১০ জানুয়ারি, ১৯৭২: বঙ্গবন্ধুকে যেভাবে দিল্লিতে স্বাগত জানানো হয়েছিলো

১০ জানুয়ারি,১৯৭২। দিল্লির তৎকালীন পালাম বিমানবন্দরে ২১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে সদ্যোজাত রাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রধান শেখ মুজিবর রহমানকে স্বাগত জানানোর পর প্রত্যুত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,"ইন্দিরা গান্ধী শুধু মানুষের নেতা নন, মানবতারও নেত্রী।"

Sheikh Mujibur Rahman

Bangladeshi children pay tribute with flowers to Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, infront of Bangabandhu Museum on Monday, 15 August 2005. Source: EPA

হাইলাইটস 

  • চারদিকে তখন গোলাপ আর গাঁদা ফুলের পাঁপড়ি উড়ছে, এক স্বাধীনতার যোদ্ধাকে সম্মান জানাতে।
  • কথা ছিল, দিল্লি থেকে কলকাতা হয়ে ঢাকায় ফিরবেন, স্বাধীনতার সংগ্রামে জয়ী বঙ্গবন্ধু। 
  • জে এন দীক্ষিত ৮ জানুয়ারি দিল্লিতে ভারত সফররত বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা সরকারের প্রতিনিধি দলকে প্রথম জানিয়েছিলেন পাকিস্তানের জেল থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির কথা।
  • বিমান থেকে নেমে আসার সময় বঙ্গবন্ধুর মুখেও ছিল, সেই চেনা স্লোগান, জয় বাংলা।
ডিজিট্যাল যুগে গুগল সার্চে অনেক কিছু পাওয়া গেলেও নেই ১১ জানুয়ারির সকালের ভারতীয় সংবাদপত্রের কোন সংস্করণের ছবি। জাতীয় গ্রন্থাগারের অবস্থাও তথৈবচ। কিন্তু ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারির সকালে দিল্লির পালাম বিমানবন্দরের ছবি আজও অনেক ভারতীয় সাংবাদিকের মনে উজ্জ্বল।

ব্রিটিশ সরকারের রয়াল এয়ার ফোর্সের রূপালি রঙের জেটলাইনের বিমান থেকে ঋজু মানুষটি নেমে এসেছিলেন গ্রে রঙের স্যুট আর কালো রঙের ওভারকোর্ট পরে। সামনেই তখন দাঁড়িয়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি। যে রাষ্ট্র প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশকে।

কিন্তু সবার নজরে তখন লৌহমানবী ইন্দিরা গান্ধী। অনেক পরে ইন্দিরার পাশে যিনি ধুতি -পাঞ্জাবি আর শাল পরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেই আপাদমস্তক বাঙালি, সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, আবেগতাড়িত বঙ্গবন্ধু 'র চোখ তখন অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছিল, কৃতজ্ঞতা ভাষায় প্রকাশ করতে না পেরে। যা দেখে নাকি সেই সময়ের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় যাকে অনেকেই মানু দা বলে চেনেন, তিনিও নাকি কেঁদে ফেলেছিলেন।

কথা ছিল, দিল্লি থেকে কলকাতা হয়ে ঢাকায় ফিরবেন, স্বাধীনতার সংগ্রামে জয়ী বঙ্গবন্ধু। সেই মত দিল্লির বিমানবন্দরে তৈরি রাখাও ছিল, ভারতের রাষ্ট্রপতির বিশেষ বিমান, রাজহংস। কিন্তু, রাইসিনা হিলসের রাষ্ট্রপতি ভবনে সৌজন্য সাক্ষাৎকারের মধ্যেই মত পাল্টান বঙ্গবন্ধু।

১৮ ঘন্টার জার্নি করে, ১০ জানুয়ারি, সকল ৮ টা ১০ মিনিটে দিল্লি পৌঁছানোর কিছু ক্ষণের মধ্যে, বিদেশমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদকে জানিয়ে দিয়ে ছিলেন, যত দ্রুত সম্ভব ফিরতে চান ঢাকায়। দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে তখন প্রাতঃরাশ বৈঠকে ছিলেন ইন্দিরা গান্ধীও।

একই সঙ্গে জানিয়ে দিয়েছিলেন রাজহংস নয়, কৃতজ্ঞতা জানাতে ব্রিটিশ বিমানেই সোজা দিল্লি থেকে পৌঁছাতে চান ঢাকা। যেখানে তাঁর ফেরার জন্যে অপেক্ষায় আছেন লক্ষ -কোটি মুক্তি যোদ্ধা -দেশবাসী। বঙ্গবন্ধুর সেই সির্দ্ধান্তকে সম্মান জানিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। অনেক পরে তা জানিয়েছিলেন কূটনীতিবিদ জে এন দীক্ষিত।

