Latest

কলকাতা থেকে ভারত জুড়ে রাত দখল মেয়েদের

ভারতের স্বাধীনতা দিবসের মধ্যরাতে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে স্নাতকোত্তর এক মেডিকেলের ছাত্রীকে ধর্ষণ করে খুনের প্রতিবাদে কলকাতা থেকে পশ্চিমবঙ্গের সব জেলাসহ ভারত জুড়ে দেশটির প্রায় সব বড় শহরে পথের দখল নিলেন মহিলারা।

Protest in Kolkata over an alleged rape and murder incident at RG Kar Medical College

epa11549387 Citizens of Kolkata shout slogans against the government as they attend a mass protest over a rape and murder incident that took place at RG Kar Medical College in Kolkata, India, 14 August 2024. The Kolkata High Court on 13 August ruled that a probe into the rape and murder of a doctor during her working hours at RG Kar Medical College must be transferred to the Central Bureau of Investigation (CBI). A postgraduate student was found dead at a seminar hall of the hospital on 09 August, sparking state-wide protest protests and a strike by medical students and doctors. EPA/PIYAL ADHIKARY Source: EPA / PIYAL ADHIKARY/EPA

যে রাতে ভারত স্বাধীন হয়েছিল, সেই রাতেই নারী স্বাধীনতার ডাক দিয়ে পথে নেমেছিলেন মহিলারা। কোথাও মোমবাতি হাতে, কোথাও মশাল বা মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে আরজি করকাণ্ডের প্রতিবাদে গর্জে উঠেছেন তাঁরা। রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে কর্মসূচিতে সামিল হয়েছেন সমাজের সব স্তরের মানুষজন। অভিনেত্রী-গায়িকা-সেলেব থেকে গৃহবধূ, ছাত্র-ছাত্রী থেকে অবসরপ্রাপ্ত, অধ্যাপিকা- ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার সবাই।

এর আগে ১০ আগস্ট রাতে সোশ্যাল মিডিয়ায় ফেসবুক পোস্ট করে ডাক্তারি ছাত্রীকে ধর্ষণ করে খুনের প্রতিবাদে মেয়েদের রাত দখলের আওয়াজ তুলেছিলেন প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনী রিমঝিম সিনহা। সোশ্যাল মিডিয়ায় দৌলতে তা কার্যত জন-আন্দোলনের রূপ নেয়।

নীলচে কালো অন্ধকারে দৃঢ় হয়ে উঠেছে রক্তে-রাঙা মুষ্টিবদ্ধ হাত। তাতে জ্বলজ্বল করছে একটা কাস্তে। পোস্টারে আঁকা মহিলাদের সেই আওয়াজ স্বাধীনতার মধ্যরাতে আছড়ে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে। লাখো লাখো মানুষের ভিড়ে দাবি উঠেছে একটাই নিহত চিকিৎসকের বিচার। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। আন্দোলনকে সর্বাত্মক করতে মেট্রো রেল, ওলা, উবারও পথে ছিল। সব মিলিয়ে চিকিৎসক খুনের আন্দোলন নাড়িয়ে দিয়েছে সারা দেশকে। দাবি একটাই, জাস্টিস ফর আর জি কর।
ওদিকে, কলকাতার মধ্যরাতের মেয়েদের রাত দখলের প্রতিবাদ আছড়ে পড়েছে দিল্লি, বেঙ্গালুরু, মুম্বইয়ে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আর জি কর-কাণ্ডের প্রতিবাদের ঢেউ ভাসিয়ে দিয়েছে ব্রিটেনকেও। আর কত নির্যাতন সইতে হবে, বিচার চাইছে তিলোত্তমা। আরজি কর হাসপাতালে মহিলা চিকিৎসকে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার প্রতিবাদে দেশের প্রায় সব বড় শহরে হাতে মোমবাতি, কালো পোশাক পরে পথে নেমেছে চিকিৎসক থেকে সাধারণ মানুষ। একইসঙ্গে দাবি উঠেছে নারী স্বাধীনতারও। প্রশ্ন উঠেছে রাতে রাস্তায় বের হতে কেন ভয় পেতে হবে মহিলাদের।

