২০১৬ সালের ১ জুলাই, রাতে ঢাকার গুলশনে হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা চালায় জঙ্গিরা। রাত ৯টার দিকে বাংলাদেশের রাজধানীর গুলশান-২-এর ৭৯ নম্বর সড়কের পাশে অবস্থিত হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিরা অস্ত্রের মুখে দেশি-বিদেশি অতিথিদের জিম্মি করে। পরে রাতেই ওখানে অভিযান চালাতে গিয়ে পুলিশের দুই কর্মকর্তা রবিউল করিম ও সালাউদ্দিন খান নিহত হন। এছাড়াও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ৩১ সদস্য ও র্যাব-১ এর তৎকালীন পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তুহিন মোহাম্মদ মাসুদসহ ৪১ জন আহত হন।পরদিন ২ জুলাই ভোরে সেনা কমান্ডোদের পরিচালিত ‘থান্ডারবোল্ট’ নামের অভিযানে পাঁচ জঙ্গিসহ ছয়জন নিহত হয়। এরপর পুলিশ সেখান থেকে ১৮ বিদেশিসহ ২০ জনের লাশ উদ্ধার করে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আরও একজন রেস্তোরাঁকর্মী। আর কমান্ডো অভিযানের আগে ও পরে ৩২ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়।গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলা মামলায় ৭ জনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত।
Suspects react from the prison van during the verdict day of Holey Artisan Attack case in Dhaka, Bangladesh, 27 November 2019. Source: EPA
প্রায় তিন বছর আগে বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বকে স্তম্ভিত করে দেয়া গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারির নারকীয় হত্যার ঘটনায় ৭ জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন বাংলাদেশের সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল।অপরাধ প্রমাণিত হওয়া আদালত জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী, রাকিবুল হাসান রিগান, আসলাম হোসেন ওরফে রাশেদুল ইসলাম ওরফে র্যাশ, সোহেল মাহফুজ, হাদিসুর রহমান সাগর, শরিফুল ইসলাম ও মামুনুর রশিদকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা নির্দেশ দিয়েছেন।
ওই হামলায় জড়িত মোট ২১ জনকে চিহ্নিত করা হলেও জীবিত ৮ জনকে এই মামলায় আসামি করা হয়। এদের মধ্যে শরিফুল ও মামুনুর বাদে অন্য ৬ আসামি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। পরে ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বহুল আলোচিত এ মামলার বিচার শুরু হয়।এরপর আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ২১১ জন সাক্ষীর মধ্যে ১১৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ, আত্মপক্ষ সমর্থনে আসামিদের বক্তব্য উপস্থাপন এবং উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে রায় ঘোষণা করেন আদালত।
হামলার কারণ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে চার্জশিটে বলা হয়, এই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী হলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম আহমেদ চৌধুরী। ভয়াবহ এই হামলায় চিহ্নিত ২১ জনের মধ্যে পাঁচজন সরাসরি অংশ নেন। বাকিরা হামলার পরিকল্পনা, সমন্বয়, প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র-বোমা সংগ্রহসহ বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িত ছিলেন।হামলার মূল প্রশিক্ষক (মাস্টার ট্রেইনার) মেজর জাহিদ কিংবা তানভির কাদেরি, নুরুল ইসলাম মারজান ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ আসামি। গুলশান হামলার জন্য বগুড়ার দুই জঙ্গিকে নিয়োগ করেন রাজীব আর বসুন্ধরায় বাসা ভাড়া ও জঙ্গিদের উদ্ধুদ্ধও করেন তিনি। জঙ্গি সাগর সীমান্তের ওপার থকে আনা অস্ত্র ঢাকায় মারজানের কাছে পৌঁছান।বাশারুজ্জামান মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ থেকে দুই দফা হুন্ডির মাধ্যমে আসা ২০ লাখ টাকা গ্রহণ করেন এবং সেই টাকা গুলশান হামলায় ব্যবহৃত হয়। যারা এই হামলা চালিয়েছিল তারা ৫ থেকে ৬ মাস ধরে পরিকল্পনা করেছিল। সেখানে হামলা চালানো জঙ্গিদের উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করা। বিশ্বের বড় বড় জঙ্গি সংগঠনের অনেক অস্ত্রশস্ত্র আছে। তাই তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে এসব অস্ত্রশস্ত্র এবং প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তা পাওয়া যাবে এমন ধারণা ছিল জঙ্গিদের। আর সরকারকে বেকায়দায় ফেলতেও জঙ্গিরা এই হামলা চালিয়েছিল।ওই জঙ্গি হামলায় বেশ কিছু জাপানি নাগরিক নিহত হয়েছিল এই রায় গোষণার পর দ্রুততার সঙ্গে বাংলাদেশের আদালত গুলশানের হলি আর্টিজানে হওয়া সন্ত্রাসী হামলার রায় দেওয়াতে সন্তোষ প্রকাশ করেছে জাপান।ঢাকায় নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত নাওকি ইতো লিখিত প্রতিক্রিয়ায় সংবাদ মাধ্যমগুলোকে এই সন্তুষ্টির কথা জানান। রায়ের প্রতিক্রিয়া জানতে গিয়ে নাওকি ইতো জানান, ‘আমরা আদালতের রায় নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। তবে, বাংলাদেশের আদালত দ্রুত বিচারে পৌঁছেছেন, এটা প্রশংসনীয়।’
