গত ছয় বছর ধরে মেলবোর্নে বসবাস করছেন বাংলাদেশী তাসমীহা তরফদার। এর আগে অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন শহরে থেকেছেন স্বামীর পড়াশুনা এবং চাকরির সুবাদে। এই জুলাই মাসে তাসমীহা RMIT বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি অর্জন করেছেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়েই তিনি শিক্ষকতা করেন। অনেক ছোটবেলা থেকেই তাসমীহার লিখালিখির ইচ্ছা।
এসবিএস বাংলাকে তাসমীহা বলেন, পিএইচডি থিসিস লিখার সময়ে তিনি ভাবতেন যে, তিনি একটি উপন্যাস লিখবেন। তিনি বিশ্বাস করেন, সৃজনশীলতা কোনো ব্যক্তির মনের দরোজা খুলে দেয়। কারণ, থিসিস হচ্ছে এমন একটি লিখার কৌশল যেখানে কঠিন কাঠামোর মধ্যে দিয়ে নিজের যৌক্তিক বক্তব্য প্রকাশ করতে হয়। এই জন্য তাসমীহা সময় আর সুযোগ খুঁজতেন সৃজনশীল কিছু লিখার জন্য।
এই সুযোগটি তাকে এনে দিয়েছে বৈশ্বিক করোনাভাইরাস।
যখন পুরো বিশ্ব কোভিড-১৯ এর থাবায় ক্ষত-বিক্ষত ও স্তব্ধ, তখন তাসমীহা বাচ্চাদের জন্য একটি বই লিখা শুরু করেন।
এসবিএস বাংলাকে তাসমীহা বলেন,
“বই লিখা বললেই তো হয় না, এর আগে-পরে অনেক প্রক্রিয়া থাকে, যা একা করা খুবই কঠিন।”
যাহোক, তিনি প্রথমে সে বইটি লিখা শেষ করলেন। বইটি শিশুদের জন্য, যাদের বয়স ৫-৭ বছর। করোনাভাইরাসের এই সঙ্কটকালে শিশুরা কীভাবে তাদের পরিবারের সাথে বাসায় সময় কাটাচ্ছে সেটিই এর মূল উপজীব্য বিষয়।
তার বইটির নাম “My special time in lock down"
বইটির কেন্দ্রীয় চরিত্র 'Roary' নামের একটি শিশু। এই লকডাউনের সময়টিতে রোরির অভিজ্ঞতা সারা বিশ্বের শিশুরা ভাগাভাগি করে নিতে পারবে। এতে সেই সমস্ত শিশুদেরও তুলে ধরেছেন তাসমীহা, যারা রোরির মত বিলম্বে কথা বলে। রোরির অভিজ্ঞতা থেকে অনেক পিতা-মাতা ধারণা গ্রহণ করতে পারেন বলে মনে করেন বইটির লেখিকা তাসমীহা।
ছোটদের জন্য বই লিখা হলে শুধু পাতার পর পাতা শব্দ ও বাক্যের সারি সাজেয় গেলেই চলে না। এর সঙ্গে যদি ভাল ইলাস্ট্রেশন থাকে, তবে তা শিশুদের কাছে ভাল লাগবে বলে মনে করেন তাসমীহা। তবে, ইলাস্ট্রেটর খুঁজে পেতে বিড়ম্বনার কথা জানালেন তিনি।
“প্রথমে পরিচিতদের মধ্যে খুঁজছিলাম। কিন্তু তিন মাসেও যখন কোনো কাজ হলো না তখন পুরো ব্যাপারটাই বই বন্ধ করার মতো অবস্থা হলো।”
“অনেকদিন পরে এই পুরো ব্যাপারটি একদিন আমার ছোট ভাইয়ের স্ত্রীকে বললাম। তখন থেকেই আবার কাজ শুরু হলো।”
“আমি তখন ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে ইলাস্ট্রেটরের খোঁজে বিজ্ঞাপন দিলাম। মোট ১৫০ জন সাড়া দিল। ল্যাটিন আমেরিকা থেকে শুরু করে ইন্ডিয়া পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ থেকে দরখাস্ত পড়লো। এদের মধ্যে প্রথমে ৭ জন, তারপরে ৩ জন এবং সবশেষে ইফফাত ফাহমিদাকে তিন বার ইন্টারভিউ করে তাকে নির্বাচিত করলাম।”
