আপনি ইউনিভার্সিটি অফ নিউ সাউথ ওয়েলসের বিজনেস স্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন যার ফোকাস ছিল সোশ্যাল অন্ট্রেপ্রেনিউয়েরশিপ - এ বিষয়ে এসবিএস বাংলার পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন?
প্রথমেই ধন্যবাদ জানাই এসবিএস বাংলা ও এর পাঠকদের।
Social entrepreneurship বা সামাজিক ব্যবসায় উদ্যোগ বর্তমান কালের একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। Social entrepreneurship বা সামাজিক ব্যবসায় উদ্যোগ একটি দেশ ও সমাজের উন্নয়নের গতিকে খুব দ্রুত ত্বরান্বিত করতে পারে। আমরা যদি গ্রামীণ ব্যাংক অথবা ব্র্যাকের মতো প্রতিষ্ঠান গুলোর দিকে তাকাই তাহলে খুব সহজেই অনুধাবন করতে পারব যে কিভাবে এই প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের দারিদ্র্যপীড়িত এবং আরো অনেক সমস্যায় জর্জরিত একটি সমাজকে মুক্তির পথ দেখিয়েছে। পৃথিবীর আনাচে-কানাচে এরকম অনেক সামাজিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ছড়িয়ে আছে যাদের কার্যক্রম একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে এবং সেই দেশ ও সমাজের মানুষকে উন্নয়নের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে।
এবার বলি কেন আমি সামাজিক ব্যবসায় উদ্যোগ বিষয়টি নিয়ে পিএইচডি করার সিদ্ধান্ত নিলাম। একবার কোন এক পত্রিকায় আমি প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে একটি আর্টিকেল পড়েছিলাম। তাতে লেখা ছিল প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস কিভাবে নিজের পকেট থেকে অল্প কিছু অর্থ দিয়ে তার গ্রামের মহিলাদের ভাগ্য বদলে দেন। প্রফেসর ইউনূসের সেই প্রচেষ্টা শুধু বাংলাদেশের সমাজের মানুষের ভাগ্য বদলাতে সাহায্য করেনি, বরং সমস্ত পৃথিবীতে একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়েছে যার নাম হল - “মাইক্রোফাইন্যান্স” (ক্ষুদ্রঋণ)। তখন থেকেই আসলে বিষয়টি সম্পর্কে আমার জানা প্রচন্ড আগ্রহ হয়।উচ্চ শিক্ষার প্রতি আগ্রহ থাকার জন্য পরবর্তীতে আমি অস্ট্রেলিয়ায় আসার সিদ্ধান্ত নেই এবং অস্ট্রেলিয়ার ইউএনএসডাবলু (UNSW) ইউনিভার্সিটি থেকে IPRS স্কলারশিপ পাওয়ার গৌরব অর্জন করি। তখনই সামাজিক ব্যবসায় উদ্যোগকে গবেষণার বিষয় হিসেবে বেছে নেই। গবেষণা কালীন সময় আমার প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস, স্যার ফজলে হাসান আবেদসহ বাংলাদেশের আরও অনেক সামাজিক ব্যবসায় উদ্যোক্তার সাথে সাক্ষাত হয় যা আমার জন্য অত্যন্ত শিক্ষণীয় এবং বিরল অভিজ্ঞতা ছিল।
গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা নোবেল বিজয়ী ডঃ ইউনূসের সাথে ডঃ সায়েম Source: সংগৃহিত
বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে সোশ্যাল অন্ট্রেপ্রেনিউয়েরশিপের তাৎপর্য কি এবং এতে নাগরিকরা কিভাবে উপকৃত হবেন?
