৪১ বছর বয়স্ক ইরাকি শরনার্থী মাজিন তিন বছর আগে তার স্ত্রী ও দুই কন্যা নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় এসেছিলেন।
আইসিস বা Islamic State of Iraq and Syria তার শহর দখল করলে তিনি সপরিবারে লেবাননে আশ্রয় নেন।
সেখান থেকে অস্ট্রেলিয়ায় আসার পর তিন বছর পেরিয়ে গেছে, আজও তিনি নিজের আগের পেশায় ফেরার সুযোগ খুঁজছেন।
গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি
- এক রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রায় এক চতুর্থাংশ পার্মানেন্ট স্কিল্ড মাইগ্রেন্ট তাদের বর্তমানে নিয়োজিত পেশার চাইতে অধিক যোগ্যতা ও দক্ষতা সম্পন্ন।
- অস্ট্রেলিয়ায় কাজের অভিজ্ঞতা না থাকা আর ভাষাগত প্রতিন্ধকতাই অনেক ক্ষেত্রে বড় বাঁধা হিসাবে প্রতীয়মান হয়।
- কাঙ্ক্ষিত পেশায় কাজ পেতে পেশাগত স্বীকৃতি বা লাইসেন্সিং এর উপর গুরুত্ব দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ক্যারিয়ারে সামনে এগোতে হলে অনেক সময় এক কদম পেছাতে হয়।
A worker using an electrical system Source: Pexel/Pixabay
অস্ট্রেলিয়ার দক্ষ স্থায়ী অভিবাসী বা পার্মানেন্ট স্কিল্ড মাইগ্রেন্টদের প্রতি চারজনে একজন ওভারকোয়ালিফাইয়েড
অর্থাৎ তাদের বর্তমান পেশার তুলনায় তারা অধিক দক্ষতা ও যোগ্যতা সম্পন্ন।
এই রিপোর্ট অনুযায়ী মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কারদের দক্ষতা ও কাজের মধ্যে ঠিকমত মিল না হওয়ায় ২০১৩ থেকে ২০১৮ সালের অলভ্য মজুরী বা ফরগন ওয়েজ এর পরিমাণ ১.২৫ বিলিয়ন ডলার দাঁড়িয়েছে।
দক্ষ জনশক্তির উৎপাদনশীলতা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা ব্যাপক পরিমান অব্যবহৃত
রয়ে যাওয়ায় অস্ট্রেলিয়ার অর্থনীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ছে।
স্থানীয় অভিজ্ঞতার অভাব
অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় কর্মক্ষেত্রে কাজের অভিজ্ঞতার অভাব ও ইংরেজী ভাষায় সীমাবদ্ধতাকে
বড় বাধা বলে মনে করেন মাজিন। তিনি ও তার স্ত্রী উভয়েই এই সমস্যায় পড়েছেন।
তার স্ত্রী স্কুল শিক্ষিকা হিসাবে কাজ করতে চান।
এদেশের নিয়োগকারীরা এদেশেরই কাজের অভিজ্ঞতাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। তারা ইংরেজি ভাষায়ও উচ্চতর দক্ষতা চান।এসব কারণ ছাড়াও, সংশ্লিষ্ট চাকুরী বা পেশাদারদের নেটওয়ার্কে যুক্ত না থাকায় চাকুরীর বাজারে অভিবাসীরা একধরনের অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হচ্ছেন।
" কাজ পাওয়ার পন্থাকে বুঝতে হবে"
