২৬ জানুয়ারি, ২০২২ সন্ধ্যায় অসুস্থ হয়ে পড়েন বাংলা গানের প্রবাদ প্রতিম সঙ্গীতশিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। পর দিন তাঁকে গ্রিন করিডোর করে এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ফুসফুসে সংক্রমণ হয়েছিল তাঁর। ঘটনাচক্রে, তার দু’দিন আগেই কেন্দ্রীয় ভারতীয় সরকারের পদ্ম সম্মান প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এই সঙ্গীতশিল্পী।
READ MORE
নতুন এসবিএস রেডিও অ্যাপ ডাউনলোড করুন
শৌচাগারে পড়ে গিয়ে চোট পান এই শিল্পী। এর পর বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছিল শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যাও। তাঁর দু’টি ফুসফুসেই সংক্রমণ দেখা দেয়। চিকিৎসার পর তাঁর শারীরিক অবস্থা ক্রমশ স্থিতিশীল হচ্ছিল। কিন্তু মঙ্গলবার সন্ধ্যা নাগাদ হঠাৎ তাঁর শারীরিক জটিলতা বাড়ে।
প্রয়াত সঙ্গীতশিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে টুইটে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। লিখেছেন, ওঁর চলে যাওয়া দেশের সাংস্কৃতিক জগৎ আরও শূন্য করে দিল। টুইটারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী লিখেছেন,গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সুর এবং স্বর ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিমোহিত করবে। শিল্পীকে তাঁর জীবদ্দশায় পদ্মশ্রী দিতে চেয়েছিল মোদী সরকার। যা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। সন্ধ্যাকে এত দিনে, পদ্মশ্রী দেওয়ায় প্রস্তাবে ক্ষুব্ধ হয়েছিল বাংলার শিল্প জগৎ।
প্রবাদপ্রতিম সংগীতশিল্পী গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, উপমহাদেশে গানের মুগ্ধতা ছড়ানোর পাশাপাশি মহান মুক্তিযুদ্ধে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করেছেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।
একই সঙ্গে শাস্ত্রীয়সঙ্গীত, লঘু শাস্ত্রীয় সঙ্গীত, আধুনিক গান, নজরুলগীতি, রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং সেই সঙ্গে মুম্বইয়ে হিন্দি চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক, এত দীর্ঘ সময় ধরে বাংলার কোনও শিল্পীর সঞ্চারপথ এত ব্যাপক নয়। প্রত্যেক সঙ্গীতের গায়নশৈলী ভিন্ন, সন্ধ্যার বড় কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে প্রত্যেকটি শৈলীর গান আপন ভাব অক্ষুণ্ণ রেখে নিবেদন করা। যে কারণে, এ শুধু গানের দিন, আমি যে জলসাঘরে-র মতো ফিল্মের গান কিংবা, দিবস রজনী, আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি-র মতো রবীন্দ্রসঙ্গীত তাঁর কণ্ঠে সমান জনপ্রিয় হয়েছে। প্রকৃতার্থেই তিনি, গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।
READ MORE
চলে গেলেন লতা মঙ্গেশকর
গত শতাব্দীর পাঁচের দশকে মুক্তি পেয়েছিল একটি ছবি, অগ্নিপরীক্ষা; যে ছবিতে নায়ক-নায়িকার নাম উত্তম-সুচিত্রা। চিরকালীন এই জুটির এটাই প্রথম ছবি নয়। কিন্তু কার্যত এই ছবি থেকেই তাঁরা উত্তম-সুচিত্রা হয়ে ওঠেন। আর সেই ছবিতে সুচিত্রার নেপথ্য কণ্ঠে শোনা গিয়েছিল সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠস্বর। অনুরোধের আসরে ফিরে ফিরে বেজে চলতো, গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু, কে তুমি আমারে ডাকো’র মতো গান। ক্রমেই মহানায়িকা হয়ে উঠলেন সুচিত্রা। আর তাঁর কণ্ঠের নেপথ্যে ভেসে রইল সন্ধ্যার কণ্ঠস্বর। বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগের সূচনা থেকেই এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে গেলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণের খবর পেয়ে উত্তরবঙ্গ সফর মাঝপথে ছেড়েই কলকাতায় ফিরে আসছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কোচবিহারে ছিলেন তিনি। সেখানেই গীতশ্রীর মৃত্যুর খবর পৌঁছায় তাঁর কাছে। সেখান থেকে কলকাতায় কথা বলে নিজের সফরসূচিতে কাঁটছাট করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জানিয়ে দিয়েছেন, বুধবার সরকারি তত্ত্বাবধানেই হবে সন্ধ্যার শেষকৃত্য। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, রাজ্য সরকার সর্ব্বোচ্চ সম্মান দিয়ে সন্ধ্যার শেষকৃত্য করবে। বুধবার সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত তাঁর মরদেহ রাখা হয়েছে রবীন্দ্র সদনে। সেখানেই তাঁর গুণমুদ্ধেরা তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে পারবেন। তারপর বিকেলে দক্ষিণ কলকাতার ক্যাওড়াতলা মহাশ্মশানে রাজ্য সরকারের তত্ত্বাবধানে পূর্ণ মর্যাদায় তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, ১২ বছর বয়সে আকাশবাণী কলকাতার গল্পদাদুর আসর-এ প্রথম গেয়েছিলেন গীতিকার অজয় ভট্টাচার্যের লেখা একটি গান। রেডিয়োয় প্রথম পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন পাঁচ টাকা। ১৩ বছর ১০ মাস বয়সে প্রথম বেসিক রেকর্ড। এইচএমভি থেকে প্রকাশিত, গানের কথা ও সুর গিরিন চক্রবর্তীর। এক দিকে, তুমি ফিরায়ে দিয়ে যারে, উল্টো পিঠে, তোমারো আকাশে ঝিলমিল করে চাঁদের আলো।
