কলকাতার পার্ক সার্কাস থেকে শাহিনবাগের দূরত্ব প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটার হলেও, প্রতিবাদের স্বর কিন্তু একই। চেহারাগুলো আর ভাষা শুধু আলাদা।
জাতীয় পতাকা সামনে আট থেকে আশি বসে পড়েছেন আজাদির জন্যে। প্রতিবাদ থামবে না, প্রতিবাদ চলবে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মধ্য কলকাতার পার্ক সার্কাস ময়দানে উপস্থিত কয়েকশো নারী। সময় যত গড়াচ্ছে, ততই ভিড় বাড়ছে পার্ক সার্কাসেও। প্রতিবাদী কণ্ঠও আরও জোরদার হচ্ছে। কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শয়ে শয়ে আসছেন নারী প্রতিবাদীরা। কেউ কোলে ছেলে নিয়ে, কেউবা বাড়ির কাজ সামলে। কেউ আবার আসছে গুটি গুটি পায়ে বাড়ির বড় মহিলাদের হাত ধরে। রাত জাগতে শুরু করেছে মধ্য কলকাতার পার্ক সার্কাস। ঠিক যে ভাবে দিল্লির কনকনে ঠান্ডায় ১৫ ডিসেম্বর থেকে রাত জাগছে পুরানো দিল্লির শাহিনবাগ। তাঁদের আশা, এই ‘আজাদি কা পুকার’ একদিন ঠিকই দিল্লির ক্ষমতার অলিন্দে থাকা মানুষগুলোর কানে পৌঁছবে।
কলকাতার পার্ক সার্কাস ময়দানে বৃষ্টির মধ্যে খোলা আকাশের নিচে মহিলারা জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে কেউ বাচ্চাকে কোলে নিয়ে আজাদীর স্লোগান দিচ্ছেন। মুখে বলছেন, এই সংবিধান রক্ষা না করতে পারলে মহাত্মা গান্ধীর শহীদ হওয়া বৃথা। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন এবং জাতীয় নাগরিক পঞ্জীর বিরুদ্ধে লড়াই এবং দেশের সরকারের বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামা, মা, বোনদের পাশে প্রথম দাঁড়িয়েছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্র। তিনি আন্দোলনকারিনীদের বলেছেন, একজন দাদা হয়ে, বোনেদের কাছে এসেছেন, কোন দলের প্রতিনিধি হয়ে যান নি। যে কোন প্রয়োজনে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি পার্ক সার্কাস ময়দানে আন্দোলনরত মহিলাদের সঙ্গে আছেন।
সোমেন মিত্রর অভিযোগ, যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নারী, যিনি দাবি করেন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন এবং জাতীয় নাগরিক পঞ্জীর বিরুদ্ধে লড়াই-আন্দোলনে তিনিই অগ্রগন্যা, অথচ ৪৮ ঘণ্টাতেও তাঁর পুলিশ এই আন্দোলের অনুমতি দেয় নি। লাইট, মাইক, শৌচালয় এমনকি মাথার উপর একটা ছাউনিরও অনুমতি দেয় নি রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস সরকার। সোমেন মিত্রের কথায়, বাচ্চা কে নিয়ে মা যখন বলেন গান্ধীজির পথেই লড়বেন তখন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী যদি ভাবেন, দেশ বাঁচাতে ওনার সঙ্গেই আন্দোলন করতে হবে, তবে তিনি মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন।আর আন্দোলনস্থলের ছবি? একসময়ে মধ্য কলকাতার জাকারিয়া স্ট্রিটে রুহিনা সারমিনের ছোটবেলা কেটেছে। বিয়ের পর প্রায় এক দশক কেটে গিয়েছে। এখন রুহিনা লখনউয়ে থাকেন। কলকাতার টানে মাঝেমধ্যে আসেন। কিন্তু এ বার শহরে পা রাখার পরই যেন সব অচেনা লাগছে। রাস্তা-ঘাটে প্ল্যাকার্ড-পোস্টারে সব জায়গায় নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন এবং জাতীয় নাগরিক পঞ্জী বা সিএএ-এনআরসি। পাড়া-প্রতিবেশীদের মুখেও, টিভি-সংবাদপত্রেও একই কথা।
A massive protest broke out in the City Of Joy, Kolkata India on 12 January 2020 during the visit by Indian Prime Minister Narendra Modi from 11th January 2020. Source: Sukhomoy Sen/NurPhoto via Getty Images
রুহিনা সারমিনের কথায়, মনে হচ্ছে যেন এ শহর তো তাঁর নয়। এ বার কলকাতায় আসা থেকে পার্ক সার্কাস তাঁর ঘর।ভিড়ে মধ্যে থেকে স্লোগান উঠেছে আজাদির। রুহিনার গলাতেও সেই আজাদি মানে স্বাধীনতার কথা। কিসের আজাদি, কিসের জন্যে আজাদি চাইছেন, বছর চল্লিশের রুহিনা বলেছেন, এই আজাদি বিশ্বাসের, নাগরিকত্বের। আজাদি চান, সিএএ-এনআরসি থেকে। যখন শুনেছেন দিল্লির শাহিনবাগের মতো কলকাতার পার্ক সার্কাসও গর্জে উঠছে, তখন আর ঘরে বসে থাকতে পারেন নি। চলে এসেছেন এক অন্য শাহিনবাগে।
আসলে, প্রাণের তাগিদে, বাঁচার তাগিদে আন্দোলনটা ছড়িয়ে পড়েছে। কনকনে ঠাণ্ডা উপেক্ষা করে যদি দিল্লির শাহিনবাগ আজাদি চাইতে পারে, তাহলে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন এবং জাতীয় নাগরিক পঞ্জী থেকে রেহাই পেতে পার্ক সার্কাস পারবে না কেন, বৃষ্টি-ঠাণ্ডাকে উপেক্ষা করে আজাদির পক্ষে লড়াই করতে, বলেছেন রুহিনার পাশে বসে থাকা আরেক প্রতিবাদী, শাবানা বানু। কোলে ছেলে নিয়ে দু’দিন ধরে পার্ক সার্কাস ময়দানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠায়ে বসে গলা মেলাচ্ছেন শাবানা। ঘর ছেড়ে কেন দিন রাত জেগে আন্দোলনের মঞ্চে, প্রশ্ন করতেই বলেছেন তিনি তো তাঁর ছেলের জন্যে আজাদি চাইছেন।শহর তো কলকাতা, এই দেশ তো তাঁরও। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন এবং জাতীয় নাগরিক পঞ্জী তাঁদের সেই শহর-দেশ থেকে আলাদা করতে পারবে না।
কিন্তু, আন্দোলনরত মহিলারা কি জানেন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন এবং জাতীয় নাগরিক পঞ্জীতে কী আছে। উত্তরে প্রায় এক সঙ্গে জবাব মিলছে, এটুকু জানেন, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা, সিএএ আইন ধর্মের ভিত্তিতে হয়েছে। জাতীয় নাগরিক পঞ্জী বা, এনআরসি করে অসমে কী হয়েছে তা-ও সবাই জানেন, এখনও চোখের সামনে দেখছেন। বাংলায় যদি তার প্রয়োগ হলে, কী হবে তা-ও সবাই জানেন। তাই রাত জাগছেন মধ্য কলকাতার পার্ক সার্কাসের কয়েক শো মহিলা। সংখ্যাটা রোজ বাড়ছে। তাঁদের কথায়, এ যে বাঁচার লড়াই।