ইঞ্জিনিয়ার শফিকুর রহমান অনু, এসবিএস বাংলায় আপনাকে স্বাগতম।
-ধন্যবাদ আপনাকে এবং ধন্যবাদ সকল শ্রোতা ও দর্শকদেরকে।
আবু: ২০১৯ সালের সেই সন্ত্রাসী ঘটনার দণ্ডাদেশের কাজ শুরু হয়েছে এবং কয়েক দিনের মধ্যে রায় দেওয়া হবে। এ নিয়ে সাধারণ জনগোষ্ঠী এবং প্রবাসী বাংলাদেশীদের কী ধরনের অনুভূতি রয়েছে? তারা কী ভাবছে?
অনু: হ্যা, আসলে বিচার-প্রক্রিয়া তো অনেক দিন যাবৎ, নিউ জিল্যান্ডের যে এবং অস্ট্রেলিয়ার যে নিয়ম আপনি জানেন, সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রথম দিকে আপনারা জানেন, সে, এই দোষী ব্যক্তির নামটা আমি উচ্চারণ করতে চাই না। সে প্রথমে দোষ স্বীকার করে নি। পরে নিউ জিল্যান্ড গভার্নমেন্ট তাকে যেভাবে স্কোপ দিয়ে তাদের সাইকোলজিক্যাল ও অন্যান্য আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। তারপর এ বছরের ২৬ মার্চ সে রাজি হলো যে, সে নিজেকে দোষী স্বীকার করবে। এবং তারপরেই তো মামলা একটু অন্য দিকে টার্ন নিল। মানে গভার্নমেন্টের তখন প্রমাণ করাটা ইজিয়ার হয়ে গেল।
সেই নিউ জিল্যান্ড বিচার-প্রক্রিয়া, অস্ট্রেলিয়ান বিচার-প্রক্রিয়া আপনারা জানেন, প্রথমে যদি কেউ দোষী সাব্যস্ত হয়, তখন তাকে দোষী বলা হয়। কিন্তু সে কতোটুকু সাজা পাবে, কী তার সাজা হবে সেটা পরবর্তীতে জানানো হয়।
এর প্রক্রিয়াটা শুরু হচ্ছে ২৪ আগস্ট থেকে, ক্রাইস্টচার্চের হাইকোর্টে শুরু হবে। এবং ধরা হচ্ছে ৩ দিনের মতো চলবে, ৪ দিনের বেশিও লাগতে পারে। এবং সেটা বা সেটার মধ্যে তার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো পড়ে শোনানো হবে, তার বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য থাকলে সে বক্তব্যগুলি শোনা হবে, সবকিছু শোনার পরে এই প্রক্রিয়া যদি চলে তাহলে তিন দিন লাগবে, তার বেশিও লাগতে পারে।
আরেকটা জিনিস, সে গত এই এপ্রিল মাসে সে বলেছে যে, তার এই বিচারে সে কোনো আইনজীবির সাহায্য নিবে না। যদিও নিউ জিল্যান্ড গভার্নমেন্ট তাকে দেশ সেরা কয়েকজন আইনজীবির সাহায্য দিয়েছিল প্রথম থেকে। কিন্তু, যেহেতু সে বলছে, না, তার কোনো আইনজীবির প্রয়োজন নেই।
হ্যা, আপনি যেটা বলছিলেন, এটা শুধু নিউ জিল্যান্ডের বাঙালি, কিংবা নিউ জিল্যান্ডের মুসলিম কমিউনিটি না। সাধারণ নিউ জিল্যান্ডারদের মধ্যে একটা আগ্রহ আছে। আগ্রহটা দেখি কীভাবে? এ বছর যখন সে ১৫ মার্চ, যখন ঘটনাটি ঘটেছিল, নিউ জিল্যান্ড তখন প্রতিটি মসজিদে, এদেশের বিভিন্ন নাগরিকেরা, এসে ফুলের শুভেচ্ছা দিয়ে গেছে এবং আমার সাথে একটু আলাপ-পরিচয় বেশি হয় এই কারণে, ঘটনার পরে আমি প্রথম ক্রাইস্টচার্চে, বিদেশী দূতাবাসগুলোর মধ্যে আমি প্রথম গিয়েছিলাম।অনেকের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় হয়েছে। মিডিয়াগত কারণে পরিচয় হয়েছে।