সেটলমেন্ট সার্ভিসেস ইণ্টারন্যাশনাল শরনার্থি ও অভিবাসীদের অস্ট্রেলিয়ায় থিতু হতে সাহায্য করে থাকে।সংস্থাটির সিনিয়র এমপ্লয়মেন্ট অপারেশনস কোঅরডিনেটর ডেভিড ফোরবেস এর মতে- অস্ট্রেলিয়ায় নতুন আসা অভিবাসীদের এদেশে কর্মক্ষেত্রের ব্যাপারগুলো জানা অত্যন্ত জরুরী।
অভিবাসীদের কাছে নতুন দেশ হিসাবে অস্ট্রেলিয়ায় কাজ পাওয়ার পন্থা বা পাথওয়ে টু এমপ্লয়মেন্ট ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় অনুধাবন করতে হবে।
"আমি মনে করি যে পেশাদার দক্ষ অভিবাসীদের সমস্যা হচ্ছে তারা তাদের পেশায় ফেরার পথটা আসলে কি তা ঠিক ধরতে পারেন না। কোনো শিল্পকুশল কাজ বা বিশেষ ইন্ডাস্ট্রি সংশ্লিষ্ট দক্ষতার ক্ষেত্রে ব্যপারটা আরও জটিল। সংশ্লিষ্ট ইন্ডাস্ট্রিতে পারদর্শিতার বিভিন্ন মাপকাঠি, নানান শাখাপ্রশাখা রয়েছে। এসব বুঝতে হবে।"কানেক্টিং (Konnecting) গ্রুপ ভিসা সংক্রান্ত সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি রিক্রুটিং এজেন্সির কাজও করে থাকে।
An engineer planning a dam Source: ThisIsEngineering/Pexels
ফ্রেড মলয় কানেক্টিং (Konnecting) গ্রুপ এর ম্যনেজিং ডিরেক্টর ও একজন রেজিস্টার্ড মাইগ্রেশন এজেন্ট।
তার রিক্রুটিং এজেন্সি স্থানীয় নিয়োগদাতাদের কাঙ্ক্ষিত জনশক্তি খুঁজে পেতে সাহায্য করে যা স্থানীয় শ্রমবাজারে সহজলভ্য নয়।
লাইসেন্স, নিবন্ধন ও প্রশিক্ষণ
অভিবাসীদের নির্দিষ্ট পেশা ভিত্তিক লাইসেন্স বা নিবন্ধনের প্রয়োজন আছে কিনা তা জানা দরকার বলে মনে করেন মিস্টার মলয়।
তিনি বলেন,
"অনেক সময় বিশেষ পেশার জন্য বিশেষ ধরনের লাইসেন্স বা অনুমতি পত্র আর নিবন্ধনের দরকার হয়; যেমন নির্মানশিল্পে কাজ করতে হলে হোয়াইট কার্ড বা ব্লু কার্ড লাগে, তেমনি কেউ যদি শিশুদের সাথে কাজ করেন তবে তাকে ওয়ার্কিং উইথ চিলড্রেন সার্টিফিকেট পেতে হবে। "
ইলেক্ট্রিশিয়ান কেউ এদেশে একই পেশায় কাজ পেতে হলে তাকে সেই পেশার লাইসেন্স বা নিবন্ধিত হতে হবে। তেমনি এমন অনেক পেশা বা কাজ রয়েছে যার জন্য অবশ্যই স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষন নিয়ে সনদ অর্জন ও নিবন্ধিত হতে হবে।
অস্ট্রেলিয়ান জব মার্কেটের উপযোগী সিভি
এন বি ক্যারিয়ার কনসাল্টিং এর নাদিনা বেনভেনিস্টী একজন ক্যারিয়ার কোচ, রিক্রুটমেন্ট স্পেশ্যালিস্ট এবং সিভি বা জীবন বৃত্তান্ত রচনাকারী। চাকুরী যারা দিচ্ছে আর যারা চাকুরী খুঁজছে- তাদের মধ্যে সংযোগ ঘটানো তার কাজ।
সিভি বা জীবন বৃত্তান্ত লিখতে সহায়তা দেওয়া সহ চাকুরী প্রার্থীদেরকে তিনি উপযুক্ত কাজ খুঁজে পেতে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তিনি বলেন — অনেক সময় প্রার্থীরা আবেদন পত্রে উপযুক্ত শব্দ বা পরিভাষা ব্যবহার করেন না। শব্দ চয়নের দুর্বলতার কারণেও অনেক সময় তাদের আবেদন পত্র প্রত্যাখ্যাত হয়ে থাকে।
