সত্যজিৎ রায় তার চলচ্চিত্রে যে ভাষা-ভঙ্গি ও অভিব্যক্তি ব্যবহার করেছেন তার প্রাসঙ্গিকতা এখনো ফুরিয়ে যায়নি: ইমরান ফিরদাউস

গত ২ মে ছিল প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালী চলচ্চিত্র নির্মাতা-লেখক সত্যজিৎ রায়ের (Satyajit Ray)জন্ম শতবার্ষিকী।

গত ২ মে ছিল প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালী চলচ্চিত্র নির্মাতা-লেখক সত্যজিৎ রায়ের (Satyajit Ray) জন্ম শতবার্ষিকী। Source: Dilip Banerjee/The India Today Group via Getty Images

গত ২ মে ছিল প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালী চলচ্চিত্র নির্মাতা-লেখক সত্যজিৎ রায়ের জন্ম শতবার্ষিকী। অসাধারণ নির্মাণ কৌশলের কারণে সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রগুলো হয়ে উঠেছে চিরায়ত, আজও দর্শকদের কাছে সমাদৃত।


সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র নিয়ে এসবিএস বাংলা কথা বলেছে চলচ্চিত্র নির্মাতা-গবেষক এবং ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি সিডনি'র স্ক্রীন স্টাডিজের পিএইচডি ক্যান্ডিডেট ইমরান ফিরদাউসের সাথে। 


গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো 

  • ৩৭ বছরের ফিল্মমেকিং ক্যারিয়ারে সত্যজিৎ রায় ৩৬টি সিনেমা করেছেন এবং প্রায় সকল সময়েই সিনেমার বিষয় ও আঙ্গিকের মধ্যে দিয়ে বিশ্বজনীনতা বা সার্বজনীনতার প্রয়োগ ও চর্চা করে গেছেন। 
  • সত্যজিৎ রায় ভক্ত ছিলেন ১৯৩০-৪০ দশকের আমেরিকান ছবির, তার সিনেমায় জন ফোর্ড, বিলি ওয়াইল্ডার, ফ্র্যাংক কাপরা এবং জর্জ স্টিভেন্স ছাড়াও ইটালিয়ান ফিল্মমেকার ভিত্তোরিও দে সিকার ফিল্মমেকিং স্টাইল এর প্রভাব দেখা যায়।
  • শিল্প হিসেবে বা শৈলী নির্মাণের ক্ষেত্রে সাইকেডেলিক (Psychedelic) আর্টের কন্টেক্সচুয়ালাইজেশন তার একটি বড়ো অস্ত্র এবং এটি দারুণভাবে তিনি প্রয়োগ করেছেন 'হীরক রাজার দেশে' সিনেমায়।
ইমরান ফিরদাউস এসবিএস বাংলায় আপনাকে স্বাগত। এবছর সত্যজিৎ রায়ের জন্ম শতবার্ষিকী পালিত হচ্ছে, তার প্রধান চলচ্চিত্রগুলো নির্মিত হয়েছিল ৫০, ৬০ এবং ৭০ দশকে। এই যুগে সিনেমার ভাষা, কৌশল সেইসাথে সামাজিক মূল্যবোধ বা দৃষ্টিভঙ্গিরও অনেক পরিবর্তন এসেছে, এই জায়গায় এসে সত্যজিৎ রায় এখনো কতটুকু প্রাসঙ্গিক?

- প্রাসঙ্গিকতার একটি আপেক্ষিক দিক থাকলেও, এটি বলতে হয় যে কোন ব্যক্তিমানুষের বা ধারণা বা বস্তুর প্রাসঙ্গিকতার নির্ভর করে বিদ্যমান বা সমসাময়িক সমাজ কতটুকু ইতিহাস থেকে বা সময় থেকে শিক্ষা নিচ্ছেন তাদের অন্তর্দৃষ্টি উন্মোচনের জন্য। 

এই প্রেক্ষাপট থেকে ব্যক্তি সত্যজিৎ রায় বা শিল্পী সত্যজিৎ রায় বা ফিল্মমেকার সত্যজিৎ রায় এর প্রাসঙ্গিকতা রয়েই যায়। একজন প্রায় ক্ল্যাসিক্যাল ফিল্মমেকার হিসেবে তিনি ৫০, ৬০ এবং ৭০ দশকে যে ধরনের চলচ্চিত্র ভাষা-ভঙ্গি ও অভিব্যক্তির ব্যবহার ও প্রয়োগের কোশেশ করেছেন তার জরুরত এখনো ফুরিয়ে যায় নাই। 

৩৭ বছরের ফিল্মমেকিং ক্যারিয়ারে তিনি দৈর্ঘ্য বিবেচনায় ছোট-বড় -মাঝারি মিলিয়ে ৩৬টি সিনেমা করেছেন। এবং প্রায় সকল সময়েই রায় সিনেমার কন্টেন্ট বা বিষয় ও ফর্ম বা আঙ্গিক এর মধ্যে দিয়ে বিশ্বজনীনতা বা সার্বজনীনতার প্রয়োগ ও চর্চা করে গেছেন। 



