ভারতের নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে উত্তর প্রদেশের আরও নানা এলাকায়। নতুন করে হিংসার খবর পাওয়া গিয়েছে ভদোদরা এবং জবলপুর থেকেও। উত্তরপ্রদেশের বারাণসী ও লক্ষ্ণৌতে মোট ২১টি জেলায় বন্ধ রয়েছে ইন্টারনেট পরিষেবা।বিক্ষোভের জেরে উত্তরপ্রদেশে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মেরঠ। মেরঠ মেডিক্যাল কলেজেই চার জনের মৃত্যু হয়েছে। বিজনোর থেকে আরও দু-জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। মুজফফরনগর, ফিরোজাবাদা, সমভাল এবং কানপুর থেকে একজন করে মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে।
এর মধ্যেই ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তরফে নাগরিকত্ব আইনের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, প্রথমত, ১৯৮৭ সালের ১ জুলাইয়ের আগে যাঁরা ভারতে জন্মেছেন, তাঁরা সকলেই এ দেশের নাগরিক। দ্বিতীয়ত, ১ জুলাই ১৯৮৭ সাল থেকে ৩ ডিসেম্বর ২০০৪-এর মধ্যে যাঁরা জন্মেছেন এবং যাঁদের বাবা-মায়ের মধ্যে কোনও এক জন ভারতের নাগরিক, তিনিও ভারতীয়। তৃতীয়ত, ৩ ডিসেম্বর ২০০৪ সালের পরে যাঁরা জন্মেছেন এবং যাঁদের বাবা-মা দু’জনেই ভারতের নাগরিক কিংবা এক জন ভারতীয় নাগরিক এবং অন্য জন সেই সময়ে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নন, তাঁরাও ভারতের নাগরিক হিসেবে গণ্য হবেন।কিন্তু বিরোধীদের বক্তব্য, ১৯৮৭ সালের ১ জুলাইয়ের আগে যখন জন্মের নথিকরণ বাধ্যতামূলক ছিল না, তখন যাঁদের জন্ম, তাঁরা কী নথি দেখাবেন ? তা ছাড়া, ২০০৪ সালের ৩ ডিসেম্বরের পরে জন্মানো কেউ যদি বাবা বা মায়ের মধ্যে কোনও এক জনকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে প্রমাণ করতে না পারেন, তা হলে তাঁর নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। কিন্তু তিনি যে হেতু ভারতে জন্মেছেন, তাই অ-মুসলিম হলেও নিজেকে শরণার্থী হিসেবে দাবি করে নতুন নাগরিকত্ব আইনের সুবিধা নিতে পারবেন না। এই সমস্ত জটিলতার সমাধান কী?
এদিকে নাগরিকত্ব বিলের বিরোধিতায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দিল্লি। শুক্রবার রাতে, পুরনো দিল্লির দারিয়াগঞ্জে বিক্ষোভকারীদের উপরজলকামান এবং লাঠি চার্জ করেছে পুলিশ।অভিযোগ ,বিক্ষোভ চলাকালীন বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারী প্রাইভেট গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ঘটনার জেরে শনিবার ১০জনকে গ্রেফতার করেছে দিল্লি পুলিশ। পুলিশ জানিয়েছে সুভাষ মার্গ এলাকায় শুক্রবার সন্ধের সময় পার্ক করা কয়েকটি প্রাইভেট গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা। সেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয় দ্রুত। অন্যদিকে, দিল্লি পুলিশের কাছে আত্মসমর্পন করেছেন ভীম সেনার প্রধান চন্দ্রশেখর আজাদ। শুক্রবার দুপুর তাঁর নেতৃত্বে জামা মসজিদে এক বিশাল মিছিল বের হয়। ১৪৪ ধারা অমান্য করে ওই এলাকায় মিছিল করায় তাঁকে আটক করলে মসজিদের ১ নং গেট দিয়ে পালিয়ে যান ভীম সেনার প্রধান চন্দ্রশেখর। পুলিশ হেফাজত থেকে চন্দ্রশেখর আজাদ ভিড়ের মধ্যে গা ঢাকা দেয়।এর মধ্যেই খবর,দিল্লির দারিয়াগঞ্জের ঘটনায় মোট ৪০জনকে আটক করেছে পুলিশ। পুলিশের দাবি, এঁদের মধ্যে অনেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়েছে।পাথর ছোঁড়ায় বেশ কয়েকজন পুলিশ আহতও হয়েছেন।