অ্যাবি জোসি একজন কনস্ট্রাকশন প্রজেক্ট ম্যানেজার ও ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার। তিনি ১৬ বছর যাবত প্রজেক্ট ম্যানেজার ও ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার পদ সহ স্থপতি এবং ডিজাইন ম্যানেজার পদে ভারত ও সৌদি আরবে কাজ করেছেন।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়ায় আসার পর জুন মাসে তিনি চাকুরী পেয়ে যান। মিস জোসি বলেন, তার চাকুরী পেতে ক্যারিয়ার কনসালট্যান্ট ভাল সহযোগিতা করেছেন। ক্যারিয়ার কনসালট্যান্ট এর সহযোগিতায় তিনি ছয় সপ্তাহেই চাকুরী খুঁজে পেয়েছেন।
তার ভাষ্য অনুযায়ী,
" একজন ক্যারিয়ার কনসাল্ট্যান্ট আমার সিভি 'র উপর কাজ করে তাকে আমূল বদলে দেন। তিনি জানিয়েছেন যে, আজকাল নিয়োগদাতারা আর সিভি পড়ে দেখেন না। আবেদন পত্র আর সিভি সরাসরি একটা কম্পিউটার সিস্টেমে চলে যায়। তাই সেখানে ধরা পড়ার মত সিভিতে আকর্ষণীয় শব্দ বা ক্যাচওয়ার্ডস থাকতে হবে।"
এ প্রসঙ্গে তিনি দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেন,
" একটা সহজ উদাহরণ দিই — আমরা যাকে 'প্রজেক্ট প্রপোজাল রিপোর্ট "বলি, তাকে এখানে 'বিজনেস কেইস' বলা হয়। ফলে আমাকে বিস্তারিত বুঝিয়ে বলতে হয়েছে আমি অন্য দেশে আসলে কি কি কাজ করেছি।"
Resume writing Source: Ron Lach/Pexels
অহেতুক আবেদন বর্জনীয়
বেনভেনিস্টী আরও বলেন যে কাঙ্ক্ষিত চাকুরী পাওয়ার জন্য সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে অবিচলিত ভাবে এগোতে হবে।যথেচ্ছভাবে যত্র তত্র চাকুরির আবেদন করলে তাতে আবেদনকারীর গুরুত্ব কমে।
যে কাজের জন্য যেমন লোক দরকার- নিয়োগকারীরা তেমন প্রার্থীই প্রত্যাশা করেন। সংগত কারনেই বিজ্ঞাপনে উল্লেখিত
আবেদনকারীর যোগ্যতা ও শর্তাবলীর সাথে সামঞ্জস্যতা ও প্রাসঙ্গিকতা আছে এমন প্রার্থীই তারা চাইবেন।
তাই অহেতুক, অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও অপ্রাসঙ্গিক আবেদন উপেক্ষিত অস্বাভাবিক নয়।
এ বিষয়ে বেনভেনিস্টী অভিমত দেন,
"নিয়োগকারীরা যখন অযোগ্য কারোর আবেদন বারবার পেতে থাকেন তখন
তারা হয়তো ভাবতে পারেন যে আবেদনকারীটি আসলে ঠিকমত বিজ্ঞাপনটি বুঝেননি বা বুঝেও উপেক্ষা করছেন।
এই পরিস্থিতিতে তারা তাকে কালো তালিকাভুক্ত করতে পারেন।"
তারা হয়তো ভাবতে পারেন যে আবেদনকারীটি আসলে ঠিকমত বিজ্ঞাপনটি বুঝেননি বা বুঝেও উপেক্ষা করছেন।
এই পরিস্থিতিতে তারা তাকে কালো তালিকাভুক্ত করতে পারেন।"
এক কদম পেছনে
