গুরুনানক জন্মজয়ন্তীতে দেশবাসীর উদ্দেশে ভাষণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী কেন্দ্রের তিন বিতর্কিত কৃষি আইন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। গত প্রায় এক বছর ধরে কেন্দ্রের তিন বিতর্কিত কৃষি আইনের প্রতিবাদে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন কৃষকরা। আর এবার প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্তে আদতে তাদেরই জয় হল।
আইন প্রত্যাহারের পরই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কৃষকদের উদ্দেশে অনুরোধ করেছেন, দ্রুত বাড়ি ফিরুন ও তাড়াতাড়ি কৃষিক্ষেত্রে ফিরুন। আসুন সব নতুন করে শুরু করা যাক। একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী আক্ষেপের সঙ্গে বলেছেন, কৃষকদের স্বার্থে, সৎ উদ্দেশ্যে কেন্দ্র এই তিন কৃষি আইন এনেছিল; কিন্তু, বহুবার চেষ্টা করা সত্ত্বেও কৃষকদের তা বোঝানো যায় নি। এই জন্য দেশবাসীর কাছে তিনি ক্ষমাপ্রার্থী। তাই কেন্দ্রীয় সরকার তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে তিনটি কৃষি বিলে সংশোধন করে আইনে পরিণত হওয়ার পর থেকেই দিল্লি, পঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থানে এর বিরুদ্ধে তুমুল প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, নতুন আইনের ফলে লোকসানের মুখে পড়বেন কৃষকেরা, এমএসপি পাওয়া থেকেও বঞ্চিত হবেন তারা।
READ MORE
নতুন এসবিএস রেডিও অ্যাপ ডাউনলোড করুন
২০২০ সালে তিনটি কৃষি আইন প্রণয়ন করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সরকার। এই তিনটি কৃষি আইন যথাক্রমে,
১. কৃষকদের উৎপাদিত কৃষিপণ্যে ব্যবসা ও বাণিজ্য সংক্রান্ত আইন
২. অত্যাবশ্যক পণ্য আইন এবং
৩. কৃষি পণ্যের মূল্য নির্ধারণ এবং কৃষি পরিষেবা সংক্রান্ত কৃষক চুক্তি আইন।
এই তিন কৃষি আইন প্রণয়ণের পরই সেগুলির বিরোধিতা করে তীব্র প্রতিবাদ জানান ভারতের কৃষকেরা।কৃষকদের যুক্তি ছিল, প্রধানমন্ত্রী যদিও বলছেন এই কৃষি আইন কৃষকদের হাত শক্ত করবে; কিন্তু, আদতে দেশের কৃষকদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেবে এই আইন। বিশেষ করে প্রান্তিক এবং ছোট কৃষকেরা মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে আরও বেশি করে শোষিত হবেন। কৃষকদের ওই দাবি সমর্থন করেন বিরোধীরাও। শুরু হয় আন্দোলন।
People celebrate in Kolkata, India on Nov. 19, 2021 after Indian PM Narendra Modi announced the repeal of three controversial farm laws after a year of protests Source: Rahul Sadhukhan/Pacific Press/Sipa USA
এদিকে কৃষকদের লাগাতার আন্দোলন ও সত্যাগ্রহের জন্যই মাথা নোয়াতে হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারকে। তিন বিতর্কিত কৃষি আইন বাতিলের পর কেন্দ্রের বিরুদ্ধে এভাবেই সরব হয়েছেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। টুইটার হ্যান্ডলে তিনি লিখেছেন, দেশের অন্নদাতাদের সত্যাগ্রহ অহঙ্কারের মাথা নত করেছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে জয়কে অভিনন্দন। জয় হিন্দ। জয় হিন্দের ভারতের কৃষক। একইসঙ্গে তিঁনি, পুরোনো একটি টুইট শেয়ার করেছেন। সেখানে লেখা ছিল,তার কথাগুলো চিহ্নিত করে রাখুন। সরকারকে বিরোধীদের ফিরিয়ে নিতে হবে। কংগ্রেসেরের তরফে বলা হয়েছে উত্তরপ্রদেশ, পঞ্জাব-সহ পাঁচ রাজ্যের আসন্ন বিধানসভা ভোট নজরে রেখেই কেন্দ্র তিন কৃষি আইন নিয়ে পিছু হঠেছে। আর কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে দিল্লির উপকণ্ঠে অবস্থানকারী কৃষকদের বড় অংশই পঞ্জাব এবং পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের।
