সিডনির ওয়েস্টার্ন সাবার্ব লাকেম্বায় অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় মসজিদটিতে দুপুরের দিকে যোহর নামাজ আদায় করতে আসেন মুসল্লিরা।
স্থানীয় ইমাম তখন আজান দিচ্ছিলেন। তার পেছনে পুরুষ মুসল্লিরা সারিবদ্ধ হয়ে অপেক্ষা করছিলেন। তারা সবাই মক্কার পবিত্র কাবা শরীফের দিকে মুখ করে অপেক্ষায় ছিলেন। বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের নামাজ আদায়ের এটাই রীতি।
কোনো কোনো মুসল্লি নীরবে দোয়া করছিলেন।
এই মসজিদে পৃথকভাবে নারীদের নামাজেরও ব্যবস্থা রয়েছে।
নামাজের পর মুসল্লিরা একত্রিত হয়ে টুকটাক কথা বলছিলেন। তারা কেউ কেউ বলেন যে, গত ১২ মাসে তাদের দৈনন্দিন জীবনে ও মসজিদে এসে নামাজ পড়ার ক্ষেত্রে প্রভাব পড়েছে। এগুলো আর আগের মতো নেই।গত ১৫ মার্চ ২০১৯, শুক্রবার নিউ জিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে জুম্মার নামাজের সময়ে সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়। এতে ৫১ জন নিহত হন এবং ৪৯ জন আহত হন।
Maha Abdo from the Muslim Women's Association. Source: Virginia Langeberg/SBS News
মুসলিম উইমেন’স অ্যাসোসিয়েশনের মাহা আবদো এসবিএস নিউজকে বলেন,
“যে কোনো মানুষের হৃদয় এবং অন্তরের জন্য এ ঘটনাটি বলা এবং বোঝার ঊর্ধ্বে।”
“সেই মুহূর্তটি আমি এখনও মনে করতে পারি যখন আমার হোয়াটসঅ্যাপে অনবরত মেসেজ আসছিল আর মানুষ ভাবছিল এটি কোনো কৌতুক। এরপর যখন হঠাৎ করে এটি (খবরটি) সবাইকে আঘাত করে তখন সবাই বুঝলো এটি বাস্তব।”
“কোনো পরিবর্তন হয় নি বলা যাবে না। ঘটনাটি ঘটার দিন ও ক্ষণ থেকেই এটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলে আসে। এটি এখনও আমাদের সবার মনের গহীনে রয়ে গেছে।”
বিগত মাসগুলোর তুলনায় আজ মসজিদে আগত মুসল্লিদের সংখ্যা বেড়ে গেছে।
লেবানিজ মুসলিম অ্যাসোসিয়েশনের আহমদ মালাজ বলেন, সবার দৈনন্দিন রুটিনে সাবধানতা অবলম্বন করার বিষয়টি ঢুকে গেছে।
“সাধারণভাবে মানুষ আগের চেয়ে বেশি সতর্ক। মসজিদেও নানা রকম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করা হচ্ছে। তবে, মানুষ আশাবাদী এবং তারা আসছে।”
সেই আক্রমণের ঘটনার পরপরই মিজ আবদো এবং তার সহকর্মীরা কাজে নেমে পড়েন। তারা নিউ সাউথ ওয়েলসে মুসলমানদেরকে সমবেত করেন এবং তাদেরকে সাহস দেন যে, তারা বিচ্ছিন্ন নন।
ঘর থেকে বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনেকেই ভীত ও উদ্বিগ্ন হতেন। তাদেরকে সেই ভীতি কাটিয়ে উঠতে হয়েছে। তিনি বলেন,
“সেই ঘটনার পরপর অনেক উদ্বেগ দেখা দেয় ... শুক্রবার জুম্মার নামাজে এবং অন্যান্য নামাজে ছেলেদেরকে মসজিদে পাঠাতে উদ্বিগ্ন হতেন মায়েরা।”
নিরাপত্তার জন্য যে-সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে সেগুলো এর আগে কখনও মুসল্লিরা দেখেন নি।
“ক্রাইস্টচার্চের ঘটনার পর, আমার মনে আছে, একটি মর্নিং টি অনুষ্ঠানের আয়োজনের সময়ে আমরা স্থানীয় পুলিশকে জানিয়েছিলাম। সাধারণত আমরা এটা করি না। এটা এ জন্য করেছি যে, আমরা সব ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছি এটা নিশ্চিত করতে চাচ্ছিলাম।”
“আমাদেরকে আরও সতর্ক হতে হবে। আমাদের ফোন সেটে কিছু কিছু স্পিড ডায়ালের ব্যবস্থা সবসময়েই রাখতে হবে এবং আশে-পাশের পরিস্থিতির দিকে নজর রাখতে হবে। তবে, এসব যেন আমাদের কাজে বাধা হিসেবে দেখা না দেয়।”