অন্যদিকে ,বিক্ষোভকারীদের উপর ম্যাঙ্গালুরুতে পুলিশের গুলি চালানোর ঘটনাকে সমর্থন জানিয়েছেন,বিজেপির জাতীয় সম্পাদক এইচ রাজা। চেন্নাইয়ে রাজা বলেছেন, গুলির জবাব গুলিতেই দেওয়া হবে। গুলির বদলে গুলি তো চলবেই। বিজেপি-শাসিত কর্নাটকের ম্যাঙ্গালুরুতে বৃহস্পতিবার পুলিশের গুলিতে দু’ জনের মৃত্যু হয়েছে। বিজেপির জাতীয় সম্পাদক রাজা ওই ঘটনা সম্পর্কে বলেছেন, যাঁরা মারা গিয়েছেন, তাঁরা কয়েকশো মানুষকে মারতে চেয়েছিলেন। তাই ওঁদের গুলি করা ছাড়া পুলিশের হাতে আর কোনও রাস্তা খোলা ছিল না।পুলিশকে তাই পাল্টা গুলি চালাতে হয়েছিল।গুলির বদলে গুলি তো চলবেই।রাজার দাবি, ম্যাঙ্গালুরুর বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য ছিল, গোটা দেশে আগুন জ্বালানো। ওঁরা পুলিশকেও আক্রমণ করেছিলেন। ২৩ ডিসেম্বর ডিএমকে যে চেন্নাইয়ে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ কর্মসূচি নিয়েছে, তাতে পুলিশকে অনুমতি দিতেও নিষেধ করেছেন তামিলনাড়ুর বিজেপি নেতাএবং জাতীয় সম্পাদক এইচ রাজা।
উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভের খবর মিলেছে। মেরুট, বাহরেচ, বুলন্দশহর, মুজাফফরনগরে পুলিসের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ বাধে বিক্ষোভকারীদের। পাথর ছোড়া হয়। গাড়ি পোড়ানো হয় বুলন্দশহরে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে। কোথাও লাঠিচার্জ করতে বাধ্য হয় পুলিস। উত্তর প্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় জারি করা হয়েছে ১৪৪ ধারা।নয়া নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায় তুমুল বিক্ষোভ হয়েছে দিল্লির জামা মসজিদে। শুক্রবার, নমাজ শেষ হওয়ার পর পরই কয়েক হাজার মানুষ বিক্ষোভ প্রদর্শন শুরু করেন। এই বিক্ষোভের নেতৃত্ব দেন ভীম সেনার প্রধান চন্দ্রশেখর আজ়াদ। বেশ কিছু রাজনৈতিক দলের নেতারও যোগ দেন।
এর মধ্যে শুক্রবার রাতের গন্ডগোলের জেরে, দিল্লির জামা মসজিদের বাইরে পুলিসি নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। দিল্লি পুলিসের তরফে জানানো হয়, জামা মসজিদ চত্বরে বিক্ষোভ প্রদর্শন বেআইনি। তবে কোনও পদক্ষেপ করতে নারাজ দিল্লি পুলিস। সকাল থেকেই জামা মসজিদের সামনে পুলিসি নিরাপত্তা বাড়ানো হয়। সচিত্র পরিচয়পত্র দেখিয়েই তবে জামা মসজিদে প্রবেশ করানো হচ্ছিল। সে সময় বিক্ষোভকারীরাও প্রবেশ করে বলে দাবি পুলিসের। ধর্মীয় স্থানে কড়া পদক্ষেপের পথে হাঁটেনি দিল্লি পুলিস। এর ফাঁকে সংবিধানের রেপ্লিকা হাতে নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন চন্দ্রশেখর আজ়াদ। পুলিসের তরফে তাঁকে অনুরোধ করা হয়, যন্তর-মন্তরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ধর্মীয় স্থানে বিক্ষোভ বেআইনি। কয়েক দিন ধরে নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায় উত্তাল রাজধানী। বুধবার জামা মসজিদের শাহি ইমাম সৈয়দ আহমেদ বুখারিও এই আইনের বিরোধিতায় সরব হন। তিনি বলেছেন, নাগরিকত্ব বিল নিয়ে ভারতীয় মুসলিমদের আশঙ্কার কোনও কারণ নেই। গণতান্ত্রিক উপায়ে কোনও কিছুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অধিকার সংবিধান মুসলিমদের দিয়েছে।