হাইলাইটস
- বর্ষীয়ান বাংলাদেশি-অস্ট্রেলিয়ান মিঃ নজরুল ইসলাম অস্ট্রেলিয়ায় বাস করছেন ১৯৭০ সাল থেকে
- বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে অস্ট্রেলিয়ায় জনমত গঠনে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন
১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বরে অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম বাঙালি হিসেবে স্থায়ী অভিবাসন নিয়ে আসেন নজরুল ইসলাম। পেশায় জুওলজিস্ট মিঃ ইসলামের সাথে আসেন তার স্ত্রী ইয়াসিন ইসলাম, দুই শিশু সন্তান অমিতাভ ইসলাম এবং মেয়ে নাদিয়া ইসলাম।সেসময় বাংলাদেশের গণহত্যার খবরে নজরুল ইসলাম ও অন্যান্য বাঙালী শিক্ষার্থী যারা অস্ট্রেলিয়ায় ছিলেন তারা মানসিকভাবে অস্থির হয়ে উঠেন। দেশের সঙ্গে চিঠিপত্র ও অন্যান্য যোগাযোগ প্রায় বন্ধ থাকার পরেও মিঃ ইসলাম মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ওই সময়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরাত বাঙালিদের সাথে মিলে জনমত গঠনের কাজ চালিয়ে যান। সেসময় তাদের ভূমিকা এবং বাঙালীদের প্রতি অস্ট্রেলিয়ানদের সমর্থনসহ বিভিন্ন কর্মকান্ড নিয়ে এসবিএস বাংলার সাথে স্মৃতিচারণ করেছেন মিঃ নজরুল ইসলাম।
নজরুল ইসলাম অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে অস্ট্রেলিয়ায় জনমত গঠনে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন Source: Nazrul Islam
অস্ট্রেলিয়ায় তার আগমন এবং বাঙালীদের অবস্থান বিষয়ে নজরুল ইসলাম বলেন, ১৯৭০ সালে অস্ট্রেলিয়ায় হাতে গোনা কয়েকজন বাঙালী ছিলেন যাদের বেশিরভাগই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, এসেছেন শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে। তাছাড়া কয়েকজন বাঙালী শিক্ষার্থী পড়াশোনা শেষে স্থানীয়দের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে অস্ট্রেলিয়াতে আবাস গড়েন।
"আমি পেশায় জিওলজিস্ট, আমি পাকিস্তান এবং ইরানে কাজ করার পর জিওলজিস্ট হিসেবে আরো অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য অস্ট্রেলিয়াকে বেছে নেই, তাছাড়া আমি ছিলাম কিছুটা এডভেন্চেরাসও। প্রথমে আমি পাঁচ বছরের জন্য ভিসা চেয়েছিলাম, কিন্তু তারা আমাকে সরাসরি পার্মানেন্ট রেসিডেন্সি দিয়ে দেয়, তবে সেসময় এমন কোন নিয়ম ছিল না যে আমাকে থাকতেই হবে, ভিসার নিয়ম এমনই ছিল, হয় শিক্ষার্থী, ভিসিটর হিসেবে বা পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট হিসেবে।"
২৫শে মার্চের রাতে বাঙালীদের ওপর পাকিস্তানি সৈন্যদের আক্রমণের খবর আমরা রেডিওতে পাই কয়েকদিন পর। সেসময় অবশ্য নিউজপেপার বা টিভিতে এ সংক্রান্ত খবর খুব কম পাওয়া যেতো।
মিঃ ইসলাম অস্ট্রেলিয়ায় যখন আসেন তখন তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে রাজনৈতিক আন্দোলন চলছিল। তিনি প্রথমে মেলবোর্নে আসেন এবং কাজ নিয়ে সিডনিতে যান। এর কয়েকমাস পরই বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়।
তিনি বলেন, "২৫শে মার্চের রাতে বাঙালীদের ওপর পাকিস্তানি সৈন্যদের আক্রমণের খবর আমরা রেডিওতে পাই কয়েকদিন পর। সেসময় অবশ্য নিউজপেপার বা টিভিতে এ সংক্রান্ত খবর খুব কম পাওয়া যেতো। আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম সেসময় আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতায় আসে তবে বাঙালিদের প্রতি বৈষম্য কমে আসবে। কিন্তু আমরা খবর পেলাম ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে আক্রমণ ও ছাত্র হত্যার, এসব খবর ছিল আমাদের কল্পনারও বাইরে।"
এসময় আমি অনুভব করলাম, আমাদের উচিত অস্ট্রেলিয়ানদের এ বিষয়ে জানানো প্রয়োজন, গণহত্যার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা দরকার।