যে কারণে, তাঁর সিনেমায় প্রধান চরিত্রের প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালি শহুরে, গ্রামীণ বা ক্ষয়িষ্ণু সামন্তজীবনের কথা উঠে আসলেও বা চরিত্রেরা বাঙলা কথা বলে থাকলে, তাদের জীবনের দ্বন্দ্বের বা মানবিক সম্পর্কের টানাপড়েনের ক্রিটিক্যাল দিকগুলো পৃথিবীর সকল মানুষের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। এটি তিনি পর্দায় যত্নের সাথে করে গেছেন ঘটনার ঘনঘটা না ঘটিয়ে।

বরং উপন্যাসের বা কাহিনী বলার ঢংয়ের আদলে। যেখানে একটি মূল আখ্যানকে কে কেন্দ্র করে আরো আরো ঘটনার ডালপালা ক্রম বিকশিত হয়ে ‘সমস্যা’ নামক নাগরিক উৎকণ্ঠার চুলচেরা বিশ্লেষণ করার একটা চেষ্টা করে গেছেন। তুলে ধরতে চেয়েছেন মানবিক আবেগ ও অনুভূতির গল্প। হ্যাঁ, উনার সিনেমায় ভায়োলন্স বা যৌনতা বা শক থেরাপির চর্চা নেই ঐ অর্থে।
সত্যজিৎ রায় যথেষ্ট বিপ্লবী ছিলেন না বা তিনি ছিলেন হলিউড প্রভাবিত বা পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুসারী, এমন কথা তার সম্পর্কে শোনা যায়, এ বিষয়ে আপনার মতামত জানতে চাই।

- এই প্রসঙ্গে বলতে হয় যে সত্যজিৎ রায় যখন সিনেমা করবেন বলে মনস্থির করেছেন বা করতে এসেছেন তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে বিশ্ব-সিনেমায় অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল ইতালির নিও-রিয়ালিজম বা নব্য-বাস্তববাদ। তো স্বভাবতই রায়ের ফিল্মে ভিত্তোরিও দে সিকার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। আরও পাওয়া যাবে ফ্রেঞ্চ ফিল্মমমেকার জাঁ রেনোয়াকে। রেনোয়ার সাথে আলাপ ছিল রায়ের। 

রায় আরো ভক্ত ছিলেন ১৯৩০-৪০ দশকের আমেরিকান ছবির। রায়ের সিনেমায় জন ফোর্ড, বিলি ওয়াইল্ডার, ফ্র্যাংক কাপরা এবং জর্জ স্টিভেন্স এর ফিল্মমেকিং স্টাইল এর প্রভাব দেখা যায়। তবে ফিল্মের প্রাণভোমরা যে নির্মাতা বা পরিচালক এই ধারণাটি রায়ের বোধে পোক্ত হয় এবং নতুন চোখ তৈরি হয় শান্তিনিকেতন লাইব্রেরিতে  রেমন্ড স্পটিসউড, পল রোথা, ভসেভোলোদ পুদোভকিনের অনুবাদ পড়ে।

প্রশ্নের পয়লা অংশের উত্তরে বলতে হয় যে, রায়ের যে নীতি ও নৈতিকতা বোধ সেখান থেকে উনি নিজেকে বা অন্য কেউ তাকে বিল্পবী না ভাবলে, এক্টিভিস্ট ভাবতেই পারেন। তাছাড়া নির্মাতা যা বানালেন তা নিয়ে আলাপ হবে নাকি যা করলেন বা করতে পারলেন না তা দিয়ে বিচার করা হবে কিনা তর্ক-বিতর্ক-কুতর্ক হিসেবে তা বেশ আমোদের বৈকি।

যেমন ধরা যাক 'গণশত্রু' ছবিটির কথা যেখানে দেশের ভঙ্গুর রাজনৈতিক ব্যবস্থার সমালোচনা করছেন বা 'মহানগর', 'দেবী', 'চালুরলতা'র মত সিনেমায় নারীর উপস্থাপন, ক্ষমতায়ন নিয়ে কথা বলছেন।  

তার চলচ্চিত্র নির্মাণের কৌশলের বিশেষত্ব কি আপনার চোখে পড়ে, তিনি এ ক্ষেত্রে কেন অন্যদের চেয়ে আলাদা?

- রায়ের ফিল্মমেকিংয়ের কৃতকৌশল ও কারুকার্যের প্রশ্নে আমি মনে করি যে তার পেইন্টিং এবং গ্রাফিক ডিজাইনের ব্যাকগ্রাউন্ড দারুণভাবে কাজে এসেছে। এমনটা মনে হয় এই কারণে যে, তার কাজে পরিমিত বোধ, কম্পোজিশনের সুশৃঙ্খল সমাবেশ এবং পর্দায় প্রায়োগিক উপস্থাপন এক ত্রিকোণমিতিক সূত্রে বাঁধা। 

