অস্ট্রেলিয়ায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়ানো প্রতিরোধের অংশ হিসেবে এবার মসজিদ ও নামাজ সেন্টারগুলোতেও মুসল্লীদের সমাগম বন্ধ করা হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার ইমাম ও মুসলমানদের সর্বোচ্চ সংস্থা দি অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইমামস কাউন্সিল (ANIC) ইতোমধ্যে এ বিষয়ে ফতোয়া (ধর্মীয় বিধান সংক্রান্ত অভিমত) দিয়েছে এবং অস্ট্রেলিয়ার মুসলমানদেরকে শুক্রবারে মসজিদে এসে জুম্মার নামাজ পড়তে নিষেধ করেছে তারা।
তাদের একটি স্টেটমেন্টে বলা হয়েছে,
“আল্লাহর হুকুমের উপর বিশ্বাস মানুষকে কোনো রোগ-প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ গ্রহণে ও উপায়-উপকরণ ব্যবহারে বাধা দেয় না।”
এদিকে, লেবানিজ মুসলিম অ্যাসোসিয়েশন এর পক্ষ থেকে একটি স্টেটমেন্টে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের কারণে সতর্কতা ব্যবস্থা হিসেবে সাময়িকভাবে মসজিদ ও নামাজ সেন্টারগুলোতে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্তের নামাজ ও জুম্মার নামাজ বন্ধ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার, ১৯ মার্চ থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকরা করা হয়েছে সিডনির নিম্নলিখিত মসজিদ ও প্রেয়ার হলগুলোতে:
ইমাম আলী ইবনে আবু তালিব, লাকেম্বা মসজিদ; উসমান ইবনে আফ্ফান, ক্যাবরাম্যাটা মসজিদ; ইয়াং মস্ক; খালেদ ইবনে আল ওয়ালিদ (যায়েদেন) মসজিদ, গ্রিন একর; এল মিনেহ অ্যাসোসিয়েশন, পাঞ্চবৌল; মসজিদ আল মুস্তাফা, মেরিল্যান্ড এবং এল দানিয়েহ অ্যাসোসিয়েশন, ভিলাউড।
এই সিদ্ধান্ত সমর্থন করেছে নিম্ন-লিখিত অ্যাসোসিয়েশনগুলো:
লেবানিজ মুসলিম অ্যাসোসিয়েশন; ইসলামিক কাউন্সিল অফ নিউ সাউথ ওয়েলস; খালেদ ইবনে আল ওয়ালিদ (যায়েদেন) মস্ক; এল মিনেহ অ্যাসোসিয়েশন; এল দুনিয়েহ সন্স চ্যারিটি অ্যাসোসিয়েশন; বাখৌন অ্যাসোসিয়েশন; ট্রিপোলি অ্যান্ড ফায়হা অ্যাসোসিয়েশন; রিজেন্টস পার্ক ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশন এবং আকার ইউনিটি অ্যাসোসিয়েশন।
নিম্ন-লিখিত ইমামরাও এটি অনুমোদন করেছেন:
শেইখ মালেক জিদান; শেইখ ইয়াহিয়া সাফি; শেইখ নাবীল সাকারি; শেইখ ফওয়াজ কামাজ; শেইখ হাসান জিদান; শেইখ আরেফ চাকার; শেইখ বিলাল আলী এবং শেইখ মৌসাব লাগা।মেলবোর্নে আলফ্রেড হসপিটাল মুসাল্লায় নামাজ পড়ান মোল্লা মো. রাশিদুল হক। তিনি বলেন,
Molla Mohammad Rashidul Huq. Source: Supplied
“মেলবোর্নে কয়েকটা মসজিদে জুম্মার নামাজ আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। আমি যে মসজিদে, মুসাল্লায় খুতবা দিই সেখানে আমরা আজকে (শুক্রবার, ২০ মার্চ) থেকে জুম্মা বাতিল করেছি। আমরা বলেছি, আপনারা বাসায় গিয়ে যুহর পড়েন।”
“ওয়াক্তিয়া নামাজের কোনো জামা’ত হবে না। কেউ যদি এসে ব্যক্তিগতভাবে পড়তে চায়, পড়তে পারবে।”
ধর্মীয় বিষয়ে মানুষের সংবেদনশীলতা সম্পর্কে তিনি বলেন,
“অনেকে খুব ইমোশনাল হয়ে যায়, বলে, ভাই, আমার নামাজ আমি পড়বো, আপনি বলার কে? আমার বক্তব্য, ঠিক আছে ভাই, আপনি পড়েন। কিন্তু, আপনার দ্বারা যে দশজনে এফেক্টেড হচ্ছে, সেটার কী হবে?”
