ভারতে নাগরিকত্ব বিতর্কে রোহিঙ্গা মুসলমানদের সঙ্গে বিরোধীরাও

মায়ানমার থেকে পালিয়ে এসে জম্মুতে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী জিতেন্দ্র সিংহ। তার মতে, রোহিঙ্গারা সংখ্যালঘুদের মধ্যে পড়ে না এবং পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশের স্থায়ী বাসিন্দাও নয় তারা।

Indian law

Source: AAP

মায়ানমার থেকে পালিয়ে এসে জম্মুতে আশ্রয় নিয়েছেন বহু রোহিঙ্গা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী জিতেন্দ্র সিংহর বক্তব্য, তাঁদের এ দেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না। ঝাড়াই-বাছাই করে ফেরত পাঠানোর কাজ শুরু হবে শীঘ্রই। জম্মু-কাশ্মীরে এক অনুষ্ঠানে জিতেন্দ্র সিং বলেছেন, প্রতিবেশী দেশের ছয় সংখ্যালঘুর মধ্যে রোহিঙ্গারা পড়ে না। তিন প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশের স্থায়ী বাসিন্দাও নয় তারা।

মায়ানমারে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়েই দেশ ছেড়েছেন রোহিঙ্গা মুসলিমরা। তাঁদের একটি বড় অংশ বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। ফাঁক-ফোকর গলে ভারতেও ঢুকে পড়েছেন কিছু রোহিঙ্গা। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার পেরিয়ে তাঁদের একটা অংশ জম্মুতে আশ্রয় নিয়েছেন বলেও দাবি করেছেন জিতেন্দ্র সিংহ। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর দাবি, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনে শুধুমাত্র পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তানে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টান, শিখ এবং পার্সিদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথাই বলা রয়েছে। মায়ানমার বা রোহিঙ্গাদের কোনও উল্লেখ নেই তাতে। তাই তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না।
Parliament Winter Session 2019
Minister of State for Prime Minister's Office Jitendra Singh speaks to reporters during the winter session of Parliament on November 20, 2019 in New Delhi India Source: Hindustan Times
জিতেন্দ্র সিংহ বলেছেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্যে একটি তালিকা তৈরি করা হবে। প্রয়োজনে তৈরি করা হবে বায়োমেট্রিক পরিচয়পত্রও। কারণ, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনে রোহিঙ্গাদর কোনও সুবিধা দেওয়ার কথা বলা নেই। একইসঙ্গে, বাংলা ও বিহারের মতো একাধিক রাজ্য পেরিয়ে রোহিঙ্গারা জম্মু পৌঁছলেন কীভাবে, তাঁদের টিকিটের খরচই বা কে যোগালো এবং এর পিছনে কোনও রাজনৈতিক অভিসন্ধি রয়েছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা উচিত বলে মনে করেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জিতেন্দ্র সিংহ।

কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জম্মু এবং সাম্বা জেলায় এই মুহূর্তে ১৩ হাজার ৭০০ বিদেশি রয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছেন রোহিঙ্গা মুসলিম এবং বেশ কিছু বাংলাদেশি নাগরিকও। ২০১৬ সালের হিসাব দেখিয়ে বলা হয়েছে, তার আগের ৮ বছরেই এই সংখ্যাটা প্রায় ৬ হাজার বেড়েছে। মূলত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা এসে ভিড় করাতেই সংখ্যাটা এত বেড়ে গিয়েছে বলে দাবি বিজেপি, জম্মু-কাশ্মীর ন্যাশনাল প্যান্থার্স পার্টি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের মতো একাধিক রাজনৈতিক এবং সামাজিক সংগঠনের।

এদিকে, কর্ণাটকে নাগরিকত্ব বিরোধী আন্দোলনকারীদের নামে সরাসরি ভারতের সংখ্যালঘু মানে মুসলিমদের হুমকি দিয়েছেন বিজেপি বিধায়ক সোমশেখর রেড্ডি। তাঁর কথায়, এবার যদি নাগরিকত্ব বিরোধী আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে দেশের সংখ্যাগুরুরা রাস্তায় নামে তাহলে কী হবে? কর্ণাটকের বেল্লারিতে সোমশেখর বলেছেন, মনে রেখো তোমরা দেশের জনসংখ্যার মাত্র ১৫ শতাংশ। দেশের ৮০ শতাংশই আমরা। একবার ভেবে দেখ, সংখ্যাগুরুরা তোমাদের বিরুদ্ধে যদি রাস্তায় নেমে পড়ে তাহলে কী হবে।
Karnataka State Assembly Election: Prime Minister Narendra Modi Address Election Campaign Rally At Bellary Stadium
Prime Minister Narendra Modi (L) with Siramulu (R), Bhartiya Janta Party candidate from Badami and Molakalmur along with Somashekara Reddy (C). Source: Hindustan Times
বেঙ্গালুরু দক্ষিণের সাংসদ তেজস্বী সুর্য্যর কথাও টেনে এনেছেন সোমশেখর। তিনি বলেছেন, তেজস্বী ঠিক বলেছিল, যারা রাস্তায় নেমেছে তারা আসলে পাংচারওয়ালা কিম্বা অশিক্ষিত। ওদের মন বিষিয়ে দিচ্ছে এরাজ্যের কংগ্রেসীরা। বেল্লারির বিধায়ক আরও বলেছেন, রাস্তায় নেমে সরকারের সম্পত্তি ধ্বংস যারা করছে তাদের উত্তরপ্রদেশের মতো কর্ণাটকেও একই শিক্ষা দেওয়া হবে। যারা নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে তাদের গুলি করলে ভালো হয় মন্তব্য করেছেন তিনি।