“এ ঘটনার পর প্রায় এক বছর হয়ে গেছে। বহু বিষয় নিয়ে মানুষের এখন পুনরায় চিন্তা করতে হবে।”
মিস্টার মালাজ বলেন, বৃহৎ সমাজের প্রতিক্রিয়া দেখে তিনি অভিভূত হয়েছেন। তিনি বলেন,
“বিভিন্ন কমিউনিটি ও বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়-সহ সমাজের সমস্ত অংশ থেকে যে সাড়া আমরা পেয়েছি তা দেখে আমরা খুবই অভিভূত। অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত বিভিন্ন কমিউনিটির মধ্যকার শক্তিশালী সম্পর্ক এর মাধ্যমে ফুটে উঠে।”
“দিনের শেষে আমরা সবাই অস্ট্রেলিয়ান এবং এ রকম বিষয় আমাদের সবাইকে একত্রিত করে। তাই, সেসব পার্থক্যগুলো আমাদেরকে অতিক্রম করতে হবে এবং আমরা সত্যিকারেই কিছু ইতিবাচক উদাহরণ দেখেছি।”
এই ঘটনার পর নিউ জিল্যান্ড অতি দ্রুত সাড়া দেয় এবং আগ্নেয়াস্ত্র আইনের সংস্কার করে। অস্ট্রেলিয়ান গ্রিনস সিনেটর মেহরিন ফারুকী বলেন, নিজের দেশ অস্ট্রেলিয়ায় রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া দেখে তিনি হতাশ। তিনি বলেন,
“অস্ট্রেলিয়া নিয়ে আমি দুঃখের সঙ্গে বলছি যে, গত বছরের মতোই সব চলছে। (আমাদের প্রতিবেশী দেশে) ৫১ জন নিরপরাধ মুসলমানের ভয়ানক মৃত্যুর বিষয়টি গণমাধ্যম থেকে সরে যাওয়ার সাথে সাথে আমরাও ছেড়ে দিয়েছি। এই ঘটনায় একজন অস্ট্রেলিয়ানের বিচার হচ্ছে।”
“আমরা যা দেখলাম তা হলো, ডানপন্থী চরমপন্থার উত্থান (রাইট-উইং এক্সট্রিমিজম)। হেইট স্পিচের বিরুদ্ধে আমরা আইন দেখি নি। ২০১৫ সালের পর আমরা ন্যাশনাল অ্যান্টি-টেরোরিজম ক্যাম্পেইনের জন্য অর্থায়ন দেখি নি।”
জাতিগত ঘৃণা-ভিত্তিক আক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় মরিসন সরকারের প্রতি লেবার দল আহ্বান জানিয়েছে অর্থায়ন করার জন্য।
অ্যাটর্নি-জেনারেলের একজন মুখপাত্র এর জবাবে বলেন,
“সকল প্রকার বৈষম্য, বিশেষত, জাতিগত ঘৃণার প্রতি মরিসন সরকার কোনো ছাড় দিবে না (জিরো টলারেন্স দেখাবে)।”
“অস্ট্রেলিয়ার মুসলমান এবং ইহুদি সম্প্রদায়ের প্রতি অসহিষ্ণু আচরণ সাম্প্রতিক সময়ে দুঃখজনকভাবে বেড়েছে বলে সরকার লক্ষ করছে।”
অস্ট্রেলিয়ার ব্রেন্টন হ্যারিসন ট্যারেন্ট-এর বিরুদ্ধে ৫১ টি হত্যা-অভিযোগ তোলা হয়েছে। এ ছাড়া ৪০টি হত্যা-চেষ্টার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তার বিচার-কার্য আগামী জুন মাসে শুরু করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ক্রাইস্টচার্চে দুটি মসজিদে সন্ত্রাসী হামলার এক বছর পূর্তিতে সেই মর্মান্তিক ঘটনার স্মরণে আগামী রবিবার, ১৫ মার্চ নানা উদ্যোগ গ্রহণ করছে অস্ট্রেলিয়ার মুসলমান সম্প্রদায়। নিউ জিল্যান্ডে সেই ঘটনার স্মরণে শুক্রবারে জুম্মার সময়ে বিশেষভাবে দোয়া করা হবে এবং জাতীয়ভাবে তা স্মরণ করা হবে।
মিজ মালাজ বলেন,
“যারা তাদের সহমর্মিতা প্রকাশ করতে চান, তাদেরকে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি। আমরা ক্রাইস্টচার্চের ঘটনার বছর পূর্তিতে তাদেরকে স্মরণ করবো এবং তাদের ও তাদের পরিবারের জন্য দোয়া করবো।”
“দিনের শেষে আমরা সবাই একই পরিবার। যে-কোনো ধরনের সহিংসতা এবং ঘৃণাসূচক অপরাধ বর্জনীয় এবং এটা পরিষ্কার যে, তা প্রত্যাখ্যাত।”
“যে-সব বিষয় আমাদেরকে বিভক্ত করে সেগুলোর চাইতে বড় ও মহান হলো যে-সব বিষয় আমাদেরকে একত্রিত করে।”