প্রতিটি ম্যাচের আগে চিরায়িত নিয়মে বিশেষজ্ঞরা পিচের অবস্থা জানান। মূলত, টসের আগেই সবসময় পিচ কন্ডিশন নিয়ে মন্তব্য করেন। বিশ্লেষণ করা হয় এই পিচে কত রান করা যাবে, এই পিচটি ব্যাটিং নাকি বোলিং সহায়ক হবে উইকেট। অন্যদিকে প্রতিটি টেস্ট ম্যাচে দিন শুরুর আগেই ব্রিফ দেয়া হয়। ভারতের কলকাতায় সদ্য শেষ হওয়া বাংলাদেশে ও ভারতের মধ্যেকার দিবা-রাত্রির টেস্টের তৃতীয় দিনের আগেও মুরালি কার্তিককে নিয়ে পিচ রিপোর্ট দিতে আসেন ভারতের কিংবদন্তি ক্রিকেটার সুনীল গাভাস্কার। সেখানে তিনি বাংলাদেশ অর্ডিনারি দল বলে পিচ রিপোর্টের প্রয়োজন নেই বলেন। তিনি আরো বলেন বাংলাদেশ দলের পারফর্মেন্স 'অর্ডিনারি', টেকনিক 'অর্ডিনারি।' গোলাপি বলে প্রকৃত অনুশীলন করা ও অনুশীলন ম্যাচ না পাওয়ার বিষয়গুলো বিবেচনায় না এনে ভারতের লিজেন্ডারি ক্রিকেটার ও ধারাভাষ্যকার সুনীল গাভাস্কার যেভাবে কথাগুলো বলছিলেন, তা শোভনীয় ছিল না। ইংল্যান্ডের মাটিতে ভারত ৪২ রানে অলআউট হয়েছিল। সেখানেও অনেক ব্যাটসম্যানের হেলমেটেও বল লেগেছিল এবং কেউ কেউ আঘাতও পেয়েছিলেন।সুনীল গাভাস্কার এর বলার ধরনটা কিছুটা কটু শোনালেও ২০০০ সালে টেস্ট মর্যাদা পাওয়া বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এখন পর্যন্ত এই ফরম্যাটে মোট ১১৭ টি ম্যাচ খেলেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কী প্রাপ্তি বাংলাদেশ দলের। ক্রমাগত ব্যর্থতায় হতাশ হচ্ছেন সমর্থকরা। টেস্ট ক্রিকেটের নবীন সদস্য আফগানিস্তানের বিপক্ষে ঘরের মাঠে ২২৪ রানের বিশাল ব্যবধানে হারে বাংলাদেশ দল। এতে করে দল কিংবা বিসিবি কারো কোনো মাথা ব্যাথা যেন নেই। যেমন তেমন দল নিয়ে শক্ত প্রতিপক্ষের মোকাবেলা করাটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। ভারত সফরে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ দল দুইটি টেস্টেই তিনদিনে ইনিংস ব্যবধানে হেরে প্রমাণ করেলো তারা কোথায় আছেন। ১৯ বছরেও টেস্ট ক্রিকেট বুঝতেই চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ। ক্রিকেটে বাংলাদেশের অতীতের যৎসামান্য অর্জনকে তারা অকাতরে বিলিয়ে দিচ্ছেন অন্যকে। মূল দুর্বলতা হচ্ছে ক্রিকেটারদের টেম্পারমেন্ট ধরে রাখতে না পারা, ব্যাটসম্যানদের বাজে শট খেলে প্রতিপক্ষকে উইকেট বিলিয়ে দিয়ে আসার প্রবণতা, বাউন্স বল খেলার দুর্বলতা, যাচ্ছেতাই ফিল্ডিং, দুর্বল ও অগোছালো বোলিং লাইন। একটা যায়গায় এসে এখন এরকম ধারণা করা যেতে পারে যে ক্রিকেটের প্রতি খেলোয়াড়রা তাদের কমিটমেন্ট ধরে রাখতে পারছে না।
Bangladesh's Mushfiqur Rahim walks back to pavilion after his dismissal during the third day of the second test cricket match between India and Bangladesh. Source: AP
বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের মান উন্নয়ন এবং নিয়মিতভাবে প্র্যাকটিসের অভাব, পেসবান্ধব উইকেট তৈরি না করা, তিন ফরম্যাটের আলাদা দল গঠনে নির্বাচকদের ব্যর্থতা- এসবই বাংলাদেশের ক্রিকেটকে পেছনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সর্বশেষ ভারত সফরটাতেও রীতিমতো বিধ্বস্ত হয়েছে বাংলাদেশ। দুই ম্যাচের দুটিতেই হেরেছে ইনিংস ব্যবধানে। এখন সময় এসেছে নতুন করে পরিকল্পনা করা এবং দল সাজানোর।
এ নিয়ে বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন বলেন, ‘হ্যাঁ আমরা এটা নিয়ে ভাবছি। সত্যি সত্যি আমরা একটা প্ল্যান করেছি টেস্ট ক্রিকেটে এ ধরনের পরিস্থিতি ফেস করার জন্য আমরা একটা দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা করেছি। যেটা আপনারা দেখতে পারবেন, আমি মনে করি এটা অনেক কাজে দিবে, অন্তত ব্যাটিংয়ে ভালো হবে।’ভারতের কাছে হারের পর বাংলাদেশ টেস্ট দলের খেলোয়াড়রা একটা কথাই বলেন ‘এই সিরিজ থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে-এই বোলিংয়ের বিপক্ষে কীভাবে খেলতে হয়, পরবর্তী সময়ে কীভাবে প্রস্তুতি নেব, এই সব। এই শিক্ষাটা পরবর্তীতে এক বছর, দুই বছর বা পরের সিরিজে কাজে দেবে।’ কিন্তু প্রতিবার হারের পর একই কথা: এখন প্রশ্ন হচ্ছে উন্নতিটা কী হলো? ভারতের ইন্দোর টেস্টের দ্বিতীয় দিনের খেলা শেষে বাংলাদেশ দলের হেড কোচ রাসেল ডমিঙ্গো ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দলের কাঠামোগত বদল আনতে হবে। না হলে ফল একই হতে থাকবে। নির্বাচকদের সঙ্গে বসে সামনে এগোনোর পথ খুঁজে বের করতে হবে। তিনি আরো বলেন, চিহ্নিত করতে হবে কোন কোন খেলোয়াড় দলকে সামনে এগিয়ে নিতে পারবে। যদি আমাদের নতুন মুখ নিয়ে এগোতে হয়, কিছুটা সময় ভুগতে হয়, আমার মনে হয় বর্তমানে যা হচ্ছে সেটির চেয়ে খারাপ কিছু হবে না। তবে তিনি স্বীকার করেন, দলে দারুণ কিছু খেলোয়াড় আছে।
Indian team members shake hands after they win over Bangladesh by an innings and 46 runs during the second match in Kolkata, India, Sunday, Nov. 24, 2019. Source: AP
বাংলাদেশ দলের সাবেক কোচ ডেভ ওয়াটমোর বাংলাদেশী ক্রিকেটারদের রক্ষণাত্মক ক্রিকেট খেলার কঠোর সমালোচনা করে বলেন, হারের অন্যতম কারণ অবশ্যই রক্ষণাত্মক মনোভাব। আমি কোচ থাকাকালীন স্পষ্ট বলে দিতাম, হারতে রাজি আছি; কিন্তু লড়াই ছাড়া হারতে পারব না। মাঠে নেমে প্রতিপক্ষকে বুঝিয়ে দাও, বাংলাদেশকে ছোট দল হিসেবে দেখলে ভুল করবে। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে যে মনোভাব নিয়ে বাংলাদেশ খেলে, টেস্টে তা মোটেও দেখা যায় না।ভারতে টি-টোয়েন্টি সিরিজের প্রথম ম্যাচ জয় দিয়েই শুরু করেছিল বাংলাদেশ দল। এরপর শেষ দুই ম্যাচে সিরিজ জয়ের কাছাকাছি থেকে হেরেছে। তবে টেস্ট সিরিজটা হয়েছে যাচ্ছেতাই। দুই ম্যাচই হেরেছে ইনিংস ব্যবধানে। এক কথায় হোয়াইটওয়াশ। দলের অবস্থাও ছিল অগোছালো । কলকাতায় ঐতিহাসিক গোলাপি বলের দিনরাতের ম্যাচে টাইগাররা করেছে অসহায় আত্মসমর্পণ। যদিও দলের নতুন মুখদের দাবি ভারতের মতো দলের বিপক্ষে লড়াইয়ে তারা অনেক কিছুই শিখেছেন। দল যদি শুধু শিখতে থাকে তবে এর প্রতিফলন দেখা যাবে কখন?মোহাম্মদ শামির বাউন্সারে প্রথম দিনেই মাথায় আঘাত পেয়ে ম্যাচ থেকে ছিটকে যান লিটন দাস ও নাঈম হাসান। দ্বিতীয় দিনে ইশান্তের বাউন্সারে লুটিয়ে পড়েন মোহাম্মদ মিঠুন। উমেশ যাদবের বাউন্সারে ভড়কে যান মুশফিকুর রহিমও। এক টেস্টে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের এতবার বাউন্সারে আঘাত পাওয়ার ঘটনার ব্যাখ্যা দিয়েছেন ভারতের ব্যাটসম্যান চেতশ্বর পূজারা। এক টেস্টে দুটি কনকাশন বদলির প্রথম নজিরও তৈরি হয় এই ইডেন টেস্টে। দ্বিতীয় দিনের খেলা শেষে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘আমার মনে হয়, কৃত্রিম আলো আর গোলাপি বল এতে ভূমিকা রেখেছে। আমার মনে হয়, এই ধরনের পরিস্থিতিতে শর্ট বল পিক করা সহজ নয়, বিশেষ করে আমাদের পেসাররা যে গতিতে বল করে। আমার মনে হয়, এটা গোলাপি বলের জন্য হচ্ছে। তাদের ব্যাটসম্যানরা আগে কখনো গোলাপি বলে খেলে নি, এমনকি প্রস্ততি ম্যাচও না। কাজেই এটা একদমই সহজ ছিল না।’ এই জয়ের সঙ্গে শুধু বাংলাদেশকে ২-০ হোয়াইটওয়াশই করল না ভারত, ঘরের মাঠে টানা ১২টি সিরিজ জিতে নয়া নজিরও গড়লেন ক্যাপ্টেন কোহলি। এখানেই শেষ নয়, টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ শুরুর পর টানা সাতটি টেস্ট জিতে ৩৬০ পয়েন্ট ঘরে তুলল ভারত।
Sourav Ganguly, left, President of Indian Cricket Board waives to crowd as he stand beside his Bangladesh counterpart Nazmu Hossain, second left, Nov. 24, 2019. Source: AP