এই দীক্ষিতই ৮ জানুয়ারি দিল্লিতে ভারত সফররত বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা সরকারের প্রতিনিধি দলকে প্রথম জানিয়েছিলেন পাকিস্তানের জেল থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির কথা।

আসলে দেশ বিদেশের চাপের মুখে পশ্চিম পাকিস্তানের ইয়াহিয়া খান বা ভুট্টোদের ওপর চাপ বাড়ছিলই, কিন্তু দিনক্ষণ নিয়ে সংশয় ছিল। মনে করেছেন, দিল্লির সেই সময়ে কর্মরত বিদেশ মন্ত্রকের এখনো জীবিত হাতে গোনা কর্মকর্তাদের একজন। বলেছেন, তারও কদিন আগেই ঢাকা থেকে এসেছিল, ওই প্রতিনিধি দল, অ্যাডভান্স পার্টি হিসাবে।

কিন্তু তা যে ৮ জানুয়ারিতে হয়ে যাবে, সেই সম্পর্কে তখনও কোনো নির্দিষ্ট তথ্য ছিল না, সম্ভবত জানতেন ইন্দিরা গান্ধী, জে এন দীক্ষিত, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র -এর প্রধান রাম নাথ কাও, প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি পি এবং হাকসার আর বিদেশ সচিব টি কাউল।

এরাই ১০ জানুয়ারি সকালে, দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে হাজির হয়েছিলেন, সেই সময়ের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানকে স্বাগত জানাতে। পরে যে বিমানবন্দরের নামকরণ করা হয়েছে, ইন্দিরা গান্ধীর নামেই।

সেদিন সকালের বর্ণনা দিতে গিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কূটনীতিক বলেছেন, তিনি তখন বেশ জুনিয়র। চারদিকে তখন গোলাপ আর গাঁদা ফুলের পাঁপড়ি উড়ছে, এক স্বাধীনতার যোদ্ধাকে সম্মান জানাতে। ২১ বারের তোপ, মিলিটারি ব্যান্ডে আমার সোনার বাংলা আর তারপর জন গণ মন, দুদেশের জাতীয় সংগীত শুনে চোখে নাকি তখন অনেকেরই জল।

বিমান থেকে নেমে আসার সময় বঙ্গবন্ধুর মুখেও ছিল, সেই চেনা স্লোগান, জয় বাংলা।

সেদিনটার কথা স্পষ্ট মনে আছে দিল্লির অনেকের। রিপোর্টার -ক্যামেরাম্যান তো বটেই, অনেক সাধারণ মানুষ, কংগ্রেসের কর্মী সমর্থকরাও বিমানবন্দরে হাজির হয়েছিলেন। একবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে চোখের দেখা দেখবেন বলে।

স্মৃতি বলছে, বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানাতে প্রথমে ইন্দিরা গান্ধী হিন্দিতে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রেখেছিলেন। তারপর বঙ্গবন্ধু শুরু করেছিলেন বাংলাতেই .. মিসেস গান্ধী, লেডিজ এন্ড জেন্টেলম্যান বলে, আর তারপরই হাজারো পায়রা ওড়ার শব্দ, হাততালিতে ঢেকে গিয়েছিল, বঙ্গবন্ধু'র ওই উদাত্ত আওয়াজও। একটু থেমে তারপর বলেছিলেন তাঁর জন্যে এটা একটা বিরল এবং খুব গুরুত্বপূর্ণ কৃতজ্ঞতার মুহূর্ত।

রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরির স্বাগত ভাষণের জবাবে বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমান বলেছিলেন কেন তিনি দেশে ফেরার আগে দিল্লিতে আসতে চেয়েছেন, বলেছিলেন তাঁর দেশের মানুষের বিশেষ বন্ধু, ভারতের মানুষের এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সরকারের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধা জানাতে তিনি এসেছেন।

তারপরই বলেছিলেন মিসেস ইন্দিরা গান্ধী তিনি শুধু মানুষের নেত্রী নন, মানবতার নেত্রী।

আরো দেখুনঃ


 


Share
Published 12 January 2021 6:20pm
By Partha Mukhopadhyay
Presented by Shahan Alam

Share this with family and friends