সততা এবং মানুষের আরও ক্ষমতায়নের স্লোগান দেওয়া দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দল, আম আদমি পার্টি, পাঞ্জাবে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্টতা পেয়েছে। কংগ্রেসের বাইরে আম আদমি পার্টি বা আপ, দেশের দুটি রাজ্যের ক্ষমতা লাভ করলো।
উত্তরপ্রদেশে ৩৫ বছরের রীতি ভেঙে পরপর দু’বার সরকার গড়ল একই দল। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার বিপুল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে উত্তরপ্রদেশে সরকার গড়ছে বিজেপি। আড়াইশোর বেশি আসনে পদ্ম ফুটিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। নিজেও জিতেছেন বিপুল ভোটে। অথচ, ভোটের আগেই দেশের সবচেয়ে বড় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধেই ক্ষোভের ঝড় বয়ে যেতে দেখা গিয়েছে। তবু সেই ক্ষোভের প্রভাব পড়ে নি ভোটবাক্সে।
READ MORE
নতুন এসবিএস রেডিও অ্যাপ ডাউনলোড করুন
গত পাঁচ বছর ধরে উত্তরপ্রদেশে কখনও ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে দলিতদের উপর অত্যাচারের অভিযোগ উঠেছে তো কখনও আবার গেরুয়া শিবিরের মন্ত্রীর ছেলের গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়েছেন আন্দোলনকারী কৃষকরা। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধর্ষণের মর্মান্তিক খবরও সামনে এসেছে। করোনায় মৃত্যুর তথ্য লুকোতে গঙ্গায় দেহ ভাসানোর অভিযোগও উঠেছিল বিজেপির বিরুদ্ধে। তারপরও, ভোটবাক্সে সেই ক্ষোভের কার্যত কোনও প্রতিফলনই হয় নি।
লখিমপুর খেরি, হাথরাসের মতো এলাকাতেও প্রায় সব আসন জিতে নিয়েছেন মোদি-যোগীর জুটি। ভোটগণনার প্রাথমিক প্রবণতা বলছে, উত্তরপ্রদেশের মহিলাদের ভোট ঢুকেছে বিজেপি-র খাতায়। যার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, প্রতি সপ্তাহে বিনাপয়সার খাদ্যশস্য বণ্টন এবং আইনশৃঙ্খলার লক্ষণীয় উন্নতি। এই জোড়া নীতিতেই মহিলাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা বেড়েছে বিজেপি-র। পাশাপাশি, হিজাব বিতর্কে উত্তরপ্রদেশের সরকারের ভূমিকাও মহিলা ভোট গেরুয়া শিবিরে টেনে এনেছে বলে দাবি ভোট বিশেষজ্ঞদের একটা অংশের।
উল্টো দিকে, নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যভাবে ভোটদাতাদের কাছে তুলে ধরতে ব্যর্থ অখিলেশ যাদব -সহ বাকি বিরোধীরা। যদিও সমাজবাদী পার্টির নেতারা বলছেন, তাঁরা ভাল লড়াই দিয়েছেন। কিন্তু, মুখ থুবড়ে পড়েছে মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি। বিরোধীদের একমাত্র সান্ত্বনা হল পাঁচ বছর আগের চেয়ে বিজেপি-র আসন সংখ্যা কমে যাওয়া।
READ MORE
ভারতীয় সংবাদ: ০৭ মার্চ ২০২২
এদিকে, পাঁচ রাজ্যের ফলাফলের ইঙ্গিত প্রকাশ্যে আসতেই রীতিমতো বিস্ফোরণ আম আদমি পার্টির। প্রথমবার জাতীয় স্তরে নিজেদের আধিপত্যের দাবি করেছেন আপ নেতা রাঘব চাড্ডা। তাঁর দাবি, আম আদমি পার্টি আর আঞ্চলিক দল নয়, এখন জাতীয় শক্তি। আগামী দিনে গোটা দেশের দায়িত্ব যাবে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের কাঁধে। পাঁচ রাজ্যের ফলাফলের প্রাথমিক ট্রেন্ড যা বলছে, তাতে পাঞ্জাবে কার্যত কেজরিওয়ালের তুফান। যে তুফানে নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে কংগ্রেস।
২০১৭ সালে পাঞ্জাবে ৭৭ আসন পেয়েছিল কংগ্রেস। কেজরিওয়ালের দল এবার সেই ৭৭ আসনের গণ্ডিও পেরিয়ে যেতে চলেছে। সব ঠিক থাকলে আম আদমি পার্টি পাঞ্জাবে দু-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসছে। অন্যদিকে কংগ্রেস প্রায় নিশ্চিহ্ন।