পাশাপাশি ফিল্মমেকার সত্ত্বার ভেতরে থাকা লেখক/সাহিত্যিক রায়ের প্রথম পছন্দ একটা ভালো গল্প বা কাহিনী। গল্প বা কাহিনী যদি যথেষ্ট চিত্তাকর্ষ্ক না হয় তবে রায় ওই সিনেমায় হাত দিতেন না। এই প্রেক্ষিত থেক দেখলে রায় নিজেই বলে গেছেন যে, বিভূতি ব্যানার্জীর (পথের পাঁচালী) চরম ভক্ত তিনি। 

বিভূতি ব্যানার্জীর লেখার শৈলী, ডিটেইলড সংলাপ, চরিত্রচিত্রণ, সম্পর্কের ট্রিটমেন্ট এই বিষয়গুলি রায় কে,  রায়ের সিনেমা-কাজকে অসমম্ভবভাবে প্রভাবিত করেছে। বা কাঞ্চনজংঘা এর মধ্যে দিয়ে সেই সময়েই সিনেমার (জটিল এবং বহুস্তর বিশিষ্ট গল্প কাঠামো) ন্যারেটিভের চর্চা করছেন। যা সময়ের তুলনায় অগ্রগামী চিন্তা ছিল।মিজ-অ-সিন বা আর্ট ডেকোরেশনের মধ্য দিয়ে গল্প বলা বা সঙ্গীতকে কমপ্লিমেম্নটারি জায়গা থেকে সিনেমায় ব্যবহার করা।
সত্যজিতের চলচ্চিত্রে কল্প বিজ্ঞান এবং ফ্যান্টাসির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়, কিন্তু এটা নিয়ে একাডেমিক আলোচনা খুব বেশি নেই, এ বিষয়ে আপনার কি পর্যবেক্ষণ?

- সত্যজিৎ রায়ের তো আসলে একটি পরিচয় নয়, তার অনেকগুলো পরিচয়। তিনি একাধারে লেখক, চলচ্চিত্রকার, চিত্রশিল্পী, গ্রাফিক ডিজাইনার, প্রচ্ছদ শিল্পী, বিজ্ঞাপনী সংস্থায়ও কাজ করেছেন। তার কর্মে কল্পবিজ্ঞান ও ফ্যান্টাসীর যে প্রসঙ্গ, তাতে দেখা যায় তিনি কিন্তু সায়েন্স ফিকশন এবং প্রযুক্তির ব্যাপারে বেশ ইতিবাচক আকাংখ্যা পোষণ করেছেন।

তিনি কল্পবিজ্ঞান নিয়ে লিখেছেনও, স্ট্যানলি কুব্রিকের ‘টু থাউজেন্ড ওয়ান - আ স্পেস অডিসি’র সেট পরিদর্শনে গিয়েছিলেন আর্থার সি ক্লার্কের আমন্ত্রণে। সেখানে দেখা যায় যে কল্প বিজ্ঞানকে ইন্টেলেকচুয়াল প্র্যাকটিস কিংবা যুক্তির জায়গা থেকে দেখা হচ্ছে, শুধুমাত্র লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে বিজ্ঞানের উপস্থাপন তা নয় - এসব বিষয়গুলো সত্যজিৎ রায়কে স্পর্শ করে।

তিনি তার কাজে সাইকেডেলিক (Psychedelic) আর্টের ব্যবহার করেছেন, যেমন প্রফেসর শঙ্কু সিরিজ বা গ্যাংটকে গন্ডগোল ইত্যাদি বুক কাভারে তিনি নানা বর্ণের ব্যবহার করেছেন। তিনি সাইকেডেলিক আর্টের কোর (Core) জায়গাটিকে তার মত করে কন্টেক্সচুয়ালাইজ করেছেন, এবং শিল্প হিসেবে বা শৈলী নির্মাণের ক্ষেত্রে এই কন্টেক্সচুয়ালাইজেশন তার একটি বড়ো অস্ত্র এবং এটি দারুণভাবে তিনি প্রয়োগ করেছেন 'হীরক রাজার দেশে' সিনেমায়। 

এই সিনেমায় ফ্যান্টাসীর মাধ্যমে গল্প বলা হয়েছে। এর পোশাক পরিকল্পনায় স্পষ্টতঃ এলিয়েনধর্মী ডিজাইন, মিউজিকের ব্যবহার এবং যন্ত্রপাতির ব্যবহার, টেলিপোর্টেশন বা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যাওয়া - এর সবই কিন্তু সাইকেডেলিক ফিল্মের বা এসথেটিক্সের কোর চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য।  

ধন্যবাদ ইমরান ফিরদাউস প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালী চলচ্চিত্র নির্মাতা-লেখক  সত্যজিৎ রায়ের জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে তার কাজ সম্পর্কে আপনার মতামত আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য। এসবিএস বাংলাকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে আবারো ধন্যবাদ। 

- ধন্যবাদ এসবিএস বাংলাকে  

ইমরান ফিরদাউসের পুরো সাক্ষাতকারটি শুনতে উপরের অডিও প্লেয়ারে ক্লিক করুন। 

 শুনুন প্রতি সোমবার এবং শনিবার সন্ধ্যা ৬টায় এবং আরও খবরের জন্য আমাদের  ভিজিট করুন। 

আরো দেখুন:



 


Share