কলকাতা সহ-দিল্লি, মুম্বই ও বেঙ্গালুরুতেও বুধবার রাত ১১ টার পর পরই রাস্তায় জমায়েত হতে থাকেন মানুষ। কয়েকবছর আগে দিল্লির নির্ভয়াকাণ্ডের সময় রাজধানীর দখল নিয়েছিল বিক্ষুব্ধ জনতা। সেই দৃশ্যই যেন ফিরেছিল বুধবার মধ্যরাতে। রাজধানীর চিত্তরঞ্জন পার্কে রাত দখল কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছিল অগনিত দিল্লিবাসী। পিছিয়ে ছিল না বাণিজ্য নগরীও। মুম্বইয়ের আন্ধেরি পশ্চিমে ইনফিনিটি মলের সামনেও জমায়েত হয়েছিলেন বহু মানুষ। কলকাতার তরুণীর ন্যায়বিচারের দাবিতে পথে নেমেছিলেন বেঙ্গালুরুর বাসিন্দারাও।

এরই মধ্যে, আর জি করের ঘটনাকে বাংলাদেশ বানানোর চেষ্টা চলছে, বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর জি কর কাণ্ডে উত্তাল রাজ্য-সহ গোটা দেশ। দফায়-দফায় আন্দোলনে নেমেছে সিপিএম-বিজেপি-কংগ্রেস। প্রাক স্বাধীনতার রাতে রাত দখল কর্মসূচি নিয়েছে রাজ্যের মহিলারা।
এমন পরিস্থিতিতে বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের তুলনা টেনেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বলেছেন, বাংলাদেশে একটা ঘটনা ঘটে গেছে। ভেবেছেন সেই ঘটনা টেনে এনে যদি ক্ষমতা দখল করতে পারেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, তাঁর ক্ষমতার মায়া নেই। তাঁর কথায়, আসল খুনিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রবিবার অবধি সময় দিয়েছিলেন। তার আগেই হাইকোর্টের নির্দেশে সিবিআইয়ের হাতে গিয়েছে মামলা।

অন্যদিকে, দোষীদের বাঁচানোর চেষ্টা করছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। আর জি কর-কাণ্ডে বিস্ফোরক কংগ্রেস নেতা এবং লোকসভার নেতা রাহুল গান্ধী। একই সঙ্গে হাথরস, উন্নাওর সঙ্গে এই ঘটনার তুলনাও টেনেছেন তিনি। আরজি কর-এ চিকিৎসক ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় উত্তাল পশ্চিমবঙ্গ-সহ গোটা দেশ, এই আবহে এক্স পোস্টে রাহুল গান্ধী লিখেছেন, কলকাতায় এক জুনিয়র চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের জঘন্য ঘটনায় হতবাক গোটা দেশ। যে ভাবে তাঁর উপর নৃশংস, অমানবিক অত্যাচার হয়েছে, তাতে চিকিৎসক সমাজ এবং মহিলাদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ স্পষ্ট।

এরপরেই রাজ্য প্রশাসনকে নিশানা করে রাহুল গান্ধী বলেছেন, ন্যায়বিচার নিশ্চিত না করে অভিযুক্তকে বাঁচানোর চেষ্টা হাসপাতাল ও স্থানীয় প্রশাসন সম্পর্কে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। এই ঘটনা সকলকে ভাবতে বাধ্য করেছে যে, মেডিক্যাল কলেজের মতো জায়গায় যদি চিকিৎসকেরা নিরাপদ না থাকেন, তাহলে অভিভাবকেরা কোন ভরসায় তাদের মেয়েকে পড়তে পাঠাবেন।

সেই সঙ্গে ২০১২ সালে দিল্লির গণধর্ষণ এবং হত্যা মামলার প্রসঙ্গ তুলে রায়বরেলির কংগ্রেস সাংসদের প্রশ্ন, নির্ভয়া মামলার পর তৈরি হওয়া কঠোর আইনও কেন এই ধরনের অপরাধ বন্ধ করতে ব্যর্থ। হাথরস থেকে উন্নাও এবং কাঠুয়া থেকে কলকাতা পর্যন্ত মহিলাদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান অপরাধের ঘটনার বিষয়ে, প্রতিটি দল এবং সমাজের প্রতিটি অংশকে গুরুত্ব সহকারে এক সঙ্গে আলোচনা করতে হবে এবং দৃঢ় পদক্ষেপ করতে হবে।