বস্তুত, অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি দীর্ঘদিন ধরেই দিল্লির বাইরে নিজের জন্য জমি তৈরির চেষ্টা করছিল। এই প্রথম তাঁরা সাফল্যের মুখ দেখল। পাঞ্জাবে এই সাফল্যের অর্থ দিল্লির বাইরে প্রথম কোনও পূর্ণরাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী থাকবে আম আদমি পার্টির। অর্থাৎ, এই মুহূর্তে গোটা দেশের দু’রাজ্যে একক শক্তিতে ক্ষমতায় আসতে চলেছে আপ। কংগ্রেসের হাতেও রয়েছে মাত্র দুটি রাজ্যই। তাছাড়া, গোয়াতেও খাতা খুলতে চলেছে আম আদমি পার্টি। সব মিলিয়ে ধীরে ধীরে জাতীয় স্তরে নিজেদের প্রাসঙ্গিক করে তুলছে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের দল।
অন্যদিকে, বিজেপিকে সমানে সমানে টক্কর দেওয়ার বদলে আগের থেকে আরও অন্ধকারে ডুবছে দেশের সবচেয়ে পুরনো দল, কংগ্রেস। ২০১৪ সাল থেকে একের পর এক নির্বাচনে কংগ্রেস যেভাবে ধরাশায়ী হচ্ছে, সেই ধারা বজায় রইল ২০২২ সালের পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনেও। যে পাঁচ রাজ্যে ভোট হয়েছিল তার মধ্যে কংগ্রেস একটিতে ক্ষমতায় ছিল, দু’টিতে ২০১৭ সালে একক বৃহত্তম দল হিসাবে উঠে এসেছিল এবং একটিতে দলের অন্যতম সেরা মুখ প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে আঁকড়ে ধরে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছিল।
কিন্তু, পাঁচ রাজ্যের মধ্যে যে রাজ্যটিতে কংগ্রেস ক্ষমতায় ছিল, সেই পাঞ্জাবেও কার্যত নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে কংগ্রেস। ইতিহাসে প্রথমবার কংগ্রেসের ভোট নেমেছে ২৫ শতাংশের নিচে। চুরাশির শিখ দাঙ্গার পরেও এত খারাপ ফল পাঞ্জাবে হয় নি কংগ্রেসের। জন্মলগ্ন থেকেই উত্তরাখণ্ড প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অন্তর সরকার বদলের রীতি চলে আসছে। গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব আর নেতৃত্বের অপদার্থতায় সেই উত্তরাখণ্ডেও বিজেপিকে টলাতে পারেন নি হরিশ রাওয়াতরা।
গোয়ায় চিদম্বরমের কাঁধে ভর করে এবছর লড়াই দেওয়ার স্বপ্ন দেখছিল কংগ্রেস। ফলাফলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ধারেকাছে নেই কংগ্রেস। একই ছবি মণিপুরেও।
একসময় কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী পর্যন্ত রাজত্ব করা কংগ্রেস এখন একক শক্তিতে ক্ষমতায় মাত্র দুটি রাজ্যে। আর গোটা তিনেক রাজ্যে স্থানীয় দলগুলির লেজুড় হয়ে নিজেদের ভাসিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। এই অবস্থায় জনগণের রায় মাথা পেতে নিয়েছেন দলের প্রাক্তন সভাপতি এবং সাংসদ রাহুল গান্ধী।
READ MORE
কলকাতা বইমেলায় থিম কান্ট্রি বাংলাদেশ
উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিতে কংগ্রেস আরও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে রাহুল গাঁধীকে সামনে রেখেই লড়েছিল কংগ্রেস। পেয়েছিল সাতটি আসন। প্রিয়াঙ্কা গাঁধীও পরে স্বীকার করে নিয়েছিলেন, জোট বাঁধা ভুল হয়েছে। সেই ভুলের পাঁচ বছর পর এ বার তাঁকে সামনে রেখে উত্তরপ্রদেশে একা লড়েছিল কংগ্রেস।
৩০ বছরে এই প্রথম উত্তরপ্রদেশের ৪০৩টি বিধানসভা কেন্দ্রেই প্রার্থী দিয়েছিল দল। যদিও এ বার প্রচারে খামতি রাখেন নি প্রিয়াঙ্কা গাঁধী। আংশিক দায়িত্ব ছেড়ে ২০২০ সালে উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। গত দু’ বছরে তাঁকে বহুবার দেখা গিয়েছে উত্তরপ্রদেশে। বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে প্রত্যেকবার সশরীরে পৌঁছে গিয়েছেন অশান্তির কেন্দ্রভূমিতে।