অনেক সময় দু কদম সামনে এগোতে হলে এক কদম পেছাতে হয়। অস্ট্রেলিয়ার কর্মক্ষেত্রে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে এই নীতির উপর জোর দিয়েছেন মিস্টার মলয়।
কেউ যদি বার বার চাকুরিতে প্রত্যাখ্যাত হতে থাকে, তখন তাকে নিজের মূল্যায়ন করতে হবে। সেভাবে এদেশের কোন ইন্ডাস্ট্রিতে কাঙ্ক্ষিত পদ লাভ করতে হলে নিজের অতীতের পূনর্মূল্যায়ন করতে হবে।
এদেশের কোন ইন্ডাস্ট্রিতে ভালো অবস্থানে পৌঁছতে হলে তার সূচনা পর্ব থেকে ঢুকতে হবে। স্থানীয় অভিজ্ঞতা লাভ করার স্বার্থে শুরুতে জুনিয়র পদে বা সহকারী হিসাবে কাজ করা যায় যা এখানকার শিল্প পরিবেশ বুঝতে সাহায্য করবে।
নিজস্ব কর্মপরিসরে এখানকার যে কোনো পদে কাজ করে কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করাকে ইন্ডাস্ট্রিতে প্রবেশের প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে বিবেচনা করতে হবে। নিজের ফিল্ডে এভাবে কাজ করে এগোনোয় জোর দিয়েছেন মিস্টার মলয়।
তিনি আরো বলেন যে, যেসব পেশায় ক্লায়েন্ট বা কাস্টমারের সাথে যোগাযোগের উপর কাজের ফলপ্রসূতা নির্ভর করে, সেসব চাকুরিতে সফল হতে হলে ইংরেজী ভাষায় দক্ষতা ও কমিউনিকেশন স্কিল মানসম্মত হতে হবে।
Source: Ono Kosuki/Pexels
নেটওয়ার্কিং ও যোগাযোগ
অনলাইনে চাকুরির আবেদন করে বসে না থেকে কর্তৃপক্ষের সাথে সরাসরি কথা বলার পরামর্শ দিয়েছেন ক্যারিয়ার কোচ বেনভেনিস্টী।
ফোনালাপের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট পদের বিষয়ে তথ্য জানা যায় এবং সম্পর্কেরও উন্নতি হয়, আর এর মাধ্যমে নিয়োগ কর্তৃপক্ষের বিষয়ে ধারণা পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে বেনভেনিস্টীর পরামর্শ -
"আরেকটা টিপ হচ্ছে অনেক অনেক নেটওয়ার্কিং করতে হবে। এক্ষেত্রে লিঙ্কডইন একটা ভাল মাধ্যম হতে পারে যার সাহায্যে নিয়োগকারী বা বিজনেস লিডারদের সাথে সংযোগ স্থাপন করা যায়। " দক্ষ অভিবাসিরা অস্ট্রেলিয়ার কর্মক্ষেত্রে অনেক অবদান রাখতে পারেন।
Source: Pixabay
একবার তাদেরকে স্ব স্ব দক্ষতার জায়গায় কাজের সুযোগ দেয়া হলে তারা সেই নিয়োগকারী সংস্থার মূল্যবান সম্পদ হতে পারেন বলে মতামত দেন সেটলমেন্ট সার্ভিসেস অস্ট্রেলিয়ার ডেভিড ফরবেস।
তিনি আরও বলেন,
"আমরা আসলে দেখেছি যে ভিনদেশে কাজ করার দরুন অভিবাসীরা কিছুটা ভিন্নভাবে কাজ করে থাকেন। কঠিন সমস্যা সমাধানের বিকল্প উপায় তাদের জানা আছে।"
প্রতিবেদনটি শুনতে উপরের অডিও-প্লেয়ারটিতে ক্লিক করুন।
এসবিএস বাংলার রেডিও অনুষ্ঠান শুনুন প্রতি সোমবার এবং শনিবার সন্ধ্যা ৬টায় এবং আরও খবরের জন্য আমাদের ফেইসবুক পেইজটি ভিজিট করুন।
আরো দেখুন: