“হসপিটাল ইন দ্য হোম প্রোগ্রাম” (HITH) নামে এই উদ্যোগটি শুরু করেন মেলবোর্নের তথ্য-প্রযুক্তিবিদ রেদওয়ান জাকারিয়া এবং সিডনিতে কর্মরত ডাক্তার ফয়সল আহম্মদ চৌধুরী।
HITH এর প্রোগ্রাম ম্যানেজার রেদওয়ান জাকারিয়া এ সম্পর্কে এসবিএস বাংলাকে বলেন,
“অস্ট্রেলিয়াতে বাংলাদেশের তুলনায় আগে করোনাভাইরাস আসায় অস্ট্রেলিয়াতে ডাক্তাররা আগে এ বিষয়ক অভিজ্ঞতা লাভ করে। প্রথমদিকে সোশ্যাল মিডিয়াতে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখে বোঝা যাচ্ছিলো যে, বাংলাদেশের মানুষের এবং ডাক্তারদের করোনাভাইরাস মোকাবেলাতে সাহায্য প্রয়োজন।”
“করোনা-ভীতি ছাড়াও যথার্থ পরিচালনা এবং গাইডলাইনের অভাব দেখা যাচ্ছিল। যে কারণে বাংলাদেশের ডাক্তাররাও প্রথমদিকে আশঙ্কাজনকভাবে আক্রান্ত হয়ে পড়ছিলেন। যেহেতু মহামারী রোধে বাংলাদেশে ডাক্তারদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে, সেহেতু তাদের সাহায্য করার জন্য প্রাথমিকভাবে এই উদ্যোগ নেয়া হয়। অভিজ্ঞতাসহ জ্ঞান আদান প্রদান এবং নির্দেশনামালা প্রস্তুত করা হয়। এরপর অনলাইনের মাধ্যমে ডাক্তারদের নিয়ে সেশন আয়োজন করা হয়।”
এই উদ্যোগ শুরু করা প্রসঙ্গে রেদওয়ান জাকারিয়া আরও বলেন,
“বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপের প্রথমদিকে এপ্রিলের শেষে আমার ছোট ভাই ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তার রুশদান জাকারিয়া দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে পরে এবং আইসলেশনে থাকে। ডাক্তার ফয়সল এবং আমি তখন অস্ট্রেলিয়া হতে ওকে রিমোট সাপোর্ট করি। বোঝা যাচ্ছিলো যে, ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে করোনার প্রকোপ বেড়ে যাবে। ডাক্তার ফয়সল বাংলাদেশে তার পরিচিত ডাক্তারদের সাথে যোগাযোগ করে এবং আমরা তখন বাংলাদেশে জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকে এই প্রোগ্রাম শুরু করে একটি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে অন্যদের সাহায্য করার সুযোগ তৈরি করি।”
সিডনির ক্যাম্ববেলটাউন অ্যান্ড উলংগং হসপিটালস-এ কনসালটেন্ট রেসপিরেটোরি অ্যান্ড স্লিপ ফিজিশিয়ান হিসেবে কাজ করেন ডাক্তার ফয়সাল আহম্মদ চৌধুরী। সিডনিতে কোভিড-১৯ ফিজিশিয়ান হিসেবে শুরু থেকেই কাজ করছেন তিনি। এ বিষয়ে তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা রয়েছে।
তিনি বলেন,
“আমাদের প্রোগ্রামের যাত্রা শুরু হয়েছিল যখন আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি করোনা মহামারিতে জর্জরিত। অব্যবস্থাপনা এবং যথার্থ জ্ঞানের অভাব মানুষকে আতংকিত করে তুলেছিল। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল মানুষদের কোভিড সম্পর্কে সচেতন করে তোলা, চিকিৎসা বিষয়ক ভ্রান্ত ধারণা দূর করা, রোগীদের এভিডেন্স বেসড টেলিমেডিসিন সেবা প্রদান করা, কোভিডের হসপিটাল ফ্যাসিলিটি এবং হোম চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্ট ও তা ব্যবহার করার প্রক্রিয়ার ব্যাপারে অবাধ তথ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা।”
“আমাদের লক্ষ্য এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে আমরা রোগীদের বাসায় বসে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে পারব এবং হসপিটালগুলোর উপর অপ্রয়োজনীয় চাপ কমাতে পারবো। সেই সাথে যাদের হসপিটাল ভর্তি হওয়া জরুরী তাদের সময়োপযোগী উপদেশ প্রদান করতে পারবো।”
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারীর এই সঙ্কট থেকে সেখানকার চিকিৎসকদেরকে সহায়তা করতে চান রেদওয়ান জাকারিয়া ও ডাক্তার ফয়সাল আহম্মদ চৌধুরী। বাংলাদেশে কোভিড-১৯ রোগীদের নিয়ে সরাসরি কাজ করা স্বল্প-সংখ্যক ডাক্তার নিয়ে এই প্রোগ্রামটি শুরু করেন তারা। পরবর্তীতে এতে আরও লোকজন যোগ দেয়।
বাংলাদেশের ডাক্তারদেরকে গাইডেন্স ও কনসালটেন্সি সার্ভিস প্রদান করা হয়। এর ফলে প্রাথমিকভাবে উপকৃত হন সংক্রামিত ব্যক্তিরা ও তাদের পরিবার-পরিজন ও বন্ধু-বান্ধবেরা।
বাংলাদেশ সোসাইটি অফ মেডিসিন-এর সহযোগিতায় HITH টিম একটি "Clinical Guidelines for the Management of Moderate to Severe COVID-19 Disease – Bangladesh Model - v2" তৈরি করেছে। এটি HITH এর ফেসবুক পেজে পাওয়া যাবে।
HITH প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সোসাইটি অফ মেডিসিন এর সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর আহমেদুল কবির বলেন,
“হসপিটাল ইন দি হোম একটি খুব সমসাময়িক প্রোগ্রাম যেখানে আমরা অস্ট্রেলিয়ান কোভিড ফ্রন্ট লাইন ডাক্তারদের সহযোগিতা নিয়ে অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে, একটি হোম-বেসড ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইন তৈরি করতে, স্থানীয় ডাক্তারদের একটি সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে টেলিমেডিসিন সেবা সরবরাহ করতে এবং সময়োপযোগী স্ট্রিমলাইন উপস্থাপনার সুবিধার্থে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য কাজ করেছি।”
“হাসপাতালে এই রোগীর প্রবাহকে আরও দক্ষতার সাথে পরিচালনা করতে এবং আমাদের উপর ন্যস্ত স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় অপ্রয়োজনীয় রোগীর বোঝা কমাতে এই প্রোগ্রামটির ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। আমি এই মহামারী সংকট চলাকালীন মানবতার সেবা করার এই জনহিতকর উদ্যোগকে অভিনন্দন ও সমর্থন করছি।”
হালকা থেকে মাঝারি পর্যায়ের কোভিড-১৯ রোগীরা যারা ঘরে অবস্থান করে থাকেন, তারা কীভাবে চিকিৎসা গ্রহণ করবেন সে সম্পর্কে একটি ম্যানেজমেন্ট প্রটোকল তৈরি করেছে HITH.৬৪ জন নিবন্ধিত ডাক্তারকে নিয়ে গত ২৩ জুন ২০২০ তাদের প্রথম জুম ট্রেইনিং সেশন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এদের মধ্য থেকে ১৫ জনকে বাছাই করা হয়েছে এই প্রোগ্রাম এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
HITH এর স্বেচ্ছাসেবী ডাক্তাররা গত ২০ জুলাই ২০২০ থেকে বাংলাদেশের কোভিড-১৯ রোগীদেরকে বিনামূল্যে টেলিমেডিসিন এবং কনসাল্টেন্সি সেবা প্রদান করছেন। Source: Redwan Zakariah
HITH এর স্বেচ্ছাসেবী ডাক্তাররা গত ২০ জুলাই ২০২০ থেকে বাংলাদেশের কোভিড-১৯ রোগীদেরকে বিনামূল্যে টেলিমেডিসিন এবং কনসাল্টেন্সি সেবা প্রদান করছেন। মূলত হালকা ও মাঝারি ধরনের কোভিড-১৯ রোগীদেরকেই এই সেবা প্রদান করা হচ্ছে। HITH এর রোগীদের ফর্ম পূরণ করে কোভিড সাসপেক্ট অথবা কোভিড সিম্পটমসহ রোগী দ্রুত স্বেচ্ছাসেবী টেলিমেডিসিন ডাক্তারদের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারেন।
HITH এর স্বেচ্ছাসেবী টেলিমেডিসিন দলের একজন, বাংলাদেশের Institute of Epidemiology Disease Control And Research (IEDCR) এ কর্মরত ডাক্তার পঙ্কজ কুমার নাহা বলেন,
“আমি মানবসেবায় HITH এ যোগদান করেছি। HITH এর অবশ্যই বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যায় বিনামূল্যে কন্সালটেশন দেয়া উচিত। কিন্তু আমি মনে করি, আমরা প্রবাসী বাংলাদেশীদেরও এই বিশ্ব মহামারীর সময়ে সাহায্য করতে পারবো এবং আমাদের কার্যক্রম এগিয়ে নিতে পারবো।”
বিশ্বে নতুন করোনাভাইরাসের প্রাদূর্ভাবের পর এ সম্পর্কে বাংলাদেশে ডাক্তারদের কাছে তেমন কোনো তথ্য ছিল না। এ বিষয়ে তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বাড়ানোর জন্য এই প্রোগ্রামটির মাধ্যমে তাদেরকে সহায়তা করা হয়েছে।
HITH এর ডাক্তার ফয়সাল আহম্মদ চৌধুরী এসবিএস বাংলাকে বলেন,
“আমাদের HITH প্রোগ্রামে আমাদের সহযোগিতা করেছেন অস্ট্রেলিয়াতে বসবাসরত বাংলাদেশী ডাক্তারদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকাল সোসাইটি অফ এন-এস-ডব্লিউ। আমি এজন্য প্রেসিডেন্ট অফ বাংলাদেশ মেডিকেল সোসাইটি অফ এন এস ডব্লিউ, ডাক্তার শায়লা ইসলাম (ইমারজেন্সি ফিজিশিয়ান, ব্ল্যাকটাউন হসপিটাল) এবং ডাক্তার মো. সায়েক খান (সিনিওর ICU স্পেশালিষ্ট, ব্ল্যাকটাউন হসপিটাল)-কে আন্তরিক অভিবাদন জানাচ্ছি।”
হালকা ও মাঝারি ধরনের কোভিড-১৯ রোগীদের টেলিমেডিসিন সেবা প্রদানের পাশাপাশি এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে ডাক্তার ফয়সল আহম্মদ চৌধুরী নিজে তার সাধ্যমত কয়েকজন ক্রিটিকাল রোগীকে রিমোট কন্সালটেশন দিয়ে সাহায্য করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। উপকৃত বাংলাদেশের প্রিমিয়ার ব্যাংকের জুনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট সেখ নওশীন লায়লা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন,
“এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে আমি ডাক্তার ফয়সল আহম্মদ চৌধুরীর যে সাহচর্য পেয়েছি তা অনবদ্য। আমার আব্বা একজন উচ্চ রক্তচাপ এবং মূলত কিডনী ডায়ালাইসিস এর রোগী, যিনি ২৯ জুলাই ২০২০ এ কোভিড আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। খুবই ক্রিটিকাল পরিস্থিতিতে তিনি HDU, COVID ICU এবং কেবিনে থাকা অবস্থায় হাসপাতালের ডাক্তার, বিশেষ করে ICU team এর সাথে ডাক্তার ফয়সল যে তার মূল্যবান মতামত এবং পরবর্তীতে আব্বার সব প্যাথলজিকাল রিপোর্ট এর যথার্থ ব্যাখ্যা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন যা আমার পরিবারের জন্য খুব প্রয়োজনীয় ছিল আর মানসিক শান্তিও দিয়েছে।”
“এখনও আমার আব্বা হসপিটালে নন-কোভিড কিন্তু নিউমোনিয়া আর ডায়ালাইসিসের ট্রিটমেন্ট নিচ্ছেন এবং ডাক্তার ফয়সল আমাদেরকে সুদূর অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন।”
প্রোগ্রামের অর্থায়ন এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে HITH এর প্রোগ্রাম ম্যানেজার রেদওয়ান জাকারিয়া এসবিএস বাংলাকে বলেন,
“এখন পর্যন্ত এই প্রোগ্রামের অর্থায়ন আমরা নিজেরাই করে আসছি। অংশগ্রহণকারী ডাক্তাররা স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে কাজ করছেন করোনাভাইরাস মোকাবেলায়। বাংলাদেশে আমাদের সাথে কো-অর্ডিনেশনের অংশ পালন করার জন্য আছেন ডাক্তার মাহমুদুল কবির শাওন এবং ডাক্তার রোকন-উজ-জামান সুমন এবং ডাক্তার আহাদ হোসেন।”
“আমি প্রোগ্রামে অংশ নেওয়া সকল চিকিৎসক এবং সহায়তাপ্রদানকারী সবাইকে ধন্যবাদ জানাই। এই বৈশ্বিক মহামারীর সময়ে আমাদের প্রোগ্রাম প্রথম থেকেই কার্যকারী ভুমিকা রাখতে পারছে এবং দেশের সীমানা অতিক্রম করে মানুষের সহায়তায় পাশে দাড়াতে পারছে।”
“অস্ট্রেলিয়ার চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা পৃথিবীতে প্রথম সারিতে অবস্থান করে বলে আমি মনে করি। অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী বাংলাদেশী স্পেশালিস্ট ডাক্তাররা আমাদের মাধ্যমে বাংলাদেশে করোনার মতো অন্যান্য রোগের ক্ষেত্রে চিকিৎসা সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান শেয়ার করতে পারেন। বাংলাদেশে মানুষের স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করতে পারেন এবং বাংলাদেশে চিকিৎসকদের সাথে একত্রে কাজ করতে পারেন।”
“ আমি আশা করি আমাদের অগ্রযাত্রা সফলভাবে অব্যাহত থাকবে এবং স্বাস্থ্য চিকিৎসা বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারবো।”
অস্ট্রেলিয়ার জনগণকে অবশ্যই পরস্পরের মাঝে কমপক্ষে ১.৫ মিটার দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। জন-সমাগমের সীমা সম্পর্কে জানতে আপনার রাজ্যের নিষেধাজ্ঞাগুলো দেখুন।
আপনার মাঝে যদি সর্দি-কাশির (কোল্ড কিংবা ফ্লু) লক্ষণ দেখা দেয়, তাহলে ঘরে অবস্থান করুন এবং আপনার ডাক্তারকে কল করে কিংবা করোনাভাইরাস হেলথ ইনফরমেশন হটলাইন, 1800 020 080 নম্বরে কল করে টেস্টের ব্যবস্থা করুন।
আপনার যদি শ্বাস-কষ্ট কিংবা মেডিকেল ইমার্জেন্সি দেখা দেয়, তাহলে 000 নম্বরে কল করুন।
বাংলায় করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) বিষয়ক আমাদের সর্বশেষ আপডেটের জন্য ভিজিট করুন:
READ MORE
কোভিড-১৯ এর সময়ে ব্যবসা ক্রয়