অস্ট্রেলিয়া নিবাসী নৃত্যশিল্পী অর্পিতা সোম চৌধুরী ধ্রুপদী নাচের জগতে সুপরিচিত একটি নাম। প্রবাসে নৃত্যশিল্পের চর্চা নিয়ে তিনি সম্প্রতি আলাপ করেছেন এসবিএস বাংলার সাথে। এসবিএস এর কর্মী পাইচিংমং মারমার সাথে সিডনী থেকে ফোনে আলাপচারিতায় যোগ দিয়েছিলেন অর্পিতা সোম চৌধুরী।
পাইচিং: আলাপচারিতার শুরুতে একজন অর্পিতা সোম চৌধুরীর নৃত্যশিল্পী হয়ে উঠার গল্পটা শুনতে চাইবো। আমাদের পাঠক শ্রোতাদের জানাবেন কি, কিভাবে আপনার নৃত্যের জগতে আসা হল?
অর্পিতা: নৃত্যশিল্পী অর্পিতা সোম চৌধুরী হয়ে উঠার পেছনে যার সবথেকে বেশি অবদান সে হলো আমার মা।
আমার যখন চার অথবা পাঁচ বছর বয়স তখন থেকে মা ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন আমার "হোম ডিসট্রিক্ট" রাজবাড়ী শিল্পকলা একাডেমিতে।
তারপর টুয়েলভ ক্লাসের পরে ইন্ডিয়ান গভমেন্ট এর স্কলারশিপ পেয়ে আমি কলকাতার রবীন্দ্র ভারতী ইউনিভার্সিটি তে নাচের উপরে পড়াশোনা করতে যাই। সেখান থেকে আমি নাচের উপর অনার্স, মাস্টার্স ডিগ্রী লাভ করি। আর এভাবেই নাচের জগতের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যাই।
READ MORE
নতুন এসবিএস রেডিও অ্যাপ ডাউনলোড করুন
পাইচিং: বাংলাদেশে নৃত্যচর্চায় কিভাবে জড়িত ছিলেন? কিভাবে প্রবাসে নৃত্যচর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন?
অর্পিতা: পড়াশোনা শেষ করে যখন দেশে ফেরত গেলাম প্রথমে আমি বাংলাদেশের স্বনামধন্য নৃত্যশল্পী লুবনা মরিয়ম এর নাচের প্রতিষ্ঠান সাধনা এবং কল্পতরু তে নাচের শিক্ষক হিসেবে যুক্ত হই। এর পর এক এক করে যুক্ত হয়েছি ছায়ানট সংগীত বিদ্যায়তনে, শান্তমরিয়াম ইউনিভার্সিটিতে নাচের প্রভাষক হিসেবে। সৌভাগ্যক্রমে ঢাকায় ইউনিভার্সিটি নাট্যকলা ডিপার্টমেন্টের গেষ্ট টিচার হিসাবেও কিছুদিন কাজ করবার সুযোগ হয়েছিল।
বাংলাদেশে নিজের নাচের একটি দলও তৈরি করেছিলাম আর সেই দলকে নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ও দেশের বাইরে কাজ করা হয়েছে অনেক। যখন বিবাহসূত্রে সিডনিতে চলে আসা হলো তখন এখানেও নাচ নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। এখানেও নাচের দল এবং ক্লাস পরিচালনা করছি, নাচের ক্লাসে আমি শাস্ত্রীয় নৃত্য ভারতনাট্যম নাচের পাশাপাশি আমাদের দেশীও নাচের তালিম দিচ্ছি, নাচের ওয়ার্কশপও করাচ্ছি।
এছাড়া সিডনি ও সিডনি এর বাইরে নাচের অনুষ্ঠানে নিজের দলকে নিয়ে অংশগ্রহণ করছি। শুধু নিজের কমিউনিটির প্রোগ্রাম নয় অন্যান্য কমিউনিটি প্রোগ্রামেও অংশগ্রহণ করছি।
পাইচিং: প্রবাসে প্রাচ্য সংস্কৃতি চর্চা তথা নৃত্য শিল্পের চর্চার অভিজ্ঞতা কেমন?
