ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে পারিবারিক কারণে সপরিবারে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন সিডনির ইস্টলেকের সনিয়া সহিদ সুমি। করোনাভাইরাসের সঙ্কটের কারণে তারা সবাই সেখানে আটকে পড়েন।
তারপর একসময় যখন তিনি অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে আসতে চান, তখন তিনি লক্ষ করেন যে, ফেসবুকে তার মতো অনেকেই ব্যক্তিগত পোস্টে এবং বিভিন্ন গ্রুপে নানা রকম মন্তব্য করছেন। তবে, এর ফলে কোনো সমাধান দেখা যাচ্ছে না।
অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশী নারীদের অন্যতম অনলাইন প্লাটফর্ম ফেসবুক গ্রুপ অজিস বাংলা সিস্টারহুড। এতেও সনিয়া অনেক আলোচনা হতে দেখতে পান। তখন তিনি অনুভব করেন যে, এ বিষয়ে সুসংগঠিত ও সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া দরকার। মূলত এই কারণেই এপ্রিলের ২ তারিখে তিনি নিজেই ফেসবুকে “স্টাক অজি বাঙালি” নামে একটি গ্রুপ খোলেন।
তিনি তার মতো আটকে পড়া বাংলাদেশী অস্ট্রেলিয়ানদের প্রতি আহ্বান জানান যোগাযোগ করার জন্য। এভাবে তিনি আগ্রহীদের অনলাইনে একত্রিত করেন এবং তাদের নাম ও যোগাযোগের তথ্য সংগ্রহ করেন। এরপর তিনি সে-সব তথ্য ঢাকায় অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনে পাঠিয়ে দেন এবং এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন।
এদিকে, বাংলাদেশে আটকে পড়া বাংলাদেশী অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক ও স্থায়ী অভিবাসীদেরকে অস্ট্রেলিয়ায় ফিরিয়ে আনার বিষয়ে অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রাথমিকভাবে উদ্যোগ নিয়েছিল সিডনির মাল্টিকালচারাল সোসাইটি অফ ক্যাম্পবেলটাউন ইনক। সংগঠনটির সভাপতি এনাম হক, সিনিয়র সহ-সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম এবং জেনারেল সেক্রেটারি মো. শফিকুল আলম স্ব-উদ্যোগে ডিপার্টমেন্ট অফ ইমিগ্রেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এক পর্যায়ে মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর সঙ্গেও দেখা করেন এবং বাংলাদেশে আটকে পড়া বাংলাদেশী অস্ট্রেলিয়ানদেরকে ফিরিয়ে আনার অনুরোধ করেন।
এরপর, বিশেষ একটি বাণিজ্যিক ফ্লাইটের ব্যবস্থা করে প্রথম দফায় ২৯০ জনের একটি দলকে ফিরিয়ে আনা হয় গত ১৭ এপ্রিল শুক্রবার। শ্রী লঙ্কান এয়ারলাইন্সের সেই বিশেষ ফ্লাইটটি মেলবোর্নে পৌঁছায়। এই ফ্লাইটির মাধ্যমে তাদের সবাইকে নিয়ে আসা সম্ভব হয় নি। তাই ফিরে আসতে আগ্রহী অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক ও স্থায়ী অভিবাসীদের জন্য দ্বিতীয় একটি ফ্লাইটের ব্যবস্থা করা হয়। ৯ মে দ্বিতীয় ফ্লাইটে ঢাকা থেকে মেলবোর্নে আসেন ২২০ জন যাত্রী।
সিডনির সনিয়া সহিদ সুমি তখন ঢাকাতেই ছিলেন। তিনি বলেন,
“দ্বিতীয় এই ফ্লাইটটি অনেক কস্টলি ছিল। ২৪৯০ ডলার। বাচ্চাদের জন্যও একই প্রাইস।”
নগদ অর্থ এবং অন্যান্য কারণে অনেকেই এই ফ্লাইটটিতে আসতে পারেন নি।