করোনাভাইরাস যেহেতু সংক্রামক রোগ, তাই তারা চান না এর সংক্রমণ হোক, বলেন তিনি।
তার মতে, “অনেকে হয়তো বুঝবে না যে, সে আক্রান্ত হয়েছে। সে তখন চলে আসবে নামাজ পড়তে।” তখন এটা নানাভাবে অন্যান্য মুসল্লিদের মাঝে ছড়াবে।
মোল্লা হক বলেন,
“আমার ব্যক্তিগত অপিনিয়ন হচ্ছে যে, আপাতত যেখানে জন-সমাগম হচ্ছে, ১০ জন বা তার অধিক, সেগুলো আমাদের পরিহার করা উচিত। এমনকি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের যে জামা’ত, সেটাও যদি দেখা যায় যে রিস্ক, তাহলে সেটাও অ্যাভয়েড করা উচিত। প্রত্যেককে হয়তো বাসায় থেকেই নামাজ পড়া উচিত, আপাতত কিছু দিন। যত দিন পর্যন্ত না এই করোনাভাইরাস ছড়ানোর রিস্কটা আমাদের মধ্য থেকে যাচ্ছে।”
তার মতে, “দ্বীন (ধর্ম) আমরা পালন করবো, আমি নিজেও একজন ধার্মিক মানুষ। কিন্তু, এর কারণে যেন আমি নিজে ক্ষতিগ্রস্ত না হই এবং অন্যান্যদেরকেও ক্ষতিগ্রস্ত না করি।”অস্ট্রেলিয়ান মুসলিম ওয়েলফেয়ার সেন্টারের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়া বলেন,
Members of the muslim community celebrate Eid al-Fitr, at Lakemba Mosque in Sydney. Source: AAP Image/Dean Lewins
“আমরা হেলথ ডিপার্টমেন্ট থেকে চিঠি পেয়েছি।”
“আমাদের অস্ট্রেলিয়ান মুসলিম ওয়েলফেয়ার সেন্টারে আমি গতকালই আমাদের সানডে ক্লাস স্থগিত করেছি।”
অন্যান্য কার্যক্রমও সাময়িকভাবে বন্ধ করেছেন বলে তিনি জানান।
এই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা সমর্থন করে তিনি বলেন,
“বলা হচ্ছে যে, এক (১.৫ মিটার) দূরে থাকতে হবে। আমাদের তো নামাজে পাশাপাশি দাঁড়াতে হয়। বিশেষত, জুম্মার নামাজে আমাদের অনেক লোক হয়। লাকেম্বা মসজিদে প্রায় হাজার লোক হয়ে যায়।”
এসবিএস বাংলাকে তিনি বলেন,
“আমি অস্ট্রেলিয়াতে প্রায় ৩১ বছর ধরে বাস করছি। আজই প্রথম দিন আমি জুম্মার নামাজে যেতে না পেরে ঘরে যুহর নামাজ পড়তে বাধ্য হচ্ছি।”
তবে তিনি স্বীকার করেন যে, এটি কোনো অধর্মীয় কিংবা নতুন কোনো ব্যবস্থা নয়। ইতোপূর্বে এ রকম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, বলেন তিনি। তার মতে, ধর্মীয় শিক্ষার সঙ্গে এটি সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ।
তিনি বলেন,
“আমরা মুসলমান হিসেবে দেখতে হবে যে, ল অফ দ্য ল্যান্ড এবং শরীয়াহ কী বলে। দু’টাকে যদি সমন্বিত করি তাহলে আমাকে ঐভাবেই চলতে হবে। আমার জন্য যেন আরেক ভাইয়ের অসুবিধা না হয়। As a citizen that is our duty to save myself and save others.”