অর্পিতা: আমরা যখন নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে এসে নিজের সংস্কৃতিকে তুলে ধরবার চেষ্টা করি, তখন যেসব সাধারণ প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন আমাদের হতে হয় সেটা হলো ভাষা, সময়, আর সুযোগ। এইসব প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও নিজের প্যাশনের জায়গা থেকে নৃত্যচর্চা করা বেশ চ্যালেঞ্জিং মনে হয়।
আমরা সবাই জানি আমাদের প্রাচ্য সংস্কৃতি কতটা সমৃদ্ধ আর কতোটা আলাদা পশ্চিমা সংস্কৃতি থেকে, আমি যখন অন্য কমিউনিটি গুলোতে প্রোগ্রাম করে থাকি তখন আমি আমার নিজের দেশের সংস্কৃতি তুলে ধরি আমার নাচ, মিউজিক, পোশাক এবং সাজ-সজ্জার এর মধ্যে দিয়ে।
নৃত্যের মধ্যে দিয়ে এই যে আমার সংস্কৃতিকে তুলে ধরার প্রয়াস, তার গ্রহণযোগ্যতা আর প্রশংসা পেলে আমার সব প্রচেষ্টা সার্থক মনে হয়। একটা বিজয়ের আনন্দ আর গৌরবের অনুভূতি হয়।
যারা আমার কাছে নাচের প্রশিক্ষণ নিচ্ছে তাদের ক্ষেত্রে নাচের গানের ভাষাটা বোঝার অনেকটা চ্যালেঞ্জিং বিষয় হয়ে দাঁড়ায় কারণ এরা এখানে পশ্চিমা সংস্কৃতির সাথে তাল মিলিয়ে বেড়ে উঠছে কিন্তু আমি তাদেরকে সেটা যখন ট্রান্সলেট করে দেই, তখন কিন্তু তারা সেটা পুরোপুরি বুঝে নিয়ে সেই গানের নাচটি শিখতে ভীষণভাবে আগ্রহ প্রকাশ করে।
এটাও আমার কাছে অনেক আনন্দের বিষয়। একটু সময়, পরিশ্রম বেশি লাগলেও আমি যা কিছু আমার নাচ শেখানোর মধ্য দিয়ে শেখাতে চাইছি তারা সেটা নিতে সক্ষম হচ্ছে। নাচের মধ্যে দিয়ে এভাবে সংস্কৃতির বিনিময় ও পরম্পরা, আর শিক্ষা ছড়িয়ে দেওয়াতে বিমল আনন্দ অনুভব করি।
পাইচিং : নৃত্যশিল্পী হিসাবে আপনার শিল্পভাবনা নিয়ে কিছু বলবেন কি?
অর্পিতা: শিল্প ভাবনা বলতে সবসময় আমার মধ্যে যে ভাবনাটা এখানে আসবার পর থেকে কাজ করে সেটা হচ্ছে আমার নাচের মধ্য দিয়ে আমার দেশের সংস্কৃতিকে সবার সামনে তুলে ধরবার কথা, সংস্কৃতিকে উপস্থাপন এবং তার বিনিময়।পাইচিং : নৃত্যাংগনের কোন কোন শিল্পীরা আপনাকে অনুপ্রাণিত করে বা প্রভাবিত করেছে? কাদের কাজ আপনার ভাল লাগে?
Source: Arpita Shome Chaudhury
অর্পিতা: নাচ নিয়ে অনুপ্রাণিত হয়েছি প্রথমত আমি আমার পরিবার থেকে। আমার ছোট বেলায় বিটিভিতে রুমঝুম নামে একটি নাচের অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন বাংলাদেশের স্বনামধন্য নৃত্যশিল্পী লায়লা হাসান। এই অনুষ্ঠনটিও আমাকে ও আমার পরিবারকে অনুপ্রাণিত করেছে আমাকে নাচ শিখতে। পরবর্তীতে যাদের কাজ ভাল লাগে তাদের মধ্যে রয়েছে শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়,ওয়ার্দা রিহাব,অমিত চৌধুরী, শামীমা হোসেন প্রেমা এবং আরো অনেকে। বর্তমান সময়ে অনেক নতুন নৃত্য শিল্পীদের কাজও আমার ভালো লাগে।
পাইচিং: আপনার সাম্প্রতিক কাজ নিয়ে আমাদের কিছু জানাবেন কি?
অর্পিতা: গত মাসে এখানকার স্বনামধন্য সরোদ বাদক তানিম হায়াত ভাই এর সঙ্গে যৌথভাবে আমার একটি নাচের মিউজিক ভিডিও বেরিয়েছে মাইনর শিরোনামে। মিউজিক ভিডিওটির কারিগরি সহায়তাই পুরো পরিবেশনা টি সবার কাছে অনেক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।
তানিম হায়াৎ খান রজিত এবং অর্পিতা সোম চৌধুরীর সাম্প্রতিক পরিবেশনা: "দ্য হারমোনিক মাইনর’
পাইচিং: নৃত্যশিল্প চর্চা নিয়ে ভবিষ্যত আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
অর্পিতা: আমার নাচের স্কুলটাকে আরো বড় পরিসরে পরিচালনা করা, নাচের নৃত্যনাট্য পরিবেশনা, ভারতের আর বাংলাদেশের যারা ভালো ভালো কাজ করছে নাচের উপরে তাদেরকে এখানে আমন্ত্রিত করে ওয়ার্কশপ করানো এবং নাচের অনুষ্ঠান আয়োজন করা।
অর্পিতা সোম চৌধুরীর সাক্ষাৎকারটি শুনতে উপরের অডিও-প্লেয়ারটিতে ক্লিক করুন।