বইটির কিন্ডল এবং পেপারব্যাক, উভয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে অ্যামাজন-এ।
বইটি কেন ইংরেজিতে লেখা হলো তা জানতে চাইলে শিশুদের উপরে কোভিড-১৯ এর প্রভাব নিয়ে উল্লেখ করে তিনি বলেন,
“আমি আমার প্রথম বাচ্চাদের বইটি ইংরেজিতে লিখেছি; কারণ, ১৮৮ টি দেশের ১.৫ বিলিয়ন শিশু এবং যুবকেরা ইন্টারনেট, টেলিভিশন এবং অন্যান্য দূর-শিক্ষণ শিক্ষার প্রোগ্রামের মাধ্যমে ঘরে বসে স্কুলের পড়াশুনা করছে।”
“সুতরাং, এই বইটির সেই সমস্ত শিশুর কাছে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, যাদের মাতৃভাষা ইংরেজি এবং যেখানে এটি দ্বিতীয় ভাষা বা বিদেশী ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। শিশুরা সহজেই পড়তে পারে, সে জন্য এটি সহজ ইংরেজি ভাষাতে লেখা হয়েছে।”
“অস্ট্রেলিয়ায় ২০১৫ সালে ৫-১২ বছর বয়সী ২.২ মিলিয়ন শিশু স্কুলে পড়াশুনা করেছে, তার মধ্যে ৪.১ শতাংশ, যার অর্থ ৯১,০০০ শিশুর কোনো না কোনো যোগাযোগের অক্ষমতা ছিল। এই ৪৭.১ শতাংশ শিশু মূলধারার স্কুলের একটি স্পেশাল ক্লাস (২৪%) অথবা স্পেশাল স্কুলে (২৩.৮ %) অংশ নিয়েছিল।”
যারা ভাষার বিলম্বের মতো কঠিন অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তারা সবাই এই বইটি থেকে একই অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেবে বলে মনে করেন তাসমীহা।
তিনি বলেন, “ দেখা গিয়েছে, ছেলে বাচ্চারা যাদের বয়স ৩ থেকে ১৭ বছর পর্যন্ত, তাদের ভয়েস, স্পিচ, ভাষা, এবং বিভিন্ন রকম swallowing ডিসর্ডার মেয়েদের তুলনায় বেশি। ছেলেরা ৯.৬ %, মেয়েরা ৫.৭ %।”
বইটি কখনও বাংলায় অনুবাদ করার পরিকল্পনা রয়েছে কিনা জানতে চাইলে তাসমীহা বলেন,
“My special time in Lockdown বইটি বাংলায় অনুবাদ করার পরিকল্পনা রয়েছে। আগামী বছর একুশে বই মেলার জন্যও আরো বাংলা বই লেখারও পরিকল্পনা রয়েছে।”
তাসমীহার বিশ্বাস লকডাউনের সময় নিজেকে যদি সৃজনশীল কাজে ব্যস্ত রাখা যায়, তাহলে দৈনন্দিন অফিসের কাজ আর সংসারের কাজেও ভালো থাকা যায়। পাশাপাশি, নিজের পরিবারকেও খুশি-মনে ভালো সময় দেওয়া যায়।
তাসমীহা দুই সন্তানের জননী। আর বড় ছেলের বয়স ১৬ বছর আর ছোট ছেলের বয়স ৫ বছর। স্বামীও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন।
তাসমীহা মনে করেন,
“একজন মেয়ে যদি তার পরিবার থেকে উৎসাহ পায় তাহলে বাংলাদেশের সব মেয়েই নিজেকে বিশ্বের দরবারে, নিজের ট্যালেন্ট তুলে ধরতে পারবে।”