প্রতিটি ঘটনায় ধারাবাহিক টুইট করেছেন। যোগীর রাজ্যে যখন একে একে উন্নাও, হাথরস, গোরক্ষপুরে ধর্ষণের মতো অপরাধের ঘটনা ঘটছে, তখন মহিলাদের নিরাপত্তাকেই রাজনৈতিক হাতিয়ার বানিয়েছিলেন প্রিয়াঙ্কা গাঁধী। তাঁর, ম্যায় লড়কি হুঁ, লড় সকতি হুঁ স্লোগানও নাকি সাড়া ফেলেছিল উত্তরপ্রদেশের মহিলামহলে।
প্রিয়াঙ্কা গাঁধী অবশ্য আগেই বলে দিয়েছিলেন, ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসা তাঁর লক্ষ্য নয়। তাঁর উদ্দেশ্য, মানুষের সমস্যার কথা বলা। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে নজর রেখে যে উত্তরপ্রদেশের ভোটের ফলকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছিল, সেখানে প্রিয়াঙ্কা গাঁধীকে সামনে রেখে আসন কিছুটা বাড়িয়ে নেওয়াই লক্ষ্য ছিল কংগ্রেসের। সেদিক দিয়ে উত্তরপ্রদেশে পরীক্ষায় ব্যর্থ ইন্দিরা গাঁধীর নাতনি এবং রাজীব গাঁধীর কন্যা, প্রিয়াঙ্কা গাঁধী।
আর, ঐতিহ্য পাল্টে বিজেপিতেই ফের আস্থা রেখেছে উত্তরাখণ্ড। এই প্রথম বিধানসভায় একই রাজনৈতিক দলকে দ্বিতীয়বার বেছে নিয়েছে উত্তরাখণ্ডের জনতা। ত্রিশঙ্কু বিধানসভার সম্ভাবনা উড়িয়ে বিজেপি-ই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ফিরছে গাড়োয়াল-কুমায়ুঁর রাজ্যে।
উত্তরাখণ্ড বিধানসভায় মোট আসন ৭০টি। একা সরকার গড়তে হলে ৩৬টি আসন নিশ্চিত করতে হত জয়ী রাজনৈতিক দলকে। আগের বারের থেকে ভোট কমলেও বিজেপি ৪৫ টিরও বেশি আসন নিশ্চিত করে ফেলেছে দেবভূমিতে। ভোট এবং আসন বাড়িয়েও শেষ পর্যন্ত কিছু করতে পারেনি কংগ্রেস। তবে বিজেপি যেমন উত্তরাখণ্ডে জিতেছে, তেমনই বিজেপির শেষ মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামি পরাজিত হয়েছেন ভোটে। অর্থাৎ, উত্তরাখণ্ড বুঝিয়েছে, তারা বিজেপি-কে পছন্দ করতে পারে। তবে তাদের নিযুক্ত শাসককে নয়।
প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সরকার পরিবর্তন হয়েছে উত্তরাখণ্ডে। তাই ২০২২-এর বিধানসভা নির্বাচনের ফল নিয়ে সংশয়ে ছিলেন জাতীয় রাজনীতির পর্যবেক্ষকরাও। কিন্তু, এবার বিজেপি সেই ঐতিহ্য পাল্টে দিয়েছে।
এর মধ্যে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েই দেশের উত্তর-পূর্বের রাজ্য মণিপুরে ক্ষমতায় ফিরেছে বিজেপি। আগের বারের চেয়ে আরও ১০টি আসন বাড়িয়ে একক ভাবে সরকার গঠন করতে চলেছে তারা। মণিপুরে মোট ৬০টি আসনের বিধানসভায় বিজেপি পেয়েছে ৩১টি আসন। সরকার গঠন করতে ঠিক যে আসনসংখ্যা প্রয়োজন। ২০১৭-র নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছিল ২১টি আসন। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে তিনটি আসন দূরে ছিল কংগ্রেস। ২৮টি আসন পেয়ে তারা পয়লা নম্বরে ছিল। কিন্তু, এ বার সেই কংগ্রেসই মাত্র ৬টি আসন পেয়ে এক ধাক্কায় নেমে এসেছে তৃতীয় স্থানে।
অন্যদিকে, ৭টি করে আসন পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে নাগা পিপপলস ফ্রন্ট, এনপিএফ এবং জনতা দল ইউনাইটেড, জেডিইউ। বলা হয়, কেন্দ্রে যে দল ক্ষমতায় থাকে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলি মোটের উপর সেই দলের দিকেই ঝুঁকে থাকে। সেই রেওয়াজ অনুযায়ীই উত্তর-পূর্বের রাজ্য মণিপুর নিয়ে প্রথম থেকেই আত্মবিশ্বাসী ছিল কেন্দ্রের শাসক, বিজেপি।
এসবিএস বাংলার অনুষ্ঠান শুনুন রেডিওতে, এসবিএস বাংলা রেডিও অ্যাপ-এ এবং আমাদের ওয়েবসাইটে, প্রতি সোম ও শনিবার সন্ধ্যা ৬ টা থেকে ৭ টা পর্যন্ত। রেডিও অনুষ্ঠান পরেও শুনতে পারবেন, ভিজিট করুন: