ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, করোনা পরিস্থিতিতে যে বিশ্বাসের সঙ্কট তৈরি হয়েছিল, যুদ্ধ সেই ক্ষতকে আরও গভীর করেছে। সমগ্র বিশ্ব যদি করোনাকে হারাতে পারে, তাহলে এই সঙ্কটও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে।
তিনি আরও বলেছেন, সমস্যা যাই হোক না কেন, উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে বিভাজন হোক কিংবা পূর্ব ও পশ্চিমের দূরত্ব, খাদ্য ও জ্বালানি ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সমস্যা হোক বা সন্ত্রাস, বা সাইবার নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, জ্বালানি বা জল সুরক্ষা, ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সব সমস্যার নিশ্চিত সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।
Credit: Bangladesh High Commission, New Delhi, India
এদিকে, জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে শুরুর আগে দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠক সেরেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। বৈঠকের পরে ভারত-আমেরিকা যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দু’দেশের নেতারা গণতন্ত্র, মানবাধিকার, স্বাধীনতা, বহুত্ববাদ, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলা, সব নাগরিকের সমান অধিকারের মতো বিষয়গুলিতে জোর দিয়েছেন। তাঁদের মতে, দেশের সাফল্যের জন্য এগুলো জরুরি এবং ভারত-আমেরিকা সম্পর্ক পোক্ত করার জন্যও প্রয়োজনীয়।
আধুনিকতম প্রযুক্তি, মহাকাশ এবং প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানোর পাশাপাশি যৌথ বিবৃতিতে উঠে এসেছে অসামরিক পরমাণু ক্ষেত্রে সহযোগিতার প্রসঙ্গও। বলা হচ্ছে, ভারত-আমেরিকা পরমাণু সহযোগিতাকে আরও প্রসারিত করা নিয়ে কথা হয়েছে দুই নেতার মধ্যে। পরবর্তী ধাপে স্মল মডিউলার পরমাণু চুল্লি বানাতে সমন্বয়ের কথাও উঠেছে। নিউক্লিয়ার সাপ্লায়ার্স গ্রুপ বা এনএসজি-তে ভারতের অন্তর্ভুক্তি হোক, এমনও জানিয়েছে আমেরিকা।
প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে বৈঠকের পরই এক্স মাধ্যমে একটি পোস্ট করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন লিখেছেন, আমেরিকা ও ভারতের সম্পর্ক যাতে অটুট থাকে, দুই দেশ যাতে আরও বেশি কাছাকাছি আসে, বাঁধন যেন আরও পোক্ত হয়, সেটাই নিশ্চিত করা হবে।
এদিকে, বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জানিয়েছেন, অত্যন্ত গঠনমূলক আলোচনা হয়েছে। এমন বহু বিষয় নিয়ে কথা বলা সম্ভব হয়েছে, যার দরুন দু’দেশের অর্থনীতি এবং মানুষের মধ্যে সংযোগ বাড়বে। বিশ্বের কল্যাণের জন্য আমাদের দু’দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব বড় ভূমিকা পালন করে চলবে।
অন্যদিকে, ভারত রক্তের বন্ধু হলেও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আর্থিক-বাণিজ্যিক, দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বাসভবনে বৈঠকের পরে বার্তা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে আমেরিকার হস্তক্ষেপ ও চাপের কথা যেমন তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী মোদীকে আশ্বস্ত করেছেন, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নিতান্তই বাণিজ্যিক ও আর্থিক। রক্তের সম্পর্ক মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গী ভারতের সঙ্গেই।
উল্লেখ্য, দিল্লিতে লোকমার্গ মার্গে বাড়ির দরজায় এসে হাসিমুখে হাসিনাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। বলা হয়েছে, গোটা বৈঠকটিই হয়েছে ইতিবাচক উষ্ণ আবহে। উপস্থিত ছিলেন, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল, বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন। দু’দেশের মধ্যে তিনটি সমঝোতাপত্র স্বাক্ষর হয়েছে। কৃষি ক্ষেত্রে গবেষণায় সহযোগিতার জন্য ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব রিসার্চ এবং বাংলাদেশ এগ্রিকালচারাল রিসার্চ কাউন্সিল মউ (Memorandum of Understanding) স্বাক্ষর করেছে। এ ছাড়া দু’দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিনিময় এবং দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ক্ষেত্রে রুপে (Rupay) কার্ড সংক্রান্ত চুক্তিপত্রে সই হয়েছে। যদিও বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রী আব্দুল মোমেন বলেছেন নির্বাচন নিয়ে দু-দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের কোনও কথা হয় নি।
