বাংলাদেশি পাহাড়ি কমিউনিটি অস্ট্রেলিয়ায় পালন করেছে বৈ-সা-বি উৎসব

ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে ফুল বিঝু পালন করছেন মেলোবোর্নের জুম্ম কমিউনিটি

ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে ফুল বিঝু পালন করছেন মেলোবোর্নের জুম্ম কমিউনিটি Source: জুনো পর চাকমা

অস্ট্রেলিয়ায় থাকা বাংলাদেশের পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠী তাঁদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, স্বকীয়তা ও সংহতি ধরে রেখেছেন নানান সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। বৈসু, সাংগ্রাই, বিঝু উৎসব পালন তার মধ্যে অন্যতম। অনেকের কাছে এই উৎসব ‘বৈসাবি’ নামেও পরিচিত।


অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থানরত জুম্মরা (জুম্ম জনগোষ্ঠী বলতে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার আদিবাসী জনগণকে সামগ্রিকভাবে বোঝানো হয়ে থাকে) আদিবাসীরা তাদের প্রাণের উৎসব বৈসাবি কীভাবে উদযাপন করেন?


গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো

• সিডনীতে ১০ তারিখ, পার্থে ১১ এবং মেলবোর্নে ২ই এপ্রিল ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে অস্ট্রেলীয় জুম্মরা এ বছরের বৈসাবি উৎসব শুরু করেছেন। উৎসবের অংশ হিসাবে অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন শহরে বসবাসরত জুম্মরা বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করছেন।
• প্রতি বছর এই সময়ে বাংলাদেশের পার্বত্য্ চট্টগ্রাম সহ সারা বিশ্বে জুম্ম ডায়াস্পোরারা এই উৎসব পালন করেন। এটি জুম্মদের প্রধান সামাজিক উৎসব।
• বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর রীতি-নীতি, প্রথা ও সংস্কৃতিতে দৃশ্যমান পার্থক্য থাকলেও বাংলাদেশ ও ভারতের বাইরে থাকা জুম্মরা অভিন্ন আয়োজনে সম্মিলিতভাবে এই উৎসব উদযাপন করে থকেন।


ত্রিপুরারা বলেন বৈসুক, চাকমারা বিঝু, মারমা আর চাক জনগোষ্ঠী বলেন সাংগ্রাই, তঞ্চংগ্যারা বিষু, ম্রোরা চংক্রান- এমন অনেক নামেই পাহাড়ের আদিবাসীরা তাঁদের প্রধান উৎসবকে আপন নামে ডাকেন। নাম যাই হোক- বাংলাদেশের বিভিন্ন পাহাড়ি জনগোষ্ঠি প্রতিবছর এপ্রিল মাসের ১২ তারিখ থেকে ১৬ তারিখ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনপদে এই উৎসব পালন করে থাকেন।

নক্ষত্রের গতিপথের সাথে মিল রেখে ঋতু আর শস্য আবর্তনের সঙ্গতিকে ধরে রাখতে জ্যোতিষ শাস্ত্রের পণ্ডিতেরা আদিকালে যে বর্ষপঞ্জিকার অবতারণা করেছিলেন- সেই বর্ষপঞ্জিই আজ পর্যন্ত চালু আছে বাংলাদেশে, মিয়ানমারে, থাইল্যান্ড, ভারত-সহ দক্ষিণ-পুর্ব এশিয়ার অনেক দেশে ।

ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে ফুল বিঝু পালন করছেন মেলোবোর্নের জুম্ম কমিউনিটি
ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে ফুল বিঝু পালন করছেন মেলোবোর্নের জুম্ম কমিউনিটি Source: জুনো পর চাকমা


 

সেই একই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী মারমা, চাকমা, ত্রিপুরারা পুরাতন বছরকে বিদায় জানায় আর নতুন বছরকে স্বাগত জানায় যথাযথ ভাবগাম্ভির্য এবং নানান উৎসবের আয়োজনের মাধ্যমে। এই সময়টা বিষুব সংক্রান্তির বিশেষ ক্ষণ, আর বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চৈত্র সংক্রান্তির অর্থাৎ চৈত্রের শেষ দু’দিন আর নববর্ষের প্রথম দিন।

এই সময়টাতেই তিন-চারদিন থেকে সপ্তাহ ব্যাপী উৎসব পালন করে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা। বন-পাহাড়ের দূর-দূরান্ত থেকে শোনা যায় ঐতিহ্যবাহী “গৈরয়া” নাচের ঢাক বাজছে ত্রিপুরা পাড়ায়।

চাকমা, তঞ্চংগ্যা ও ত্রিপুরারা চৈত্রের ২৯ তারিখ জলে ফুল ভাসিয়ে পুরাতন বছরকে বিদায় জানায় আর নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। এ দিনটি চাকমা ও তঞ্চংগ্যাদের কাছে ফুল বিঝু, আর ত্রিপুরাদের হারি বৈসু।