অন্যান্য রাজ্যের মতো কর্ণাটকেও নাগরিকত্ব আইন বিরোধী আন্দোলন হয়েছে। সেখানে বিক্ষোভে ১৯ ডিসেম্বর পুলিসের গুলিতে মৃত্যু হয়েছে ২ জনের।

এর মধ্যেই বিতর্ক বাড়িয়েছেন মধ্যপ্রদেশের বিজেপি সাংসদ উদয় প্রতাপ সিং। তিনি হুমকি দিয়েছেন, কোনও রাজ্য যদি নাগরিকত্ব আইন প্রণয়নে বাধা সৃষ্টি করে, তাহলে সংবিধান অনুযায়ী সেই রাজ্যে রাষ্ট্রপতি-শাসন জারি হতে পারে। নাগরিকত্ব আইনকে ঘিরে দেশজুড়ে বিক্ষোভের মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সহ- ১১ জন অ-বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীকে একই পথে হাঁটার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি লিখেছেন কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন।

এদিকে, রাজ্য সরকার না চাইলে নাগরিকত্ব আইন যে চালু হবে না, তা আগেই স্পষ্ট করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। জাতীয় নাগরিকপঞ্জী বিরোধী প্রস্তাব দেশে প্রথম পাশ হয়েছে পশ্চিমবঙ্গেই। এমন অবস্থায় রাষ্ট্রপতি-শাসনের স্পষ্ট হুমকি শোনা গিয়েছে বিজেপি সাংসদের গলায়। উদয় প্রতাপ সিং বলেছেন, যে যে রাজ্য সরকার নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতা করছে, সেখানে রাষ্ট্রপতি-শাসন জারি করা যেতে পারে। কেননা, রাজ্য সরকারগুলো দেশের সংসদে পাস হওয়া নাগরিকত্ব আইন মানতে বাধ্য।
Union Housing and Urban Affairs Hardeep Singh Puri Lays Foundation Stone For Skywalk And FOB At ITO
Uday Pratap Singh during the Foundation Stone Laying Ceremony Skywalk and FOB at W Point, ITO at Pragati Maidan Metro Station on November 9, 2017 in New Delhi. Source: Hindustan Times
সাংসদ উদয় প্রতাপ সিং আরও বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ী দায়িত্ব পালনে কোনও রাজ্য সরকার ব্যর্থ হলে, ৩৫৬ ধারা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট রাজ্যের বিধানসভার কার্যক্ষমতা বাতিল করতে পারেন রাষ্ট্রপতি। নাগরিকত্ব আইন এবং জাতীয় নাগরিকপঞ্জী-বিরোধী প্রায় সব সভা থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, বাংলায় সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন এবং জাতীয় নাগরিকপঞ্জি কার্যকরী হচ্ছে না। এখানে তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার আইন পাশ করলেও রাজ্যকেই তা কার্যকর করতে হয়। কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গে নাগরিকত্ব আইন বা জাতীয় নাগরিকপঞ্জী করতে দেওয়া হবে না।

এর মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে পাকিস্তান বিষয়ে তার অবস্থান নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন তুলেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রীর বক্তব্য, নরেন্দ্র মোদি প্রায়শই ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করেন। শিলিগুড়িতে নাগরিকত্ব আইনবিরোধী এক সমাবেশে বক্তব্য প্রদান করতে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, এটা খুবই লজ্জার বিষয় যে, স্বাধীনতার ৭০ বছর পরেও মানুষকে তাদের জাতীয়তার প্রমাণ করতে হচ্ছে।
Protests Against CAA And NRC In Kolkata
Chief minister of West Bengal state and leader of the Trinamool Congress (TMC) Mamata Banerjee along with her Nephew Abhishak Banerjee MP and party supporters Source: NurPhoto
তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী প্রশ্ন তুলেছেন, প্রধানমন্ত্রী কেন নিয়মিত জাতিকে পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করেন? তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নাকি পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপির বিরুদ্ধে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি বাস্তবায়নের বিষয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অভিযোগ তুলে বলেছেন, বিজেপির নেতারা এই ইস্যুতে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন। একদিকে প্রধানমন্ত্রী বলছেন যে, কোনো এনআরসি হবে না, আবার অন্যদিকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং অন্য মন্ত্রীরা দাবি করছেন যে, সারা দেশে এনআরসি পরিচালিত হবে।

এদিকে, নাগরিকত্ব আইন সংখ্যালঘু বিরোধী নয়, তাই এটা প্রত্যাহারের কোনো প্রশ্নই নেই, কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেসের সমালোচনা করে বলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। রাজস্থানের যোধপুরে নাগরিকত্ব আইনপন্থি এক জনসভা থেকে বিজেপি সভাপতি তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, কংগ্রেস ভোট ব্যাংক রাজনীতি করছে।নাগরিকত্ব আইন নিয়ে ভুল তথ্য পরিবেশনা করছে। পাশাপাশি সিএএ নিয়ে বিরোধী অবস্থান নেওয়া বিরোধী দলগুলোর প্রতি অমিত শাহের অভিযোগ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজ পার্টি আর কংগ্রেস এই আইনের বিরোধিতা করছে, তারা মিথ্যা প্রচার করছে।

Follow SBS Bangla on .

Share
Published 7 January 2020 10:37am
By Partha Mukhopadhyay
Presented by Sikder Taher Ahmad

Share this with family and friends