কংগ্রেস নেতা তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পি চিদম্বরম বলেছেন, ভোটে হারার ভয়েই এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করল কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। অন্যদিকে,পঞ্জাব প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির দাবি, কৃষকদের ধারাবাহিক আন্দোলন এবং কংগ্রেসের রাজনৈতিক প্রতিরোধের মুখেই কৃষি আইন বাতিল করছে কেন্দ্র। তবে, এর ফলে পঞ্জাবের বিধানসভা ভোটে বিজেপি-র কোনও লাভ হবে না। প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে সংসদে তিন কৃষি আইন বিল পাশের পরেই পঞ্জাবে গিয়ে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন রাহুল গান্ধী। আশ্বাস দিয়েছিলেন, কংগ্রেস কেন্দ্রে ক্ষমতায় এলে মোদী সরকারের কৃষি সংক্রান্ত তিনটি কালা কানুন বাতিল করবে।
অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রী কৃষি আইন প্রত্যাহারের কথা জানালেও সংসদে বাতিল না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে বলে জানিয়েছেন ভারতীয় কিষাণ ইউনিয়নের নেতা রাকেশ টিকায়েত। তাছাড়া, ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিয়ে সমাধান প্রয়োজন বলেও জানিয়েছেন তিনি।টিকায়েত বলেছেন, যতদিন না সংসদে এই তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত পাশ হচ্ছে ততদিন অবস্থান জারি থাকবে। খুঁটি তখনই উঠবে যেদিন কাজ পাকা হবে।
২০২০-এর সেপ্টেম্বরে পাশ হয় তিন কৃষি আইন। তারপর থেকেই এই আইনের বিরোধিতায় পাঞ্জাব, হরিয়ানা-সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আন্দোলন শুরু হয়। নভেম্বরে কৃষকরা দিল্লিতে গিয়ে ধরনাও দিয়েছেন। সেই থেকেই আন্দোলন চলছিল। প্রধানমন্ত্রীর কৃষি আইন প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা হতেই বিকেইউ-এর নেতা রাকেশ টিকায়েত বলেছেন, ৬০০ কৃষকের আত্মবলিদানকে বিফলে যেতে দেওয়া হবে না। অন্যদিকে বাম কৃষক নেতা হান্নান মোল্লা জানিয়েছেন, গণ-আন্দোলনেরই জয় হয়েছে। তবে সংসদে আইন বাতিল না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
আর, কৃষি আইন প্রত্যাহারের ঘোষণার পরই, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিক্রিয়ার বর্ষণ শুরু হয়। অভিনেতা কঙ্গনা রানাওয়াতও তার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে। সরকারের সিদ্ধান্তে হতাশা প্রকাশ করে ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে তিনি লিখেছেন, দুঃখজনক, লজ্জার এবং অন্যায়। সংসদে নির্বাচিত সরকার থাকা সত্ত্বেও যদি রাস্তার মানুষ আইন প্রণয়ন শুরু করে, তাহলেও এটা একটা জিহাদী জাতি। অভিনন্দন সকলকে যারা এটা চেয়েছেন। উল্লেখ্য, কঙ্গনা রানাওয়াত প্রথম থেকেই কেন্দ্রীয় সরকারের তিন কৃষি আইন প্রণয়নের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছিলেন। প্রায়শই প্রতিবাদী কৃষকদের সমর্থনে বিতর্কের অন্য দিকে থাকা দিলজিৎ দোসাঞ্জের মতো অন্যান্য তারকাদের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়েছেন। এমনকী কৃষকদের সমর্থন করার জন্য তিনি রিহানার বিপক্ষেও টুইট করেছিলেন।
ভারতের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর খবর শুনতে উপরের অডিও-প্লেয়ারটিতে ক্লিক করুন।