বাংলাদেশ সিনিয়র্স সিটিজেন্স অফ অস্ট্রেলিয়ার সেক্রেটারি আরজু হোসেন এর আগে নয় বছর অস্ট্রেলিয়ান মুসলিম ওয়েলফেয়ার সেন্টারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। মসজিদে নামাজ বন্ধ হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন,
“আমাদের ইসলামিক রিলিজিয়ন এবং আমাদের মুসলমানদের যে নিয়ম-কানুন আছে, এগুলো কিন্তু খুব ইজি (সহজ) এবং শিথিল এবং আমাদের জন্য খুবই ফ্লেক্সিবিলিটি (নমনীয়তা) আছে।”
বর্তমান ইমাম কাউন্সিল এবং অস্ট্রেলিয়ান সরকারের নেওয়া সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তিনি বলেন,
“আমার কাছে মনে হয়, মুসলিম হিসেবে, এই ডিসিশনটা সম্পূর্ণ রাইট এবং সঠিক এবং সঠিক সময়ের সঠিক সিদ্ধান্ত।”
“গভার্নমেন্ট যে ডিসিশনটা নিয়েছে, সেটা সঠিক সিদ্ধান্ত এবং আমাদের সকলেরই সহযোগিতা করা উচিত বলে আমি মনে করি, মুসলমান হিসেবে এবং অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক হিসেবে।”চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট ও ট্যাক্স অ্যাডভাইজার সৈয়দ আকরাম উল্লা বলেন,
Syed Akram Ullah. Source: Supplied
“আমরা যে দেশে থাকি এটা ইসলামিক সরকার না।”
যে-সমস্ত দেশগুলোতে ইসলামী সরকার আছে, যেমন, সৌদি আরবে, সে বিষয়ে তিনি বলেন,
“সৌদি আরবেও কিন্তু শুধু মক্কা এবং মদীনা ছাড়া সব মসজিদ বন্ধ করা হয়েছে।”
“আমাদের যারা মুসলিম কমিউনিটির লিডার আছেন, উনারাও বেশিরভাগ মসজিদ বন্ধ করার পরামর্শ দিয়েছেন।”
মসজিদে গিয়ে জুম্মার নামাজ আদায় করার সুযোগ না থাকায় সমাধান হিসেবে বিকল্প প্রস্তাব দেন সৈয়দ আকরাম উল্লা। তিনি বলেন,
“আমাদের অফিসে আমরা হয়তো ছোট পরিসরে জুম্মার নামাজ (আদায়ের ব্যবস্থা) করতে পারি। অফিসে যদি চার-পাঁচ জন থাকে।”
“ঘরেও যদি তিন জন থাকে, কিংবা কোনো অফিসে যদি তিন জন থাকে, হয়তো সীমিত পরিসরে জুম্মার নামাজ (আদায়) করা যেতে পারে।”
দেশের আইন মানার প্রতি জোর দেন তিনি।
“এখানে তো সরকার যেটা বলেছে সেটা অবশ্যই আমাদের মানতে হবে।”
ইসলামী ট্রাডিশনের সঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যথার্থ সমন্বয় সাধনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। জুম্মার নামাজ মুসলমানদের জন্য ফরজ। মুসলিম নেতৃবৃন্দ যেন এর জন্য সরকারের সঙ্গে আলোচনা প্রক্রিয়াটা অন্তত শুরু করেন, যেন যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা অবলম্বনের মাধ্যমে নামাজ আদায়ও করা যায়, সেজন্য মুসলিম নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।লাকেম্বার বাংলাদেশী হেয়ারড্রেসার কাজী শামসুল আলম বলেন,
Qazi Shamsul Alam. Source: Supplied
“আমি একজন মুসলমান হিসেবে এই উদ্যোগটিকে আমি তাদেরকে আসলে সাধুবাদ জানাই।”
কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে তিনি বলেন,
“তারা সবার কথা চিন্তা করেই এ কাজটা করেছে।”