Mr Shafiqur Rahman Bhuiyan (Anu), Honorary Consul, Bangladeshi Consulate in Auckland, New Zealand. Source: Facebook
তাদেরও উৎসাহ আছে, কিন্তু অতি-উৎসাহ নাই। তাদের কাছেও কিছু ইনফরমেশন পেয়েছি আর আমিও কিছু ডিপ্লোম্যাটিক চ্যানেলে ইনফরমেশন পেয়েছি।
আশা করা যাচ্ছে, আপনি যেটা বলছেন, নিউ জিল্যান্ডের আইনে হত্যাকাণ্ডের সর্বোচ্চ শাস্তি হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। মৃত্যুদণ্ড নেই।
যেটা হচ্ছে যে, এ ট্রায়াল কিন্তু করোনাভাইরাসের যে লকডাউন তখনই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, নিউ জিল্যান্ড গভার্নমেন্ট, হামলায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের প্রতিনিধি বা আত্মীয়-স্বজনকে কোর্টে থাকার সুবিধা দেওয়ার জন্যই করোনাকালীন সময়ে ওরা মামলাটা পিছিয়ে নিয়েছে। এই এখন দিয়েছে। এবং অনেক যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, মারা গেছেন বা আহত হয়েছেন, তাদের প্রতিনিধি থাকবেন। শুনানির সময়ে থাকবেন। তবে খবরগুলো ডাইরেক্টলি প্রচার করা যাবে না।
এই খবরগুলো, বিকৃত করার তো প্রশ্নই ওঠে না। অনেক সেনসিটিভ ইস্যুগুলো যেন আমরা না বলি, যতক্ষণ পর্যন্ত না নিউ জিল্যান্ড কোর্ট এগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ না করে।
তবে, তারা কিছু বিষয়ে আমাকে ইঙ্গিত দিয়েছে, তার যে অভিযোগ, সেসব অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে, নিউ জিল্যান্ডে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড মানে এই না যে, তাকে আজীবন জেলে থাকতে হবে। এটা হচ্ছে তার কার্যক্রম, তার ব্যবহারের ওপর নির্ভর করবে। অনেক সময় ১০ বছর কারাজীবন পরে তাকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়। অনেক সময় ১৫ বছর পর, এবং না-ও হতে পারে। তবে এ পর্যন্ত, নাও হতে পারে এ রকম ঘটনা নাই।
সাধারণত অপরাধ স্বীকার করলে শাস্তি কিছু লঘু হয়। কিন্তু, এবারের এই মামলায় এতোগুলি অপরাধ সে করেছে, লঘু হলেও সে চরম শাস্তি পেতে পারে। এটা আসলে বলা যায় না। তবে এ বিষয়ে আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
আবু: এই ঘটনায় তো অনেক বাংলাদেশী নিহত এবং আহত হয়েছেন। তাদের মতামত কী? কিছু কি আপনি জানতে পেরেছেন?