প্রথমেই বলে নেই যে সামাজিক ব্যবসায় উদ্যোগ এর সুফল পৃথিবীর যে কোন ধরনের দেশ-ই পেতে পারে - তা হতে পারে উন্নত, স্বল্পোন্নত অথবা উন্নয়নশীল।
বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছোট-বড় মিলিয়ে এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজারের মতো সামাজিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ছড়িয়ে আছে। সামাজিক ব্যবসায় উদ্যোগ কিভাবে বাংলাদেশের মতো সমস্যা জর্জরিত একটি দেশের নাগরিকদের উপকার করতে পারে তা আমরা গ্রামীণ ব্যাংকের ও ব্র্যাকের কার্যক্রম দেখলেই বুঝতে পারি।এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সুফল শুধু বাংলাদেশের নাগরিকরাই নয় বরং পৃথিবীর নানা দেশের মানুষেরাই ভোগ করছে।
আর্থ-সামাজিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ আরো নানা ক্ষেত্র যেখানে সরকারি সাহায্য অপ্রতুল সেখানে সামাজিক ব্যবসায় উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি সামাজিক ব্যবসায় উদ্যোগ কে অন্যান্য যেকোনো ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে আলাদা করে তা হল যে - সামাজিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো দুইটি লক্ষ্য নিয়ে একসাথে কাজ করে – সামাজিক সমস্যার সমাধান এবং অর্থ উপার্জন যাকে বলা হয় হাইব্রিড বিজনেস মডেল।এই ধরনের বিজনেস মডেল অন্যান্য যেকোন বিজনেস মডেলের চেয়ে বেশি ইফেক্টিভ (কার্যকর) ও সাসটেইনেবল (টেকসই)।
আমি খুব অবাক হই এবং একই সাথে গর্ববোধ করি এটা জেনে যে, সামাজিক ব্যবসা উদ্যোগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে পৃথিবীর বুকে একটি রোল মডেল হিসেবে ধরা হয় । গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক ছাড়াও বাংলাদেশের আরো অসংখ্য সামাজিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান রয়েছে যাদের কার্যক্রম ও সেবা সমূহ পৃথিবীর দরবারে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে ।কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে সামাজিক ব্যবসায় উদ্যোগ বিষয়টির ক্ষেত্রে আমাদের দেশের মানুষের ধারণা এখনো খুবই সীমিত। শিক্ষা, গবেষণা, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, মিডিয়ার আলোচনা - কোন ক্ষেত্রেই সামাজিক ব্যবসায় উদ্যোগ বিষয়টি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচনায় আসেনি।
ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হোসেন আবেদের সাথে ডঃ সায়েম Source: সংগৃহিত
অস্ট্রেলিয়ার প্রেক্ষিতে সোশ্যাল অন্ট্রেপ্রেনিউয়েরশিপের সম্ভাবনা কতটুকু?
অস্ট্রেলিয়া একটি উন্নত দেশ। কিন্তু তারপরও অস্ট্রেলিয়ার সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে অনেক ধরনের সমস্যা আছে, আর এইসব সমস্যাগুলো সমাধানের ক্ষেত্রে সামাজিক ব্যবসায় উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ায় ছোট-বড় মিলিয়ে বিশ হাজারেরও বেশি সামাজিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এরকম অনেক ক্ষেত্রই রয়েছে অস্ট্রেলিয়াতে যেখানে সরকারি সাহায্য এখনো সম্পূর্ণরূপে পৌঁছায়নি। সেসব ক্ষেত্রগুলোতে সামাজিক ব্যবসায় উদ্যোগ অত্যন্ত মুখ্য ভূমিকা পালন করছে।
সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক বিষয়টি হলো যে অস্ট্রেলিয়া সামাজিক ব্যবসা উদ্যোগকে জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে বিভিন্নভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এখানকার শিক্ষা ব্যবস্থায় সামাজিক ব্যবসায় উদ্যোগ শেখার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া হয়। অস্ট্রেলিয়ার স্কুল পর্যায় থেকেই সামাজিক ব্যবসায় উদ্যোগ এর হাতে খড়ি দেওয়া হয়। বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সামাজিক ব্যবসায় উদ্যোগকে আলাদা একটি শিখার এবং গবেষণার বিষয় হিসেবে ধরা হয়।
আমি মনে করি যে, অস্ট্রেলিয়ায় যে বড় বড় সমস্যা গুলো রয়েছে যেমন - বিরূপ জলবায়ুর প্রভাব, মানসিক স্বাস্থ্য, আলকোহল অ্যাডিকশন এসব ক্ষেত্রগুলোতে সামাজিক ব্যবসায় উদ্যোগ অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।
আপনি অস্ট্রেলিয়ার এডুকেশন সেক্টরে কাজ করছেন বেশ কিছুদিন ধরে। আপনি কি আমাদের অস্ট্রেলিয়া এবং বাংলাদেশের এডুকেশন সিস্টেমের পার্থক্য বা মিল নিয়ে তুলনামূলক চিত্রটি সম্পর্কে কিছু বলবেন?