“নিজেকে আসলে সেফ রাখতে হবে। আপনি লোকজনের সাথে না মিশলে, নিজের মতো যদি থাকতে পারেন, সেই সব দৃষ্টিকোণ থেকেই সরকারের সাথে এবং সবাই আলোচনার প্রেক্ষিতে আসলে তারা এই উদ্যোগটা নিয়েছে যে, আপাতত জামাত বন্ধ এবং সবাই নিজ নিজ ইবাদত, যারা ধর্মীয়ভাবে করে, সবাই যেন তাদের নিজস্বভাবে বাসায় করে।”
তিনি মুসলমানদের উদ্দেশে বলেন,
“সবাই নিজে নিজে সেফ থাকেন, নিজের ইবাদতটা বাসায় করেন, তাহলে আপনিও যেমন রক্ষা পাবেন, তেমন আপনার আরেকটা ভাই, আরেকটা বোন, সে-ও রক্ষা পাবে।”
কাবা শরীফ ও মসজিদে নববী ছাড়া সৌদি আরবের সকল মসজিদে জামাতে নামাজ আদায় বন্ধ
বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) বিস্তার রোধে ইতোপূর্বে সৌদি আরবের সকল মসজিদে জামাতে নামাজ আদায় করা বন্ধ করে কর্তৃপক্ষ। গত মঙ্গলবার, ১৭ মার্চ সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে এ ঘোষণা দেওয়া হয়।
বলা হয়েছে, মসজিদের দরজা অস্থায়ীভাবে বন্ধ রাখা হবে, তবে নামাজের সময় মুয়াজ্জিনদের আজান দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে।
সেখানে আজানের সময় মসজিদে নামাজ পড়তে আসার নিয়মিত আহ্বান ‘হাইয়্যা আলাস্ সালাহ্’ (নামাজ পড়তে আসুন) এর পরিবর্তে নতুন আজানে বলা হচ্ছে, বাড়িতে থেকে (অথবা আপনি যেখানে আছেন সেখান থেকেই) নামাজ পড়ুন।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের একটি প্রতিবেদনে সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় সংস্থা এসপিএ’র সূত্র উল্লেখ করে বলা হয়েছে, কেবল মক্কায় কা’বা শরীফ ও মদীনায় মসজিদে নববীতে নামাজ আদায় করা যাবে।
এদিকে, করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে বাংলাদেশের বাগেরহাটের বিশ্ব-ঐতিহ্য ষাটগম্বুজ মসজিদ ও আশেপাশের সব পর্যটন এলাকায় দর্শনার্থীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে কর্তৃপক্ষ।
ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে বাগেরহাট প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কাস্টোডিয়ান গোলাম ফেরদাউস এ নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।
মঙ্গলবার বিকাল পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, যে-সব ব্যক্তি সম্প্রতি বিদেশ ভ্রমণ করে এসেছেন কিংবা সুনিশ্চিতভাবে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত কারও সংস্পর্শে এসেছেন এবং গত ১৪ দিনে তার শরীরে এর লক্ষণ দেখা দিয়েছে, তাদেরকে কোভিড-১৯ পরীক্ষা করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
আপনি যদি মনে করেন যে, আপনি এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, তাহলে আপনার ডাক্তারকে কল করুন। ডাক্তারের কাছে যাবেন না। আপনি ন্যাশনাল করোনাভাইরাস হেলথ ইনফরমেশন হটলাইনেও কল করতে পারেন এই নম্বরে: 1800 020 080
আপনার যদি শ্বাস-কষ্ট কিংবা মেডিকেল ইমার্জেন্সি দেখা দেয়, তাহলে 000 নম্বরে কল করুন।