Bangladeshi police escort a person (C), who is accuse of being involved in an attack on the Holey Artisan Bakery. Source: EPA
জাপানের রাষ্ট্রদূত নাওকি ইতো বলেন, হলি আর্টিজান হামলার রায় উপলক্ষে আমি আবারও শোকাহত পরিবারগুলোর প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। পূর্বের ন্যায় ঢাকার জাপান দূতাবাস বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায় জাপানি নাগরিকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিতে কাজ করবে। পাশাপাশি আমরা জাইকা বাস্তবায়িত প্রকল্পসহ জাপানের বিভিন্ন কোম্পানিতে কর্মরত জাপানি নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে একযোগে সর্বাত্মকভাবে কাজ করব। উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হওয়া জঙ্গি হামলায় যেসব বিদেশি নাগরিক নিহত হন, তাদের মধ্যে সাতজন জাপানি নাগরিক ছিলেন। ওই দিন সেখানে মোট আটজন জাপানি নাগরিক রাতের খাবার খেতে হলি আর্টিজানে গিয়েছিলেন। হামলার ঘটনায় সৌভাগ্যক্রমে তাদের মধ্যে একজনকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল। আর যেসব জাপানিরা সেদিন নিহত হয়েছিলেন তারা সবাই মেট্রোরেল প্রকল্পে কর্মরত ছিলেন।
ওই হামলার পর ঢাকায় বসবাসরত জাপানি নাগরিকদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। এমনকি অনেকেই তড়িঘড়ি করে বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। তবে, অবস্থা স্বাভাবিক হওয়ার কিছুদিন পর তাদের অনেকেই আবারও ঢাকায় ফিরে আসেন।
হলি আর্টিজানে হামলায় জাপানি নাগরিক নিহত হওয়ার পরপরই বাংলাদেশ সরকার দেশে চলমান জাপানের বিভিন্ন প্রকল্পে নিরাপত্তা জোরদার করে। পাশাপাশি প্রকল্পগুলো যেন সচল থাকে, এই লক্ষ্যেও নানা উদ্যোগ হাতে নেয় সরকার।
অন্যদিকে এই রায়ের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক বিবৃতি দিয়েছে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলা মামলায় ৭ জনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। আদালতের এই রায়কে বাংলাদেশের জন্য মাইলফলক স্বরূপ বলে জানিয়েছে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস।
বুধবার এক বিবৃতিতে ঢাকায় অবস্থিত মার্কিন দূতাবাস এ তথ্য জানিয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ২০১৬ সালের জুলাই মাসে ঢাকার গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলার বিচার সমাপ্ত হওয়ার বিষয়টি লক্ষ্য করেছে। আজকের রায়ের ফলে সেদিনের নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের কিছুটা হলেও কষ্টের অবসান হবে।
এতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র এ হামলার পুরো তদন্ত কাজে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা করতে পেরে সম্মানিত। আমরা বাংলাদেশকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই এবং বিশেষ করে আইনের শাসন পরিস্থিতির উন্নয়নে সহায়তা অব্যাহত রাখার ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ।
এতে আরও বলা হয়, এই ভাব গম্ভীর মুহূর্তে হত্যাকাণ্ডের শিকার সাধারণ নাগরিক এবং ঘৃন্য ওই সন্ত্রাসী হামলার মোকাবেলায় হতাহত বাংলাদেশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের প্রিয়জনদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র পুনরায় গভীরতম শোক প্রকাশ করছে।
বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম মনে করেন তিন বছর আগে ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে নজিরবিহীন জঙ্গি হামলায় দেশের ভাবমূর্তি যতটুকু ম্লান হয়েছিল, মৃত্যুদণ্ডের রায়ের মধ্য দিয়ে তা পুনরুদ্ধার হয়েছে। সন্ত্রাসী এই হামলার ঘটনায় সাতজন জাপানি ছাড়াও, ইতালির নয়জন, ভারতের একজনসহ তিনজন বাংলাদেশি নিহত হন।