সেসময় পাকিস্তানী শিক্ষার্থীদের বলা হলো কেউ যদি আওয়ামীলীগের ৬ দফার সমর্থনে কথা বলে তবে তাদের দেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে, এতে অনেকেই নিষ্ক্রিয় ছিল বা এ নিয়ে খুব একটা কথা বলতে চাইতো না, তবে বাঙালী স্টুডেন্টরা নিজেদের মধ্যেই শুধু কথা বলতো।
মিঃ ইসলাম বলেন, "এসময় আমি অনুভব করলাম, আমাদের উচিত অস্ট্রেলিয়ানদের এ বিষয়ে জানানো প্রয়োজন, গণহত্যার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলা দরকার।"
কিন্তু আমি একা আর কি করতে পারি। এসময় বুয়েটের শিক্ষার্থী আজিজুল হক যিনি পিএইচডি করতে এসেছিলেন তার সাথে যোগাযোগ হয়, তিনি ঝুঁকি জেনেও কিছু করার উদ্যোগে আমার সাথে যোগ দেন। তিনি জানান অস্ট্রেলিয়ার স্টুডেন্ট এসোসিয়েশনগুলো বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের অন্যায় অবিচার নিয়ে বেশ সোচ্চার।"
অস্ট্রেলিয়া হচ্ছে প্রথম ওয়েস্টার্ন ডেমোক্রেসি যারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিলো। তবে দুৰ্ভাগ্যবশতঃ এটা নিয়ে কোন বাংলাদেশী গবেষক, সাংবাদিক কোন প্রকার গবেষণা বা খোঁজ করেনি কেন অস্ট্রেলিয়া সর্বপ্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলো, এর পেছনে কি কারণ ছিলো।
তিনি বলেন, "অস্ট্রেলিয়ান ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতারা তাকে বেশ সাহায্য করেছিল সেখানে একটি মিটিংয়ের আয়োজন করা হয়েছিল যেখানে প্রায় চারশো মানুষ উপস্থিত হয়েছিল। শিক্ষার্থী ছাড়াও সেখানে অনেক শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, ব্যবসায়ীসহ নানা পেশার লোকেরা অংশ নিয়েছিল। এই মিটিংয়ে আমার বক্তব্য ছিল বেশ আবেগপূর্ণ। সেখানে ভারতীয় গবেষক দেবেশ ভট্টাচাৰ্য বাঙালীদের প্রতি বৈষম্যের কথা তুলে ধরেন, তাছাড়া একজন সমাজকর্মী যিনি পূর্ব পাকিস্তানে কাজ করেছেন, তিনি বাঙালীদের বিষয়ে উচ্চ ধারণা করে বক্তব্য দেন। সেই মিটিংয়ের পর বাংলাদেশকে সমর্থন করতে একটি নয় সদস্যের কমিটি হয়।"
নজরুল ইসলাম বলেন, "এই কমিটির মাধ্যমে আমরা ব্যাপক জনমত গড়ে তুলতে সক্ষম হই, সাধারণ অস্ট্রেলিয়ানরা রিফিউজিদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করে বাংলাদেশে পাঠায়। কবি, শিক্ষাবিদ, এমনকি একজন তরুণ ট্রাক ড্রাইভারও অস্ট্রেলিয়ান সরকারকে শরণার্থীদের জন্য অর্থ দিতে অনশন করে।"
"আমাদের এই জনমত গড়ে তোলার প্রেক্ষিতে অস্ট্রেলিয়ান সরকার সেসময় প্রায় ৫ মিলিয়ন ডলার সাহায্য দেয়।"
মি: ইসলাম বলেন, "অস্ট্রেলিয়া হচ্ছে প্রথম ওয়েস্টার্ন ডেমোক্রেসি যারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিলো। তবে দুৰ্ভাগ্যবশতঃ এটা নিয়ে কোন বাংলাদেশী গবেষক, সাংবাদিক কোন প্রকার গবেষণা বা খোঁজ করেনি কেন অস্ট্রেলিয়া সর্বপ্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলো, এর পেছনে কি কারণ ছিলো।"
এসবিএস বাংলার পাঠক-শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে মিঃ ইসলাম বলেন, "অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশ দুটো দেশই আমার খুব প্রিয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অস্ট্রেলিয়ানদের সমর্থন-সহানুভূতি কখনো ভুলবার নয়। আমার অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসের প্রায় ৫০ বছর হয়ে গেলো, আমি এর ওপর একটি বই লিখছি। খুব শীঘ্রই এটি প্রকাশিত হবে। বাংলাদেশি পাঠকরা এটি পড়লে অনেক বিষয়ে জানতে পারবেন, বিশেষ করে বাংলাদেশের সমর্থনে অস্ট্রেলিয়ানদের ভূমিকা, প্রবাসী সরকারের সাথে তাদের যোগাযোগ ইত্যাদি।"
বর্ষীয়ান বাংলাদেশি-অস্ট্রেলিয়ান মিঃ নজরুল ইসলাম বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে বাস করেন।
আরো পড়ুনঃ