ছিয়ানব্বই সালে অস্ট্রেলিয়া আসার পর গবেষক হিসেবে সরকারি চাকরি করতেন নজরুল। চুক্তিভিত্তিক চাকরি পুনরায় নবায়ন হবে কিনা তা নিয়ে সংশয়ে থাকতেন সবসময়।
"প্রতি বছর চাকরি নবায়নের সময় হলেই অফিস থেকে জানাত বাজেট সংকটের কথা। ফলে অনিশ্চয়তা আর মানসিক চাপে ভুগতাম সবসময়। অনিশ্চিত জীবন থেকে পরিত্রাণ পেতে একদিন ঠিক করলাম ব্যবসা করব," বলেছেন নজরুল ইসলাম, যিনি বর্তমানে ড্রাইভিং প্রশিক্ষক হিসেবে নিজ ব্যবসা পরিচালনা করছেন।
এ চিন্তা থেকেই ২০০৬ সালে চালু করেন ড্রাইভিং স্কুল। পুরো মেলবোর্নে নজরুলই ছিলেন প্রথম বাংলাদেশী যিনি এ ব্যবসায় আসেন।
"সিদ্ধান্তটা খুব সহজ ছিল না। সপ্তাহ শেষে চাকরি থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আসত, অথচ ব্যবসায় তার কোন গ্যারান্টি নাই। পরিবার কোনভাবেই মেনে নিতে পারছিল না, বিশেষ করে সামাজিক অবস্থানের কথা চিন্তা করে।"নিজ বাসায় ফ্যাশন হাউজ খুলে ব্যবসা করছেন মেলবোর্নের সামস নূর। এ বছর সরকারকে কর দিয়েছেন প্রায় ১৫ হাজার অস্ট্রেলিয়ান ডলার। অথচ ২০১২ সালে মাত্র ১০ হাজার ডলার দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন তিনি।
ড্রাইভিং শিক্ষার্থীর সাথে প্রশিক্ষক নজরুল ইসলাম। Source: Supplied
"শুরু থেকেই পেয়েছি স্বামীসহ নিজ এবং শ্বশুর বাড়ির পুরো সমর্থন। ব্যবসার ব্যস্ত সময়ে শারীরিক পরিশ্রম দিয়েও সহায়তা করেন সবাই," বলেছেন সামস।
মেলবোর্ন ভিত্তিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হলেও, সামস নূরের ক্রেতাদের বড় একটা অংশ থাকেন সিডনি শহরে। আর তাই অনলাইন ব্যবসায় বেশ সরব সামস। প্রতি বছর সিডনিতে অনুষ্ঠিত ঈদ মেলায় অংশ নেন তিনি।
"এ ব্যবসায় পূর্ণ সময় দিতে হয়। খন্ডকালীন সময় দিয়ে এ ব্যবসা করা যাবে না। যেমন, রাত ১২টার পরও আমি জেগে থাকি। কারণ অ্যামেরিকা থেকে অনলাইন অর্ডার আসে মধ্যরাতে।"
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে কমিউনিটির দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সামস বলেন, "এখন পর্যন্ত আমি পজেটিভ ফিডব্যাকই পেয়েছি। তবে শুনেছি যে, অনেকের ক্ষেত্রেই নেগেটিভ কিছু হয়েছে।"ক্ষুদ্র ব্যবসায় নিজেদের সফল বললেন নজরুল এবং সামস দু'জনই। চাকরি ছেড়ে দিয়ে ভুল করেননি, এমনটাই দাবি নজরুলের। চাকরিজীবী স্বামীর সাপ্তাহিক আয়ের সমান আয় সামসের।
মেলায় ক্রেতাদের সাথে সামস নূর। Source: Supplied
তবে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী বাংলাদেশী কমিউনিটির দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানসিকতা পরিবর্তনের আহ্বান জানালেন নজরুল ইসলাম।
"এটা খুবই দু:খজনক ব্যাপার যে, অস্ট্রেলিয়ায় থেকেও কাজ দিয়ে আমরা মানুষের শ্রেণীবিন্যাস করি। ভুলে গেলে চলবে না যে, আজকের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীই আগামীর বড় উদ্যোক্তা।"
নজরুল ইসলামের কৃতি শিক্ষার্থী। Source: Supplied