আমি বিগত আট বছর ধরে অস্ট্রেলিয়ার হায়ার এডুকেশন সেক্টরে কাজ করছি। এখানকার তিনটি বড় বড় বিশ্ববিদ্যাল য়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছি এবং আমার কাজের জন্য বিভিন্নভাবে প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হয়েছি, যেমন “ডিনস এক্সেলেন্স আওয়ার্ড ফর ইনোভেটিভ টিচিং”।
খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে আমার মতে, বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নত বিশ্বের তুলনায় অনেক বছর পিছিয়ে আছে। অস্ট্রেলিয়া শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মিল কোন জায়গাতেই নেই বরং বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। প্রথমেই অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে একটু বলে নেই ।
অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থা পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নত কয়েকটি শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে অন্যতম একটি হিসেবে ধরা হয়। জাতিসংঘের এডুকেশন ইনডেক্স অনুযায়ী অস্ট্রেলিয়ার এডুকেশন হলো পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে ভালো গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি ।
অস্ট্রেলিয়ার ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন হলো পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম একটি যা এই দেশের রপ্তানি আয়েরও একটি বড় উৎস। শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক শিক্ষা থেকে অস্ট্রেলিয়া প্রতি বছর প্রায় ত্রিশ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি উপার্জন করে থাকে। অস্ট্রেলিয়ান ইউনিভার্সিটি গুলোতে প্রায় দুইশ'র বেশি দেশের ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনা করে। অস্ট্রেলিয়ার বেশ কয়েকটি ইউনিভার্সিটি পৃথিবীর শীর্ষ পঞ্চাশটি ইউনিভার্সিটির মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থার যে বিষয়টি সবচেয়ে প্রশংসনীয় তা হল এখানে প্রাক্টিক্যাল লার্নিং বা ব্যবহারিক শিক্ষার প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া হয়। তাছাড়া শিক্ষার মান উন্নয়নে প্রযুক্তির ব্যবহার, শিক্ষকের মান উন্নয়ন, গবেষণাধর্মী শিক্ষা এবং উদ্ভাবনী চিন্তা ধারা এই দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে অনেকখানি এগিয়ে নিয়ে গেছে।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার কথা যদি বলতে হয়, তবে আমি বলবো যে বাংলাদেশে এখনো গতানুগতিক শিক্ষার কাঠামো থেকে বের হতে পারেনি। শিক্ষাখাতে আমাদের রাষ্ট্রের বিনিয়োগ বাড়লেও তা যথাযথভাবে ব্যবহার হচ্ছে না। কিছু প্রাইভেট স্কুল ও ইউনিভার্সিটির পড়ালেখার মান অনেক উন্নত হয়েছে বটে, কিন্তু তা দেশের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার চিত্র তুলে ধরে না।
খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে আমার মতে, বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার মূল সমস্যাগুলো হলো পুঁথিগত শিক্ষার উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া, শিক্ষকের এবং পাঠক্রমের মান উন্নয়ন না করা, পুরনো শিক্ষার কাঠামো থেকে বের না হওয়া, শিক্ষা খাতে প্রযুক্তিগত দক্ষতার অভাব, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণাধর্মী শিক্ষার অভাব।
বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করার মতন। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়নের এই ধারাকে বজায় রাখার জন্য প্রয়োজন শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার ও আধুনিকায়ন।
আপনি হট কিউবেটর নাম একটি স্টার্ট আপের প্রতিষ্ঠাতা - এর কার্যক্রম নিয়ে এসবিএস শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলবেন?
হট কিউবেটর এর শুরুটা হয় আমার গবেষণার অনুপ্রেরণা থেকে। হট কিউবেটর এর মূল লক্ষ্য হলো সুশিক্ষা ও উদ্যোগী মনোভাব এর প্রসার ঘটানো যা সমাজের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে।
শুরুতে এটা একটি শিক্ষাবিষয়ক কনসালটেন্সি ফার্ম হিসেবে কাজ করে। প্রাথমিক পর্যায়ে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সাথে পার্টনারশিপ তৈরি করি এবং তাদের বিভিন্ন রকম বিষয়ে সেবা দিয়ে থাকি যেমন - স্টুডেন্ট এনগেজমেন্ট বৃদ্ধি করা, সোশ্যাল বিজনেস ইনকিউবেশন সাপোর্ট, উন্নত এডুকেশনাল কারিকুলাম তৈরি করা, কর্পোরেট ট্রেনিং প্রোভাইড করা।
বর্তমানে হট কিউবেটর এর মাধ্যমে আমি মূলত মাইক্রো লার্নিং কে প্রমোট করার চেষ্টা করছি। হট কিউবেটর-এর এডুকেশনাল ব্লগ রয়েছে যা প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে থেকে পাঠ করে। আগামীতে হট কিউবেটর বিভিন্ন বিষয়ের উপর মাইক্রো লার্নিং কোর্স চালু করতে যাচ্ছে। আমার লক্ষ্য যে এ ধরনের মাইক্রো লার্নিং কোর্সগুলো বাংলাদেশের মতো দেশের ছাত্রদের কাছে উপস্থাপন করা, যেখানকার শিক্ষাব্যবস্থায় এখনো পুঁথিগত বিদ্যার প্রতি বেশি জোর দেয়া হয়।
আরো পড়ুন: