নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের দুটি মসজিদে গত শুক্রবার জুম্মার নামাজের সময়ে যে বর্বরোচিত হামলা চালানো হয়, তাতে এ পর্যন্ত ৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। মর্মান্তিক এই ঘটনায় এ পর্যন্ত ৫ জন বাংলাদেশীর মৃত্যুর খবর জানা গেছে। এরা হলেন: বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. আবদুস সামাদ, সিলেটের ফরিদ আহমেদের স্ত্রী হোসনে আরা আহমেদ, মতলবের ডা. মোজাম্মেল হোসেন সেলিম, নরসিংদীর পলাশ উপজেলার জাকারিয়া ভূঁইয়া এবং নারায়ণগঞ্জের ওমর ফারুক।
এছাড়া, বেশ কয়েকজন বাংলাদেশী আহত হয়েছেন।
এই ভয়ংকর সন্ত্রাসী হামলা থেকে অল্পের জন্য বেঁচে যান নিউজিল্যান্ডে সফররত বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সদস্যরা।
এই ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে নিউজিল্যান্ড পুলিশ প্রথমে চার ব্যক্তিকে আটক করে। পরে একজনকে ছেড়ে দেয়। বাকি তিনজনের মধ্যে হামলাকারী অস্ট্রেলিয়ার একজন নাগরিক ব্রেন্টন হ্যারিসন ট্যারেন্টও রয়েছে। শনিবার ১৬ মার্চ তার বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দিয়ে স্থানীয় সময় সকালে তাকে আদালতে হাজির করা হয়। তাকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
২৮ বছর বয়সী ব্রেন্টন ট্যারেন্ট এর আগে কোনো অপরাধী কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে জানা যায় নি। অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার “ওয়াচ লিস্ট”-এও সে ছিল না। তার দাদী জয়িস ট্যারেন্ট (৯৪) নাতি ব্রেন্টনকে “ভাল ছেলে” বলে অভিহিত করেন।
Source: AAP
ঘটনাটি ছিল পূর্ব-পরিকল্পিত
ক্রাইস্টচার্চের আল নূর ও লিনউড মসজিদে অটোমেটিক রাইফেল নিয়ে আক্রমণের এই ঘটনাটি আকস্মিক ছিল না। হামলাকারী ব্রেন্টন ট্যারান্ট এর জন্য পূর্ব-পরিকল্পনা করেছে এবং যথেষ্ট সময় নিয়ে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে।
হামলার আগে সে তার টুইটার অ্যাকাউন্টে ৭৪ পৃষ্ঠার একটি ইশতেহার প্রকাশ করেছে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে “শেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক” হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
‘দ্য গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট’ নামের এই ইশতেহারে বলা হয়েছে, দুই বছর ধরে সে এই হামলার পরিকল্পনা করছিল। হামলার জন্য নিউজিল্যান্ড তার প্রথম পছন্দ ছিল না। তবে, পরিকল্পনায় নির্ধারিত সময়ের তিন মাস আগেই সে ক্রাইস্টচার্চকে হামলা করার জন্য বেছে নেয়।
হামলার জন্য আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করলে বাড়তি প্রচার পাওয়া যাবে এবং যুক্তরাষ্ট্র তথা রাজনীতিতে এর প্রভাব পড়বে, এ রকম চিন্তা-ভাবনা থেকেই সে অটোমেটিক রাইফেল ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা সেখানে লিখেছে ট্যারেন্ট।
হামলার নয় মিনিট আগে সে অন্তত ৩০টি ঠিকানায় ইমেইল করেছে। এ ছাড়া টুইটারে টুইটও করেছে। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব অ্যান্ড্রু ক্যাম্পবেইল মেইল পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
আল নূর মসজিদে হামলার সময়ে সে তার হেলমেটে লাগানো ক্যামেরার মাধ্যমে পুরো ঘটনা ইন্টারনেটে (ফেসবুকে) সরাসরি সম্প্রচার করেছে।
এই হামলার সময়ে ব্রেন্টন বৈধ অস্ত্র বহন করেছিল। তাই হামলায় ব্যবহৃত গুলি কিনতে তার কোনো সমস্যায় পড়তে হয় নি।