এর মধ্যে, খলিস্তানি বিচ্ছিন্নতাবাদ বরদাস্ত করা হবে না, ভারতে এসে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনক। তিনি জানিয়েছেন, এ ব্যাপারে ভারত এবং ব্রিটেন হাত মিলিয়ে একসঙ্গে লড়াই করতে চলেছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, খলিস্তানপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বারবার হামলার ঘটনা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চান, ব্রিটেনে এরকম কোনও চরমপন্থা বা সহিংসতা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। সেই কারণেই ব্রিটেন, ভারত সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে, জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনক।
পাশাপাশি, জি-২০ সম্মেলনে ভারত মণ্ডপের কারুকার্য দেখে হতবাক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তাঁকে কোনারকের সূর্যমন্দিরের চাকার মাহাত্ম্য বুঝিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আন্তর্জাতিক জি-২০ সম্মেলন ঘিরে সাজ সাজ রব রাজধানী দিল্লিতে। অনুষ্ঠানস্থল ভারত মণ্ডপম সাজিয়ে তোলা হয়েছে শিল্প এবং কারুকার্যে। অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশের মুখে ওড়িশার কোনারকের মন্দিরের বিখ্যাত চাকাটিকে একটি প্রতিরূপও তৈরি করে রাখা হয়েছে। তার পাশে সূর্যমন্দিরের গায়ে খোদাই করা নৃত্যরত নারীমূর্তিগুলিও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সেই সাজসজ্জা নজর কেড়েছে সকলেরই।
এবারের জি-২০ সম্মেলনের পুস্তিকায় ভারতকে, গণতন্ত্রের জননী বলে উল্লেখ করেছে দিল্লি। তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই কোনারকের সূর্যমন্দিরের ওই চাকা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নকশায়। দিল্লির তরফে সম্মেলনের বাণী রাখা হয়েছে, বসুবৈধ কুটম্বকম, এক পৃথিবী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ। মধুবনী কারুকার্যে চন্দ্রযান-২ অভিযান ফুটিয়ে তোলা হল ক্যানভাসে। জাতীয় পুরস্কার বিজয়িনী শান্তিদেবী হস্তশিল্পে এই অসাধ্যসাধন করেছেন। ভারত মণ্ডপমের প্রদর্শনীতে তাঁর কাজের প্রদর্শনী। ভারত সরকারের তরফে বিশেষ আমন্ত্রণ জানানো হয়। শনিবার সকালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনক, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা-সহ অন্য রাষ্ট্রনেতারা একে একে পৌঁছান সেখানে।
অন্যদিকে, ভারত এবং ইন্ডিয়া, দেশের দুই নাম নিয়ে ক’দিন ধরেই বিতর্ক চলছে। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জি-২০’র সম্মেলনে নিজেকে ভারতের প্রতিনিধি হিসাবে হাজির করেছেন। সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর আসনের সামনে টেবিলে দেশের নাম হিসেবে লেখা আছে ভারত; অর্থাৎ, স্বদেশে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বিশ্ব নেতাদের সামনে প্রধানমন্ত্রী দেশের নাম সরকারিভাবে ভারত বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। ফলে জল্পনা চড়ল, তা হলে কি নরেন্দ্র মোদী সরকার দেশের নাম হিসাবে ইন্ডিয়া ব্যবহার বন্ধ করে দিতে চলেছে। কৌতূহল তৈরি হয়েছে জি-২০’র মতো আন্তর্জাতিক মঞ্চে কি এরপর দেশের নামের জায়গায় ভারত অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
উল্লেখ্য, দু’দিন আগেই জাতিসঙ্ঘের মুখপাত্র জানিয়েছেন, একটি দরখাস্ত জমা দিলেই তারা দেশের নাম বদলে দেবে। গত বছরই তুর্কি হয়েছে তুর্কিয়ে। ভারত ও ইন্ডিয়া, দেশের এই দুই নাম নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত জি-২০ সম্মেলন ঘিরেই হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু অতিথিদের যে নৈশভোজে যোগদানের জন্য যে নিমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছেন তাতে নিজেকে প্রেসিডেন্ট অব ভারত বলে লেখা রয়েছে।