গেলো দু'বছর ধরে সবজি ব্যবসা করার জন্য মেলবোর্নের শপিং সেন্টারগুলোতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন প্রবাসী বাংলাদেশী মোহাম্মদ আসিফ। কিন্তু এ ব্যবসায় পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় তার আবেদনে এখনও সাড়া দেয়নি কেউ।
"ব্যবসার শুরুতেই শপিং সেন্টারগুলো কিছু প্রণোদনা দেয়। যাতে ব্যবসায়ীরা আর্থিক ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতে পারেন। আর তাই, কর্তৃপক্ষ অনভিজ্ঞ কাউকে ব্যবসার অনুমতি দিতে চায় না," বলেছেন আসিফ।
"এ সমস্যা উত্তরণে বর্তমানে আমি সবজি ব্যবসার অভিজ্ঞতা নিচ্ছি। অংশীদার হিসেবে নিয়েছি এ ব্যবসায় দীর্ঘকালীন অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ব্যক্তিকে। বাড়িয়েছি ব্যাংক লেনদেনের রেকর্ড।"শুরুতে পেশা এবং পরবর্তীতে ব্যবসা হিসেবে একাউন্টিং কোম্পানি চালিয়ে আসছেন চঞ্চল মন্ডল। এসবিএস বাংলার সাথে ফোনালাপে চঞ্চল জানান, "১৫ বছর আগে যখন এ পেশায় আসি তখন মেলবোর্নে খুব কম প্রবাসী বাংলাদেশীই ছিলেন ব্যবসায়ী। সবাই চাকরি করতে চাইত। আর এখন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর পরিমাণ উৎসাহব্যঞ্জক।"
Shoppers are seen at a produce market in Brisbane, Wednesday, July 17, 2013. (AAP Image/Dave Hunt) NO ARCHIVING Source: (AAP Image/Dave Hunt)
ক্ষুদ্র ব্যবসায় সফল হতে হলে, সঠিক গবেষণা করে ব্যবসা নির্ধারণ, সুনির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন এবং পেশাদার পরামর্শকের দিকনির্দেশনা নেয়া উচিত বলে পরামর্শ দিয়েছেন চঞ্চল।
"বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা উচ্চাভিলাষী, এটা ভালো গুণ। তারা কঠোর পরিশ্রমিও। অন্য আরো কমিউনিটি মানুষের চেয়ে সৎ। শুধু দরকার ব্যবসা শুরুর আগে সঠিক দিকনির্দেশনা, যেটা দিতে পারে একজন পেশাদার পরামর্শক।"
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে কমিউনিটির মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন বলে চঞ্চল মন্ডলও মত দিয়েছেন।
"অনেক ব্যবসায়ীই আছেন যারা তাদের ব্যবসার কথা বলতে লজ্জা পান! পাছে কমিউনিটি তাকে কিভাবে মূল্যায়ন করে। এটা খুবই দু:খজনক যে, উন্নত দেশে এসেও আমরা পরিশ্রমের স্বীকৃতি দিতে চাই না।"
"তবে কমিউনিটির পাশাপাশি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদেরও চিন্তায় পরিবর্তন আনতে হবে। তাদেরকেও ব্যবসার ব্যাপারে স্পষ্টবাদী হতে হবে। হউক তা ক্লিনিং ব্যবসা," বলেছেন একাউন্টেন্ট চঞ্চল মন্ডল। ক্ষুদ্র ব্যবসায় তরুণদের স্বাগত জানিয়েছেন নজরুল, সামস এবং চঞ্চল। সফলতার জন্য একাগ্রতা এবং কঠোর পরিশ্রমের ওপর জোড় দিলেন সবাই।
চঞ্চল মন্ডল। Source: Supplied
"অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশীদের বড় একটা মার্কেট আছে। সফলতার জন্য প্রয়োজন ধৈর্য্য এবং হতে হবে সৃজনশীল। খন্ডকালীন নয় দিতে হবে পূর্ণ সময়," বলেছেন ফ্যাশন হাউজের প্রতিষ্ঠাতা সামস নূর।
"যারা ব্যবসা করতে চান আমি অবশ্যই তাদেরকে উৎসাহ দিচ্ছি। কঠোর পরিশ্রম করেন সফলতা আসবেই। ড্রাইভিং ইন্ড্রাস্টিতেও আসতে পারেন, এই ব্যবসা সম্ভাবনাময়," বলেছেন ড্রাইভিং প্রশিক্ষক নজরুল ইসলাম।