ইতিহাসের অন্যতম মহান ফুটবলার দিয়েগো ম্যারাডোনা (৬০) আর নেই। ফুটবল অঙ্গনে বড় বড় রেকর্ডের অধিকারী এই মহান খেলোয়াড় সম্প্রতি বিভিন্ন ধরনের শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন। মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বাঁধায় কয়েক সপ্তাহ আগে জরুরি ভিত্তিতে তার অপারেশন করা হয়। গত বুধবার বুয়েন্স আয়ার্সে নিজ বাড়িতে তিনি হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেন।
ফুটবলের জীবন্ত কিংবদন্তি হিসেবে আর্জেন্টিনায় তার কতোটা প্রভাব ছিল তা বোঝা যায় তার মৃত্যুর পর সেখানকার অবস্থা দেখে। আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফার্নান্দেজ তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছেন।
আর্জেন্টিনিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন এক টুইট বার্তায় লিখেছে, “আমাদের কিংবদন্তি দিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করছি। আপনি সবসময়েই আমাদের হৃদয়ে থাকবেন।”
ম্যারাডোনা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলার কিনা সেটা নিয়ে দ্বিমত থাকলেও তিনি যে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফুটবলার এতে কারও দ্বিমত নেই। বলা যায় তার নেতৃত্বে, তার এক পায়ের উপর ভর করেই, এবং তার হাতের উপর নির্ভর করেই ১৯৮৬ সালের মেক্সিকোর বিশ্বকাপ জয় করে আর্জেন্টিনা। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে কোয়ার্টার ফাইনালে তিনি তার বিখ্যাত ‘হাত দিয়ে গোল’টি করেন।
১৯৮৬ সালের পর ১৯৯০ সালে ইতালির বিশ্বকাপেও তার নেতৃত্বে ফাইনালে উঠে আর্জেন্টিনা। ২০১০ সালের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা দলের কোচ ও ম্যানেজার ছিলেন তিনি।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে অনেক সময় পেলের নামও উচ্চারিত হয়। ফুটবল-সম্রাট খ্যাত এই ব্রাজিলের এই কিংবদন্তি বলেন,
“আজকের শোক-সংবাদ। আমি একজন প্রিয় বন্ধুকে হারালাম এবং বিশ্ব একজন কিংবদন্তিকে হারালো।”
“আরও বহু কিছু বলার আছে। তাকে এখন, সৃষ্টিকর্তা তার পরিবারকে শক্তি দিন। আমি আশা করি, একদিন স্বর্গে আমরা একসাথে ফুটবল খেলবো।”
ফুটবলে সাফল্যের জন্য বিশ্ব জুড়ে তারকা-খ্যাতি পেয়েছেন ম্যারাডোনা। আর, ফুটবলের এই আইকনকে আর্জেন্টিনায় সংক্ষেপে ডাকা হতো “এল দিয়েগো” বলে।
আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফার্নান্দেজ এক টুইট বার্তায় বলেন,
“আপনি আমাদেরকে বিশ্বের শীর্ষে উন্নীত করেছিলেন এবং আমাদেরকে অনেক আনন্দিত করেছিলেন।”
“আপনি সবচেয়ে মহান। আমাদের সঙ্গে থাকার জন্য ধন্যবাদ, দিয়েগো। আমরা সারা জীবন আপনার শূন্যতা অনুভব করবো।”
ম্যারাডোনার ক্যারিয়ারে শুধু খ্যাতিই ছিল না, এটি কণ্টকিত ছিল মাঠের ও মাঠের বাইরের নানা বিতর্কে। অবসরে যাওয়ার পরও বিতর্ক তার পিছু ছাড়ে নি।
১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে তার ‘ঈশ্বরের হাত’ বলে খ্যাত গোলটি, যেটি তিনি হাত দিয়ে করেছিলেন, সেটি তাকে অনেক কুখ্যাতি এনে দেয়। সেই গোলটির জন্য তিনি যেমন নিন্দিত হয়েছিলেন, তেমনি সেই একই খেলায় এর পরে অনন্য ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রেখে তিনি যে গোলটি করেছিলেন তা এখনও ‘সর্বকালের সেরা গোল’ বা ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’ বলে খ্যাত।
সেই খেলায় ম্যারাডোনার বিপক্ষে খেলেছিলেন ইংল্যান্ডের গ্যারি লিনেকার। তিনি টুইট করেন যে,
“আমার প্রজন্মের সর্বোত্তম খেলোয়াড় এবং যুক্তিযুক্তভাবে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় একটি অনুগ্রহপুষ্ট এবং সমস্যা-সঙ্কুল জীবন অতিবাহিত করেছেন। আশাকরি, অবশেষে তিনি সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে স্বস্তি লাভ করবেন।#RipDiego”
১৯৯৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বকাপেও নেতৃত্ব দিতে গিয়েছিলেন ম্যারাডোনা। কিন্তু, অবৈধ মাদক পরীক্ষায় ফেল করার কারণে তাকে আর্জেন্টিনায় ফিরে যেতে হয়। শেষ হয়ে যায় তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার। জীবনব্যাপী তিনি স্বেচ্ছাচারী জীবন-যাত্রা চালিয়ে গেছেন।
১৯৯১ সালেও তার শরীরে মাদকের উপস্থিতি ধরা পড়লে তাকে ১৫ মাসের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। তখন তিনি নাপোলির জন্য খেলতেন।
নাপোলি ১৯৮৭ ও ১৯৯০ সালে সিরি আ শিরোপা যেতে। নাপোলি টুইটারে লিখেছে, “চিরদিনের জন্য। বিদায় দিয়েগো”।
তার আরেক ক্লাব বার্সেলোনা লিখেছে:
“সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ, দিয়েগো।”
তিনি সেভিয়া, বোকা জুনিয়র্স এবং নিওয়েলস ওল্ড বয়েজ ক্লাবেও খেলেছেন।
ক্লাব পর্যায়ে তিনি প্রথম নাম লেখান বুয়েন্স আয়ার্সে বোকা জুনিয়র্সে। এর পর তিনি স্পেনের বার্সেলোনা ক্লাবে যোগদান করেন।
আর, ইতালিতে নাপোলির জন্য তিনি তাদের প্রথম ইতালিয়ান লিগ শিরোপা এনে দেন ১৯৮৭ সালে।
ইতালির প্রধানমন্ত্রী জিউসেপ কোঁতে টুইট করেন, “ম্যারাডোনার মৃত্যুতে পুরো বিশ্ব শোক করছে। ফুটবলের ইতিহাসে তিনি তার তুলনাবিহীন মেধা দিয়ে অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন। বিদায় চিরদিনের চ্যাম্পিয়ন।”
খেলোয়াড়ী জীবন থেকে অবসর নেওয়ার পর ম্যারাডোনা আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের ম্যানেজারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০০৮ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্বে ছিলেন। এরপর তিনি মধ্যপ্রাচ্য ও মেক্সিকোতে কোচ হিসেবে কাজ করেন।
বছরের পর বছর ধরে ড্রাগ গ্রহণ, অতি-ভোজন এবং মদ্যপানের কারণে তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে।
আর্জেন্টিনার লা প্লাটাতে তিনি এ মাসের শুরুর দিকে হাসপাতালে ভর্তি হন, রক্তশূন্যতা এবং হাল্কা-পানিশূন্যতার কারণে।
এরপর তার মাথায় রক্তক্ষরণের লক্ষণ দেখা যায়। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার কয়েক দিনের মাঝে তার মৃত্যু ঘটে।