ঢাকাস্থ অস্ট্রেলিয়ান হাই কমিশনের উদ্যোগে তৃতীয় ফ্লাইটটি ১৮০ জন যাত্রী নিয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছেড়ে যায় বুধবার ১০ জুন। বাংলাদেশে নিযুক্ত অস্ট্রেলিয়ান হাই কমিশনার জেরেমি ব্রুয়ার যাত্রীদের বিদায় জানাতে বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন। সেই সময়ে তিনি শ্রী লঙ্কান এয়ারলাইন্সের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্তৃপক্ষের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জানান।
বিমানটিতে নিউ জিল্যান্ডের দু’জন নাগরিকও ছিলেন। তারা অস্ট্রেলিয়া হয়ে নিউ জিল্যান্ড যাবেন। এটি মেলবোর্নে পৌঁছে ১১ জুন।
এই ফ্লাইটটিতে সুমি তার স্বামী-সন্তানসহ অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে আসেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন,
“১২৫০ মার্কিন ডলার চার্জ করা হয় ইকনমি ক্লাসের জন্য। এয়ারলাইন্সে কোভিড-১৯ এর জন্য একটু ডিফরেন্ট ছিল। তারা কোনো ড্রিঙ্কস সার্ভ করে নি এবং হ্যান্ড লাগেজে স্পেস কম ছিল। তাই সমস্যা হয়েছে।”
“এত বড় একটা জার্নি, এতে কোনো বিনোদনের ব্যবস্থা ছিল না। বাচ্চাদের অনেক কষ্ট হয়েছে।”
বাংলাদেশ থেকে যাওয়া বিশেষ ফ্লাইটগুলোর জন্য মেলবোর্নই একমাত্র পোর্ট অফ এন্ট্রি। যাত্রীরা সেখান থেকে সিডনি কিংবা অন্যান্য রাজ্যে যেতে পারবেন মেলবোর্নে ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে থাকার পর। কোয়ারেন্টিনে থাকার সময়কালের যাবতীয় ব্যয়-ভার অস্ট্রেলিয়ান সরকার বহন করবে।
তৃতীয় ফ্লাইটের মাধ্যমে মেলবোর্নে আগত যাত্রীদের সবাইকে এখন নিয়মানুসারে কোয়ারেন্টিনে থাকতে হচ্ছে।
মেলবোর্নে কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থাপনার প্রশংসা করেন সুমি।
“কোয়ারেন্টিনের জন্য মেলবোর্নে হোটেল সার্ভিস অনেক ভাল।”
কোভিড-১৯ এর এই সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে আসতে পেরে আনন্দিত সুমি। তিনি এই ফ্লাইটগুলোর পেছনে ভূমিকা রাখা সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন,
“আমাদের এই কঠিন যাত্রাপথে বিভিন্ন সময়ে আমাদের সবাইকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছেন অনেকে। এদের মধ্যে রয়েছেন ক্যাম্বেলটাউনের কাউন্সিলর মাসুদ চৌধুরী, মেলবোর্নের ট্রাভেল এজেন্ট বাঁধন খন্দকার, ভিবিসিএফ-এর মোশাররফ হোসেন রেহান এবং মিল্টন ট্রাভেলের মাহতাব খান-সহ অনেকেই।”
অস্ট্রেলিয়ায় নিরাপদে ফিরে এলেও বাংলাদেশে আটকে পড়া অস্ট্রেলিয়ানদের জন্য কাজ চালিয়ে যেতে চান সুমি। তিনি বলেন,
“এ পর্যন্ত তিনটি ফ্লাইটের ব্যবস্থা করা হলেও এখনও অনেকেই বাংলাদেশে আটকে রয়েছেন যারা অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে আসতে চান। আমি নিজে অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে এলেও এখান থেকেই তাদের জন্য কাজ করতে চাই। এবং করছিও। এই গ্রুপের কার্যক্রম এখনও চলছে।”
এ পর্যন্ত প্রায় ৭০০ জন অস্ট্রেলিয়ান বাংলাদেশ থেকে অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে এসেছেন। এক্ষেত্রে সহযোগিতা করার জন্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার ফরেন মিনিস্টার ম্যারিস পেইন।
Follow SBS Bangla on .