বিশ্বের খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব বড়দিন। যথাযথ ধর্মীয় উদ্দীপনাসহ গির্জায় গির্জায় প্রার্থনা, মেলা, আনন্দ-উৎসবের মধ্যে পালিত হয়েছে দিনটি। ২৫ ডিসেম্বর ভ্যাটিকেন সিটির সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে কয়েক হাজার মানুষের সামনে দেওয়া ভাষণে বিশ্ব শান্তির জন্য প্রার্থনা করেন খ্রিস্টানদের প্রধান ধর্ম যাজক পোপ ফ্রান্সিস। এ সময় তিনি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ, যেমন, সিরিয়া, লেবানন, ইয়েমেন ও ইরাকে চলমান সংঘাত নিরসন করতে শান্তির ডাক দেন। বিশেষত, সিরিয়া-সংকট সমাধান এবং সেখানকার মানুষের কষ্ট লাঘব করার জন্য বিশ্ব-নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে এ দিনটি পালনে বাধা না থাকলেও ব্রুনাই, সৌদি আরব এবং সোমালিয়ায় এ দিনটি পালনে সরকারি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ২০১৫ সালে রক্ষণশীল মুসলিমপ্রধান দেশ ব্রুনাইয়ে বড়দিন পালনে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন দেশটির সুলতান হাসান আল বোলকিয়াহ। নিষেধাজ্ঞায় বলা হয় ক্রিসমাসের কোনো ধরনের সাজসজ্জা, সান্তা ক্লজের টুপি অথবা ক্রিসমাসের শুভেচ্ছাসহ ব্যানার প্রদর্শন করা যাবে না। এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কেউ বড়দিন উদযাপন করলে তাকে ২০ হাজার ডলার জরিমানা অথবা পাঁচ বছরের কারাদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড ভোগ করতে হবে। তবে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীসহ অন্য কেউ পালন করতে চাইলে তা ব্যক্তিগত পরিসরের মধ্যে করতে পারবে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে।মধ্যপ্রাচ্যের আরেকটি মুসলিমপ্রধান দেশ সৌদি আরবে ইসলাম ছাড়া আর অন্য কোনো ধর্মীয় উৎসব পালন করতে দেয়া হয় না। ২০১৩ সালে সৌদি আরবে বড়দিন উদযাপন করার অপরাধে প্রায় ৪০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। অন্যদিকে, সৌদি কর্তৃপক্ষ ২০১৭ সালে হ্যালোউইন পার্টি করার অপরাধে ১৭ জন ফিলিপাইন নাগরিককে গ্রেপ্তার করে।
Pope Francis prays as he celebrates Christmas Eve Mass. Source: AP
মুসলিমপ্রধান দেশ সোমালিয়াতেও ধর্মীয় বিশ্বাস ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এমন আশঙ্কায় বড়দিন উদযাপন করতে দেয়া হয় না। তবে এ ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত এ কারণে কাউকে শাস্তি ভোগ করতে হয় নি। নিষেধাজ্ঞার কারণে সে দেশে অবস্থানকারি খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারীরা ঘরোয়া আয়োজনের মধ্যেই পালন করে বড়দিন। তবে শুধু মুসলিমপ্রধান দেশ নয়, উত্তর কোরিয়াতেও বড়োদিনে কোনো সরকারি ছুটি দেয়া হয় না। দেশটিতে শুধুমাত্র তাদের রাষ্ট্রনায়কের জন্মদিনেই বড় পরিসরে উৎসব পালন করা হয় এবং সরকারি ছুটি দেয়া হয়।
খ্রিস্টানদের একটি বড় অংশের প্রচলিত ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসারে, যিশুর জন্ম দিনেই পালন করা হয় বড়দিন হিসাবে। যিশু পাপের শৃঙ্খলে আবদ্ধ মানুষকে মুক্তির বাণী শুনিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত যিশুকে সে সময়ে একদল বিপথগামীরা ক্রশবিদ্ধ করে হত্যা করে। খ্রিস্টধর্ম প্রবর্তক যিশুকে মুসলমানরাও বিশ্বাস করে। মুসলিম ধর্মমতে, যিশুই হজরত ঈসা (আ.)। আর তার কুমারী মায়ের নাম বিবি মরিয়ম। হজরত ঈসা (আ.) সম্পর্কে পবিত্র কোরআন ও হাদিসে বিশদ বর্ণনা আছে।
এদিকে, যিশুর প্রকৃত জন্মস্থান নিয়ে নতুন তথ্য দিচ্ছে বিজ্ঞানিরা। রাশিয়ার সরকারি সংবাদমাধ্যম স্পুতনিক নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জেরুজালেমের নিকটবর্তী বেথলেহেমে নয়, বরং তার থেকে ১০০ মাইল দূরে লেবানন-সিরিয়া সীমান্তবর্তী নাজারাথের বেথলেহেম অঞ্চলে যিশুখ্রিস্টকে জন্ম দেন তার মা মেরি। কিন্তু, হাজার হাজার বছর ধরে যিশুর প্রকৃত জন্মস্থান অবহেলায় ফেলে রেখে ভুল বেথলেহেম নিয়ে মেতে আছে মানুষ। ফলে ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের কাছে জেরুজালেমের দখল নিয়ে শতাব্দীর পর শতাব্দী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও সহিংসতার ইতিহাস রয়েছে। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দেরও অন্যতম কারণ যিশুর জন্মস্থানখ্যাত এই জেরুজালেম।
ম্যাথিউ ও লুকের বাইবেলে ভৌগোলিক বর্ণনা অনুসারে দুই হাজার বছর আগে পশ্চিম তীরের জেরুজালেম নগরীর বেথলেহেমে এক গোয়ালঘরে জন্ম হয় যিশুর। কিন্তু তা ভুল বলে দাবি করছেন ইতিহাসবিদরা।
এর আগে ২০১৫ সালে বাইবেল বিশেষজ্ঞ মার্কাস বর্গও যিশুর প্রকৃত জন্মস্থান নিয়ে একই ধরনের দাবি করেন। এক লেখায় তিনি জানান, ঐতিহাসিকভাবে দেখলে মনে হয় যিশুর জন্ম হয়েছিল নাজারাথেই। চতুর্থ শতকে রোমান সম্রাজ্ঞী সেইন্ট হেলেনা যিশুর জন্মস্থান বলে পরিচিত ওই জেরুজালেমের বেথলেহেমেই উপাসনালয় তৈরির নির্দেশ দেন। বিজ্ঞানি ও ইতিহাসবিদদের মতে এটি ঘটেছে মূলত এক ঐতিহাসিক ভুল বোঝাবুঝির ফলে। দুটি জায়গার নামই বেথেলহেম হওয়ায় এ ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়।ইসরায়েলের পুরাকীর্তি কর্তৃপক্ষের প্রত্নতাত্ত্বিক ডক্টর আভিরাম অশরিম ১৯৯০ সাল থেকে যিশুর প্রকৃত জন্মস্থানের বিতর্ক নিয়ে কাজ করছেন। তিনিও মনে করেন যিশু নাজারাথের কাছেই জন্ম নেন। বাইবেলে মেরির ছেলেকে ‘গালীলীর যিশু’ বলে উল্লেখ করা হয়। গালীলী অঞ্চলটিও নাজারাথের অংশ বলে ভৌগোলিকভাবে যিশুর জন্মস্থান নাজারেথের বেথেলহেমেই ধরে নেওয়া হয়।
Christmas tree decorations. Source: Pxfuel