই ডেথ সার্টিফিকেট। এতে গরুটির মৃত্যুর সময় ছাড়াও উল্লেখ থাকবে যে এটির ময়না তদন্তও করা হয়েছে। পশু হাসপাতাল সূত্রের খবর, আপাতত সপ্তাহে ২-৩টি সার্টিফিকেট ইস্যু করতে হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক জানিয়েছেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মৃত গরুর সৎকার করতে গিয়ে অনেকেই সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। তাদেরকে রাস্তায় আটকে রীতিমতো জেরা করা হচ্ছে। এছাড়া, ময়না তদন্তের জন্য গরুর দেহ কাটা হলে গোমাংস পাচারের অভিযোগও তোলা হচ্ছে। এই সমস্ত সমস্যা এড়াতে ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়ার নির্দেশ জারি করেছে মুম্বাইয়ের বৃহম্মুম্বই পুর নিগম, যেখানে গরুটির স্বাভাবিক মৃত্যুর কথা লেখা থাকবে।
Patrolling With India's Cow Protection Vigilantes
Members of a 'cow vigilante' group unload cows to a rescue shelter from a truck that the group group chased down on 8 November 2015 in Ramgarh, Rajasthan, India Source: Allison Joyce/Getty Images
ঠিক এই প্রেক্ষাপটে এবার ভারতে পালিত হতে যাচ্ছে ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ।

দু’মাস আগে দ্বিতীয় বারের জন্য বিজেপি শাসক দল হিসেবে ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থিতি সামান্য হলেও বদলাচ্ছে। উত্তর প্রদেশেই মাহমুদ আখলাকের গণপিটুনিতে মৃত্যু সারাদেশের নজর কেড়ে ছিল, প্রতিবাদ হয়েছিল দেশজুড়ে। তারপরেও রাজস্থান বা মধ্যপ্রদেশে গরু পাচারকারী সন্দেহে পিটিয়ে মারার অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু, তারপর ইস্যু বদলে গিয়ে হয়েছে গণপিটুনি। কোথাও ছেলে ধরা সন্দেহে, কোথাও মোবাইল চোর বলে, কোথাও আবার জয় শ্রী রাম না বলার কারণে।

এটাই আবার গত ক’দিনে অন্য চেহারা নিয়েছে ভারত-বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ-অসম সীমান্তে। কোথাও পাচার আটকাতে পুলিশকে গুলি চালাতে হয়েছে, কোথাও আবার পুলিশই আক্রান্ত। একটা সময় ছিল, যখন রাজনৈতিক বা মানবাধিকার কর্মীরা অভিযোগ তুলতেন, সীমান্তে গরু পাচারকারী সন্দেহে সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বা বিএসএফ গুলি চালিয়েছে নিরীহ গ্রামবাসীদের ওপরে। সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে এবং অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলোর বদৌলতে গরু পাচারের সঙ্গে জড়িত কোটি কোটি টাকার লেনদেন এখন ওপেন-সিক্রেট। যার বখরা নিয়ে মারামারি, খুনোখুনি লেগেই আছে পশ্চিমবঙ্গে। ক’দিন আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা গেছে, বিএসএফ-এর চোখ এড়িয়ে কীভাবে কলাগাছে, গরুর গলা বেঁধে পার করানো হচ্ছে পদ্মা-ভৈরব-জলঙ্গী নদী আর সম্ভাব্য আটক আটকাতে গরুর গলায় বোমা বেঁধে রাখার মতো নৃশংস ঘটনাও ঘটানো হচ্ছে।

আসলে গরুর চাহিদা ক্রমেই বাড়ছ, আর কিছু স্ব-ঘোষিত হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের নজরদারির কারণে এবার কোরবানি ঈদে গরুর দাম আকাশ ছুঁয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে গরু আসে মূলত, হিন্দি বলয় থেকেই, মানি বিহার-উত্তর প্রদেশ থেকেই। আকারেও বড় এবং দামও বেশি। রাজস্থান থেকে উটও আসে। তার দাম আরও বেশি। ধর্মীয় আচরণ মেনে কোরবানির ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে তেমন কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। কিন্তু চোখ রাঙাচ্ছে ঐ বদলে যাওয়া রাজনৈতিক পরিস্থিতি আর স্ব-ঘোষিত অভিভাবকদের আচরণ।

তেলেঙ্গানার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী, বারাবাঁকির বিজেপি নেতা রঞ্জিত শ্রীবাস্তবের কথা, বা বৃহম্মুম্বই পুর নিগমের সিদ্ধান্ত বলে দিচ্ছে, উদ্বেগ-উত্তেজনা থাকছেই, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে।

Follow SBS Bangla on .

Share
Published 8 August 2019 2:05pm
Updated 5 March 2024 11:17am
By Partha Mukhopadhyay
Presented by Sikder Taher Ahmad

Share this with family and friends