Who were the victims of the Christchurch mosque massacre. Source: SBS News
হামলাকারীর অনুপ্রেরণা
তার তথাকথিত ইশতেহারে সে নিজেকে বর্ণনা করেছে, ভাষায়, সংস্কৃতিতে, রাজনৈতিক বিশ্বাস আর দর্শনে, আত্মপরিচয়ে এবং বংশপরিচয়ে একজন ইওরোপীয় হিসেবে।
হামলার উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে সে নিজের অভিবাসন-বিরোধী ও মুসলিম-বিরোধী অবস্থানের কথা তুলে ধরেছে। এ ছাড়া, সে নিজেকে ‘এথনো-ন্যাশনালিস্ট এব ফ্যাসিস্ট’ হিসেবেও বর্ণনা করেছে।
ইশতেহারে সে তার নিজের অনুপ্রেরণা হিসেবে নরওয়ের কুখ্যাত খুনি অ্যান্ডার্স বেরিং ব্রেইভিকের কথা উল্লেখ করেছে। এই ব্যক্তি ২০১১ সালের জুলাই মাসে নরওয়ের অসলোতে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় এবং উটোয়া দ্বীপে গুলি চালিয়ে ৭৭ জনকে হত্যা করে। এসব অপরাধের কারণে আদালত তাকে ২১ বছরের কারাদণ্ড দেয়।
লাইভ ভিডিওতে দেখা গেছে, অস্ত্র ও ম্যাগাজিনের ওপর সাদা রঙে বেশ কিছু নাম লেখা রয়েছে। একটি ম্যাগাজিনের ওপর লেখা ছিল রদারহ্যাম, আলেসান্দ্রে বিসনেত্তা ও লুকা ত্রাইনির জন্য।
২০১৭ সালে কানাডায় একটি মসজিদে হামলা চালিয়ে ছয় ব্যক্তিকে হত্যা করে আলেসান্দ্র বিসনেত্তা। গত ফেব্রুয়ারিতে তার যাবজ্জীবন সাজার রায় হয়।
ইতালির নাগরিক উগ্র ডানপন্থি লুকা ত্রাইনি ২০১৮ সালে মাসেরাতা শহরে গুলি চালিয়ে আফ্রিকা থেকে আসা ছয় অভিবাসীকে হত্যা করে।
Teenager egged Fraser Anning Source: The Feed SBS
বিতর্কিত মন্তব্য করে বিপাকে সিনেটর ফ্রেজার অ্যানিং
ক্রাইস্টচার্চে দুটি মসজিদে বর্বরোচিত সন্ত্রাসী হামলার জন্য অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের মুসলমান অভিবাসীদেরকে দায়ী করে বিতর্কিত বক্তব্য দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার ডানপন্থী সিনেটর ফ্রেজার অ্যানিং। এর ফলে বিশ্বব্যাপী তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন তিনি।
এই হামলাটিকে ন্যাক্কারজনক বলার পাশাপাশি তিনি বলেন, মুসলিম অভিবাসীরা অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডবাসীর মধ্যে এক ধরনের ‘ভয়’ সৃষ্টি করছেন।
কুইন্সল্যান্ড অঙ্গরাজ্যের এই সিনেটর তার বিতর্কিত বক্তব্যের জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন।
এদিকে, সিনেটর ফ্রেজার অ্যানিংয়ের মাথায় ডিম ভেঙ্গেছেন মেলবোর্নের ১৭ বছর বয়সী এক কিশোর। তার নাম উইল কনোলি। তাকে নিয়ে হৈচৈ পড়ে গেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং সামাজিক-যোগাযোগ-মাধ্যমে তাকে হিরো হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে।
গত শনিবার মেলবোর্নে সাংবাদিকদের সঙ্গে মুসলিম-বিদ্বেষমূলক কথা বলছিলেন সিনেটর ফ্রেজার অ্যানিং। সে সময় তার মাথায় ডিম ছুঁড়ে মারে কিশোর উইল কনোলি। ঘটনাটি নিজের মোবাইল ফোনে ভিডিও করে এই কিশোর।
সিনেটর অ্যানিংয়ের মাথায় ডিম নিক্ষেপের পর তাকে চড়-থাপ্পর মারেন সিনেটর। পুলিশ এই কিশোরকে গ্রেপ্তার করলেও পরবর্তীতে ছেড়ে দেয়।
এখন তার পক্ষ নিয়ে দাঁড়িয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিশ্বের খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব এবং সেলিব্রিটিরা। এই কিশোরের জন্য তহবিল সংগ্রহের উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে।
‘ডিম-বালক’ হিসেবে খ্যাত এই কিশোর তার নিজের টুইটারে লিখেছে, মুসলমানরা সন্ত্রাসী নয়; সন্ত্রাসবাদের কোনো ধর্ম নেই।