এদিকে আর জি কর কাণ্ডে দিনে দিনে আন্দোলনের তীব্রতা বাড়ছে। শাসকদলের, তৃণমূল কংগ্রেসের অভিযোগ, ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছে বিরোধীরা। তার পালটা দিয়ে শনিবার পথে নামতে চলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেদিন বিকেলে আর জি কর ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে পথে নামবেন মুখ্যমন্ত্রী। স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান থেকে দাবি জানিয়েছেন, আগামী তিন দিনের মধ্যে সিবিআইকে চার্জশিট গঠন করে ফাঁসির আবেদন করতে হবে। উল্লেখ্য, এর আগে কলকাতা পুলিশকে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শেষ করতে রবিবার, ১৮ আগস্ট পর্যন্ত সময় দিয়ে রেখেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তার আগেই সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয় কলকাতা হাই কোর্ট।
অন্যদিকে, তাঁকে অসম্মান করলেও, বাংলা মাকে অসম্মান করবেন না, স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালের অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকে এমনই বার্তা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একইসঙ্গে তাঁর হুঁশিয়ারি বাংলাকে অপমান-বদনামের চেষ্টা করা হলে তিনি ছেড়ে কথা বলবেন না। মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদের ঘটনায় তিনি প্রথম থেকেই ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন, কিন্তু এই আন্দোলনের নামে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি ফায়দা তোলার চেষ্টা করছে তা তিনি বরদাস্ত করবেন না।

একইভাবে, আর জি করে প্রিন্সিপাল থেকে শুরু করে যারা যারা এই চক্রান্তের সঙ্গে যুক্ত ছিল বলে খবর এসেছিল তাঁদের ট্রান্সফার করা হয়েছে। আরজি করের নির্দিষ্ট বিভাগের বিভাগীয় প্রধানকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পুলিশের সেই সময় যাঁরা দায়িত্বে ছিলেন, তাঁদেরও ছাত্র-ছাত্রীদের দাবি মেনে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সবকিছু মানা হয়েছে বলে মন্তব্য করে মুখ্যমন্ত্রীর আরও বার্তা, রাজ্য প্রশাসনের হাতে আরজি করের তদন্তভার না থাকলেও, শেষ পর্যন্ত এই তদন্তে যা যা সাহায্য লাগবে তা করা হবে।

কিন্তু, ন্যায় বিচার নয়, বরং, অপরাধীদের বাঁচানোর চেষ্টা করছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। আর জি কর-কাণ্ড নিয়ে বিস্ফোরক অভিযোগ করেছে কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতৃত্ব। মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় রাজ্য পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘নির্মমতা’ বলে আক্রমণ করেছেন বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র গৌরব ভাটিয়া। বিজেপি নেতা বলেছেন, শুরু থেকেই এই মামলায় অপরাধীদের বাঁচানো ও প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা করে গিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিশ। অপরাধের পর প্রথম ৪৮ ঘণ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেই সময়টাকে ব্যবহার করে প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা চলেছে বলে অভিযোগ করেছে বিজেপি।
আরজি করে মহিলা চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনা নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ করেছেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসও। তিনি বলেছেন, আর জি করের ঘটনায় আমাদের বিবেকে একটা ঝাঁকুনি লাগা উচিত। যা ঘটেছে, তা গোটা বাংলার কাছে লজ্জার। দেশ তো বটেই, মানবজাতির কাছেও লজ্জার। এক্স হ্যান্ডলে রাজ্যপালের একটি ভিডিয়ো পোস্ট করা হয়েছে। সেখানেই প্রথম আর জি করের ঘটনায় রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতির সমালোচনা করে রাজ্যপাল বলেছেন, আমাদের দায়িত্ব বাংলা এবং ভারতকে মহিলাদের থাকার জন্য নিরাপদ করে তোলা। এটা বড় দায়িত্ব। যদি এখন আমরা সুযোগ হারাই তবে, ভবিষ্যতে আর নাও পেতে পারি। কোন সুযোগের কথা বলছেন রাজ্যপাল তা অবশ্য তিনি ওই ভিডিয়ো বার্তায় স্পষ্ট করেন নি।

তবে রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস বলেছেন, আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। একজোট হয়ে কাজ করতে হবে। তা হলেই সাফল্য আসবে। কারণ বিবেকানন্দ বলে গিয়েছেন, জাগো, ওঠো, যতক্ষণ না লক্ষ্যে না পৌঁছনো পর্যন্ত থেমো না। এই স্থির সংকল্পই থাকতে হবে আমাদের। নিশ্চিত করতে হবে, আমাদের মেয়েরা যাতে সুরক্ষিত থাকে।

আর বাস্তব হল, মুখ্যমন্ত্রীত্বের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নামও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর এখনো পর্যন্ত দোষী সন্দেহে যাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেও একজন অস্থায়ী পুলিশ কর্মী। যার হাসপাতালে কোন কাজই ছিল না, পোস্টেড্ও নয়। তাহলে ওই ধৃত কেন বা কী করে মেডিকেল কলেজে গেল, প্রশ্নের উত্তর নেই রাজ্য প্রশাসনের কাছে। যাতে বিতর্ক আরও বাড়ছে।

Share
Published 15 August 2024 1:54pm
Updated 15 August 2024 2:14pm
By Partha Mukhopadhyay
Source: SBS

Share this with family and friends