অনু: তাদের সঙ্গে আমি এখন আলাপ করি নি। আগে আলাপ করেছিলাম। এখন আলাপ করি নি এই কারণে যে, অনেক সেনসিটিভ ইস্যু রয়েছে। তবে, যারা আহত হয়েছেন, তারা সবাই নিজেদের গভার্নমেন্টের পদক্ষেপগুলোতে সন্তুষ্ট। যারা মারা গেছেন তাদের অনেক আত্মীয়-স্বজনকে নিউ জিল্যান্ডের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়েছে। এখানে আসার পর অনেককে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। তারা তাদের প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি কিছু পেয়েছেন। তাদের একটাই দাবি যে, সুবিচার হোক।
এবং আরেক জন আমাদের ভাই, ফরিদ ভাই, তার স্ত্রী যিনি ঘটনাস্থলে মারা গিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, আমি চাই তার চরম শাস্তি না হোক, শাস্তি হলেই যথেষ্ট। তিনি বেশ উদারতার পরিচয় দিয়েছিলেন যে, ‘আমি চাই না তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হোক বা তাকে আজীবন জেল দেওয়া হোক। সে এটা বুঝুক যে সে অন্যায় করেছে। এটাই হলে যথেষ্ট। তাকে চরম শাস্তি দিলেও তো আমি আমার স্ত্রীকে ফিরে পাব না।”
এই কথাটা কিন্তু উনি বেশ কয়েকবার বলেছেন এবং গত বছর সেখানেও বলেছেন। এটা প্রশংসিত হয়েছে। আমরাও প্রশংসা করেছি।
মুসলমানদের প্রত্যাশা এটাই যে, ন্যায্য বিচার হোক। এটাই আমাদের সবার প্রত্যাশা। এবং আমরা আশা করছি, ন্যায্য বিচার আমরা পাব।
আবু: এই ঘটনার পর পর জনমনে যে একটা মানে বিশেষ করে মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে যে একটা ভয়-ভীতি কাজ করছিল, সেই ভয়-ভীতিটা কতোটা কেটেছে?
অনু: খুব সুন্দর প্রশ্ন। হ্যা, ভয়-ভীতি ছিল। এটা আমার দৃষ্টিতে এক দিনই ছিল, প্রথম দিনই ছিল। এটা তো ঘটে শুক্রবার দিন জুম্মার নামাজের ঠিক আগে আগে। পরে সেদিন আমাদেরকে বলা হলো যে, তোমরা মসজিদে যাবে না। আমি তখন অকল্যান্ডে ছিলাম। আমাকে বাংলাদেশ থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপ্রধান বলছিলেন আমাকে সেখানে যাওয়ার জন্য। যেহেতু সমস্ত বিমান-যোগাযোগ বন্ধ ছিল, আমি বাই-রোডে যেতে পারবো কিনা। অনেক কষ্টকর হবে ও সময়-সাপেক্ষ। আমি চেষ্টা করে দেখবো।
ক্রাইস্টচার্চে পরদিন সকালে ফ্লাইট চালু হলো, আমি গেলাম। সকালের ফ্লাইটেই গেলাম। প্রথম বিদেশী মুসলমান রাষ্ট্রদূত হিসেবে আমি গেলাম। ক্রাইস্টচার্চে রাস্তায় আমি লোকজন কম দেখলাম। মুসলমান কম দেখলাম। আমি কয়েক জনের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করলাম। তারা বলল তারা খুব ভীত-সন্ত্রস্ত। এবং বিশেষ করে হিজাব পরা মহিলা, দাঁড়িওয়ালা ভদ্রলোকরা বাসা থেকে বের হন না। কিন্তু, ঐ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটে নি। মুসলমানদের উপর অ্যাটাক তারপর হয় নি। রাস্তায় পুলিশ গার্ড ছিল।