বছর দু’য়েকের মধ্যে দু’টি বাংলা ছবিতে নেপথ্যে গাওয়ার সুযোগ। প্রথম ছবির সঙ্গীত পরিচালক কিংবদন্তি রাইচাঁদ বড়াল। ছবির নাম, অঞ্জনগড়। দ্বিতীয় ছবি, সমাপিকা-র সঙ্গীত পরিচালক রবীন চট্টোপাধ্যায়। সে বছর, অর্থাৎ চল্লিশের দশকের শেষের দিকে, তিনটি আধুনিক গানের রেকর্ড। চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি থেকে শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সাঙ্গীতিক উপস্থিতিই বলে দেয় যে তাঁর সফরটি দীর্ঘ হতে চলেছে।
READ MORE
সঙ্গীত শিল্পী সুবীর নন্দী আর নেই
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ৪ অক্টোবর ১৯৩১ সালে। দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়ায়। নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এবং হেমপ্রভা দেবীর কন্যা ছিলেন ছয় সন্তানের মধ্যে কনিষ্ঠ। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তাঁদের বংশের আদি পুরুষ রামগতি মুখোপাধ্যায় বড় সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। তাঁর পুত্র সারদাপ্রসাদও গান-বাজনার চর্চা করতেন। সারদাপ্রসাদের ছেলে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ঠাকুরদা। এঁরা প্রত্যেকেই উচ্চাঙ্গসঙ্গীত নিয়ে চর্চা করতেন। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের বাবা নরেন্দ্রনাথ ছিলেন কৃষ্ণভক্ত। বাবার কাছেই প্রথম গান শেখা।সন্ধ্যাকে ভক্তিমূলক গান শেখাতেন তিনি। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মা-ও গান গাইতেন। নিধুবাবুর টপ্পা ছিল প্রিয়। মায়ের গানে মুগ্ধ হতেন সন্ধ্যা। ১৯৪৩ সালের ৫ ডিসেম্বর। মাত্র ১২ বছর বয়সে অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্স আয়োজিত সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় ভজন বিভাগে প্রথম হয়েছিলেন সন্ধ্যা। সেই প্রতিযোগিতায় মীরা বন্দ্যোপাধ্যায়ও অংশ নেন।
১৭টি হিন্দি চলচ্চিত্রে নেপথ্য গায়িকা হিসেবে গান করেছেন সন্ধ্যা। তবে যে কোনও কারণেই হোক বলিউডে নিজের সাঙ্গীতিক জীবন দীর্ঘায়িত করেন নি। ব্যক্তিগত কারণে ১৯৫২ সালে তিনি কলকাতায় ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৬৬ সালে কবি, গীতিকার শ্যামল গুপ্তের সঙ্গে বিবাহ। তাঁর বহু গানের গীতিকার শ্যামল। শ্যামলের সঙ্গে বিবাহের পর তাঁর জীবন খানিক বদলে যায়। বাইরের জগতের অনেক কিছু যাতে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে স্পর্শ না করে, যাতে তিনি নিজের লক্ষ্যে স্থির থাকতে পারেন, সে চেষ্টা সর্বদা করে গিয়েছেন শ্যামল গুপ্ত। একের পর এক আধুনিক গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছে। সলিল চৌধুরী, নচিকেতা ঘোষ, রবীন চট্টোপাধ্যায় কিংবা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো সুরকারের সুরে একাধিক গান রেকর্ড করেছেন তিনি। সেই সঙ্গে চুটিয়ে ফিল্মে নেপথ্যে গান।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের শিল্পী জীবনের অন্যতম মাইলফলক, মহিষাসুরমর্দ্দিনী-তে অংশগ্রহণ। পঙ্কজকুমার মল্লিক, বাণীকুমার, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র আর একঝাঁক শিল্পীর সঙ্গে সন্ধ্যাও ছিলেন। সে সময় লাইভ অনুষ্ঠান হত। রাত ৩টের মধ্যেই গঙ্গাস্নান করে গরদের ধুতি-চাদর গায়ে ভাষ্য পাঠ করতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। মহিষাসুরমর্দ্দিনী-তে বিমানে বিমানে আলোকের গানে জাগিল ধ্বনি গানটি এখনও মুখোপাধ্যায়ের গলায় শোনা যায়।
বাংলা সঙ্গীতে নারী-কণ্ঠের আধুনিকতার মূর্ত প্রতীক সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। এত দিন যিনি ছিলেন সেই ইতিহাসের জীবন্ত দলিল হয়ে। দীর্ঘ দিনই জনসমক্ষে গান করতেন না। তথাপি ছিলেন সঙ্গীত জগতের যুগ পরিবর্তনের এক সত্যদ্রষ্টা শিল্পী হিসেবে। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণ সুতরাং আক্ষরিক অর্থেই যুগাবসান।
আরও দেখুন:
সুরকার-গায়ক বাপ্পী লাহিড়ী প্রয়াত