ফুল বিঝুর পরের দিনটি মূল বিঝু, তারপর “নুও বজর” বা নববর্ষ।৩০ চৈত্র সচরাচর ইংরেজি ক্যালেন্ডারে ১৩ তারিখ পড়ে। চাকমা, তঞ্চংগ্যা আর ত্রিপুরারা এই দিনটিতে বিঝু-বিষু আর বৈসু উদযাপন করেন।এই দিনে ঐতিহ্যবাহী নিরামিষ ব্যঞ্জনা “পাঁচন বা পাজন” রান্না হয়। মারমা, চাক আর ম্রোদের সাংগ্রাই উৎসবের শুরু হয় নতুন বছরের দিন থেকে, দিনটি সাধারণত ইংরেজি ১৪ তারিখে হয়। খিয়াংরা তাকে সাংলাং বলে থাকেন।

ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে ফুল বিঝু পালন করছেন মেলোবোর্নের জুম্ম কমিউনিটি
ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে ফুল বিঝু পালন করছেন মেলোবোর্নের জুম্ম কমিউনিটি Source: জুনো পর চাকমা


সাংগ্রাইয়ের দিন মারমা, ম্রো, চাক আর খিয়াংরা যথাযথ ভাবগাম্ভির্যে বুদ্ধপূজা, অর্চনা আর ধর্মীয় ব্রত পালন করেন। এদিন পাহাড়ি কাউন চাল বা বিন্নি চালের মিষ্টান্ন রান্না হয়।

মারমাদের পাঁচন রান্নার আয়োজন হয় সাংগ্রাইয়ের তিনদিন পর। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর উৎসব পালনের ধরন-ধারণে তেমন একটা রকমফের দেখা যায় না, যদিও বিভিন্ন জনজাতি স্ব স্ব রীতি, প্রথায় তা পালন করে থাকেন।

অস্ট্রেলিয়াতে এই বাৎসরিক উৎসবের উদযাপন কিছুটা অন্যরকম। বাংলাদেশে যদিও বিভিন্ন জনগোষ্ঠী আলাদাভাবে পালন করে থাকেন, এই দেশে আবার তার আয়োজন সম্মিলিতভাবে হয়ে থাকে।

অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন শহরে অবস্থানরত জুম্ম বংশোদ্ভূত অভিবাসীরা গত কয়েক দশক ধরে প্রতি বছর সম্মিলিতভাবে সবাই মিলে এই উৎসব পালন করে আসছেন। মেলবোর্ন, সিডনি, এডিলেইড, পার্থ-সহ অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে থাকা জুম্মরা মিলে মিশে এই উৎসব উদযাপন করেন।

সিডনি, মেলবোর্ন, পার্থ ও এডিলেইডে এ বছর জুম্ম কমিউনিটির সবাই মিলে বৈসাবি পালন করেছেন।

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা রক্ষায় আর প্রাণের টানে যখন সব অস্ট্রেলীয় জুম্ম সম্মিলিত হন বৈসাবি উদযাপনে, তখন অস্ট্রেলিয়ার সেই স্থানটি হয়ে ওঠে যেন প্রাণের মিলনমেলা- এক টুকরো পার্বত্য চট্টগ্রাম।

বৈসাবিতে জুম্মদের বাড়িতে বাড়িতে রকমারি ঐতিহ্যবাহী রান্নার আয়োজন হয়। রান্না হয় পাজন তরকারী, জুম্মদের নানান রকমের পিঠা আর মিষ্টান্ন। সেসব ভাগাভাগি করে আনন্দ নিতে সবাই মিলিত হন কোনো সম্মীলন কেন্দ্রে।

রীতি অনুযায়ী বিঝু বা সাংগ্রাইয়ের দিনটি বাড়ির দরজা সবার জন্য্য খোলা থাকে। সবাই এ বাড়ি, ও বাড়ি বেড়াতে যায়।

নিজেদের জন্মভূমিতে এই উৎসব পালনের সাথে ভিনদেশের মাটিতে উৎসব পালন কিছুটা আলাদা হলেও তাতে আনন্দের যেমন কমতি নেই, তেমনি তার সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগত গুরুত্ব বরং যেন অনেক বেশি।

বৈসাবি শুধু আনন্দ-উদযাপনের জন্য নয়, বরং শেকড়ের সংস্কৃতিতে জীবন-যাপনের, আত্মিকতার ও আধ্যাত্মেরও বটে।

পুরো প্রতিবেদনটি শুনতে উপরের অডিও প্লেয়ারে ক্লিক করুন

আরো দেখুনঃ



 


Share