কিন্তু পরের দিন দুপুরবেলায় যখন আমাদের প্রাইম মিনিস্টার গেলেন, একটা অনুষ্ঠানে ঐ খানের, ক্রাইস্টচার্চে। তিনি হিজাব পরে গেলেন। তিনি গিয়ে একাত্মতা প্রকাশ করলেন। সমস্ত কিছু বললেন এবং উনি উনার সম্পূর্ণ সহমর্মিতা প্রকাশ করলেন। তারপর থেকে কিন্তু সিচুয়েশন চেঞ্জ হয়ে গেল।
তখন আমরা মুসলমানরা, আমরা সবাই ভয়-ভীতিহীন পরিবেশে ঘুরাফেরা করছিলাম। যদিও পুরা টাউনটার মধ্যে সশস্ত্র পুলিশ এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনী সচেষ্ট ছিল। তারপর থেকেও কিন্তু নিউ জিল্যান্ডের প্রতিটা মসজিদ আপনারা জানেন, তিন মাস পুলিশ প্রহরা ছিল। নিরাপত্তার কারণে। যদিও তারপরে কোনো ইনসিডেন্ট হয় নি।
ভয়-ভীতিটা আমার মনে হয়, তারপর কেটে গেছে যে, আমাদের উপরে অ্যাটাক হবে। তবুও নিউ জিল্যান্ড গভার্নমেন্ট, নিউ জিল্যান্ডে প্রায় ৫০ টার উপর মুসলিম সেন্টার ও মসজিদ আছে, প্রত্যেকটা মসজিদে ২৪ ঘণ্টা মানে পালাক্রমে পুলিশি গার্ড থাকতো।
তারপর আস্তে আস্তে যখন এই অ্যালার্ট লেভেল কমে গেল, তারপর আস্তে আস্তে পুলিশ নিয়ে গেল। তারপর থেকেও আমরা, আমি যে মসজিদে নামাজ পড়ি, নিউ জিল্যান্ডের সবচেয়ে পপুলার মস্ক, সবচেয়ে বেশি মুসুল্লির মসজিদ। একটু আমরা নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিয়েছি। আমরা কিছু দরোজা বন্ধ করেছি, সিঁড়ি দিয়ে উঠার ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু, ভয়-ভীতি ছিল না। আমরা তারপরও কিন্তু আমরা ঈদের নামাজ পড়েছি, এবারও আমরা ঈদের নামাজ পড়েছি, কোনো নিরাপত্তার সঙ্কট ছিল না।
নিউ জিল্যান্ড গভার্নমেন্ট, নিউ জিল্যান্ডের ক্ষমতাসীন পার্টি, বিরোধী পার্টি এবং নিউ জিল্যান্ডের জনগণও আমাদের পক্ষে এসে দাঁড়িয়েছিল। আমরা কখনও ভাবি নি আমরা একা।
আমি আমার মসজিদে এতো ফুলের তোড়া আগে কখনও দেখি নি। রাতে দশটা-এগারটার সময়ে তারা এসে নীরবতা পালন করতো, আমাদের সাথে কথা বলতো। তাদের দুঃখ শেয়ার করতো। তাই আমরা সত্যি সত্যি নিউ জিল্যান্ডবাসীদের প্রতি, নিউ জিল্যান্ডের সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ।
আবু: এই ঘটনার পরে নিউ জিল্যান্ড বিশেষত নিউ জিল্যান্ড সরকার একটা বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছে। যদিও নিউ জিল্যান্ডের ইতিহাসে এটিই একটি প্রথম সন্ত্রাসী ঘটনা। এবং মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতি সহানুভূতিশীল এবং সমর্থন জানিয়েছিল খোদ নিউ জিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী। এই জন্য মানুষ অনেকটা আশ্বস্ত হয়েছিল এবং তাদের ভয়-ভীতি কেটে গিয়েছিল। এখন মানুষ নিরাপদে তাদের ধর্ম-কর্ম পালন করছে।
শফিকুর রহমান অনু আপনাকে অনেক ধন্যবাদ এসবিএস বাংলাকে সময় দেওয়ার জন্য।
অনু: ধন্যবাদ আপনাদেরকেও এবং আপনাদের দর্শক-শ্রোতাদেরকে জানাচ্ছি। এবং আপনার সর্বশেষ যে মন্তব্য, সেটা শতভাগ সত্য। আপনার এই মূল্যায়নের জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকারটি শুনতে উপরের অডিও প্লেয়ারটিতে ক্লিক করুন।