আবারো দিল্লির মসনদে অরবিন্দ কেজরিওয়াল। ৭০ আসনের বিধানসভায় ৬২টি আসনে জিতেছে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি। বাকি ৮টি আসন পেয়েছে বিজেপি। তবে ফলাফল ঘোষণার একেবারে শুরুতে এগিয়ে ছিল বিজেপি।
এর আগে অধিকাংশ বুথ ফেরত জরিপ অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি তথা আপের সহজ জয় দেখিয়েছিল এবারের নির্বাচনে। ছয়টিরও বেশি জরিপে সমষ্টিগত হিসেব পূর্বাভাস দিয়েছিল ৭০টি আসনের মধ্যে ৫৬টিতেই জয়ী হবে আপ। বিজেপি পাবে ১৪টি আসন। কোনও কোনও জরিপে কংগ্রেসের ১ থেকে ৩টি আসনে জয়ী হওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছিল। সব বুথ ফেরত সমীক্ষা ছাপিয়ে গেছে কেজরিওয়ালের জয়। প্রসঙ্গত, ৭০ আসনের দিল্লি বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার আসন সংখ্যা হলো ৩৬টি।
২০১৫ সালে ৭০টি আসনের মধ্যে ৬৭টিতেই জিতে বিরোধীদের ধুয়েমুছে একরকম সাফ করে দেয় অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি। কিন্তু ক’মাস আগে, ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের নিরিখে চিত্রটা একদম উলটো।৭০টি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে ৬৫টিতে এগিয়ে ছিল বিজেপি। পাঁচটিতে কংগ্রেস। আপ একটিতেও নয়। লোকসভার সাতটি আসনের সাতটিতেই জিতেছিল বিজেপি। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোট, যে ভোটে জিতে প্রথম বার প্রধানমন্ত্রী হন নরেন্দ্র মোদী, সেই ভোটেও বিজেপি দিল্লিতে সাতে সাত জিতেছিল। কিন্তু পরের বছরই বিধানসভা ভোটে আম আদমি পার্টি স্রোতে ভেসে গিয়েছিল বিজেপি।
দিল্লিতে ব্যাপক জয়ে তৃতীয়বার ক্ষমতায় আম আদমি পার্টি সুপ্রিমো অরবিন্দ কেজরিওয়াল, ভোটারদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন, এই জয় নতুন ঘরানার রাজনীতি তৈরি করেছে, কাজের রাজনীতি। একে ভারত মাতার জয় বলেও সম্মোধন করেছেন তিনি। প্রচারে গিয়ে হনুমান চালিশা পাঠ করেছিলেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী, তাতে বিজেপির অভিযোগ, ভোটে জিততে হিন্দুত্বকে উস্কে দিচ্ছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। হনুমানজীকেও জয়ের কৃতিত্ব দিয়েছেন আপ সুপ্রিমো। বলেছেন, মঙ্গলবার, হনুমানজীর দিন, দিল্লিকে আশির্বাদ দিয়েছেন হনুমানজী। হনুমানজীকে ধন্যবাদ। মঙ্গলবারই ছিল দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর স্ত্রী সুনীতা কেজরিওয়ালের জন্মদিনও।
এদিকে জয়ের খবর আসতেই, নীল-সাদা বেলুন নিয়ে উৎসাবে মাতেন আম আদমি পার্টি তথা আপের নেতা কর্মী সমর্থকরা এবং দিল্লিতে দলের সদর দফতরে হোলি শুরু হয়ে যায়। তাঁরা স্লোগান দেন, ভারত মাতা কি জয়, তবে সাধারণভাবে এই স্লোগান শোনা যায় না আপের সমাবেশে। কেজরিওয়াল বলেছেন, এই জয় তাঁর নয়। এটি দিল্লির জয়, সেই সমস্ত পরিবারের জয়, যারা তাঁকে তাদের সন্তান হিসেবে দেখেছেন। যে পরিবারগুলি ২৪ ঘণ্টা জল, বিদ্যুৎ এবং শিক্ষা পেয়েছেন। দিল্লির মানুষ নতুন ধারার রাজনীতি দিয়েছে, কাজের রাজনীতি।মঙ্গলবার বিকেলে পরাজয় স্বীকার করেছেন এবং দিল্লি নির্বাচনে জয়ের জন্য অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন দিল্লির বিজেপি সভাপতি মনোজ তিওয়ারি। হিন্দিতে ট্যুইটারে তিনি লিখেছেন, দিল্লির ভোটারদের ধন্যবাদ। কঠোর পরিশ্রমের জন্য দলের সকল কর্মীবৃন্দকে ধন্যবাদ।অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে অভিনন্দন। মনোজ তিওয়ারি আরও বলেছেন, আশা রাখেন মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করবে দিল্লি সরকার।
Delhi BJP North East MP and Delhi BJP Chief Manoj Tiwari after casting his vote during Delhi Assembly Election polling at Yamuna Vihar, on February 8, 2020. Source: AAP Image/Sonu Mehta/Hindustan Times/Sipa USA
প্রথম বার ৪৫ দিনের মাথায় মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে অরবিন্দ কেজরিওয়াল কার্যত বোকামিই করেছিলেন বলে অনেকেই কটাক্ষ করেছিলেন। কিন্তু সেটা যে লম্বা দৌঁড়ের প্রস্তুতি ছিল, তা বোঝা গিয়েছে গত পাঁচ বছরে কেজরিওয়ালের উন্নয়নের রাজনীতিতে। পাঁচ বছরে সাধারণ মানুষের জন্য অনেক উন্নয়নমুখী প্রকল্প তৈরি এবং তার বাস্তব রূপায়ণের উপরেই আস্থা রেখেছেন দিল্লিবাসী। ২০১৫ সালের নির্বাচনী ইস্তাহারে যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল, সেগুলির প্রায় সবকটি ধরে ধরে বাস্তবায়িত করে দেখানোর রাজনীতিতে কেজরিওয়ালের বিশ্বাসযোগ্যতা বেড়েছে।
দিল্লিবাসীর জন্য ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুতের বিল মওকুফ করেছে আপ সরকার। মহিলাদের জন্য সরকারি বাসে বিনামূল্যে সফর এবং তাঁদের নিরাপত্তায় বাসে মার্শাল নিয়োগ করা, বিনা পয়সায় প্রতিদিন ৭০০ লিটার পর্যন্ত জল দেওয়ার মতো প্রকল্প বাস্তবে করে দেখিয়েছে দিল্লির সরকার। নতুন অনেক স্কুল তৈরি হয়েছে, পুরনো স্কুলগুলির খোলনলচে বদলে আধুনিক রূপ দেওয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষের জন্য এই জনমুখী প্রকল্প হলেও এটাই ছিল কেজরিওয়ালের রাজনৈতিক চাল। ভোটেপ্রচারেও এই উন্নয়ন মডেলকেই হাতিয়ার করেছিলেন কেজরিওয়াল। বিজেপির ধর্মীয় মেরুকরণের উস্কানিতে পা না দিয়ে প্রচার করে গিয়েছেন শুধু নিজের সরকারের এই সব জনমুখী প্রকল্পের সাফল্য। শাহিন বাগের আঁচ কার্যত গায়ে মাখেন নি, জেএনইউ বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলার ঘটনায় কার্যত মুখ খোলেন নি। দিল্লিবাসীকে বোঝাতে পেরেছেন, জাত-পাত, ধর্মীয় বিভেদ নয়, উন্নয়নই তাঁর পাখির চোখ।এর জেরেই বারবার পিছিয়ে পড়েও শেষপর্যন্ত দিল্লির ওখলা আসন থেকে জয়ী হয়েছেন আম আদমি পার্টি প্রার্থী আমানতউল্লাহ খান।এই আসন থেকেই গতবার তিনি বিধায়ক নির্বাচিত হন। তিনি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বি বিজেপির ব্রাহ্মণ সিংকে প্রায় নব্বই হাজারেরও বেশি ভোটে পরাজিত করেছেন। উল্লেখ্য, ওখলা বিধানসভার মধ্যেই পড়ে শাহিনবাগ। নাগরিকত্ব আইন বিরোধী আন্দোলনে গত ২ মাসের বেশি সময় ধরে আন্দোলন চলছে দিল্লির এই জায়গায়। রাজনৈতিক মহলের ধারনা ছিল শাহিনবাগের আন্দোলন ওখালায় ভোটদাতাদের মধ্যে মেরুকরণ করতে সাহায্য করবে। ফলাফল প্রকাশের পর আমানতউল্লাহ খান বলেছেন, দিল্লির মানুষ আজ বিজেপি ও অমিত শাহকে বিদ্যুতের শক দিয়েছে। মানুষ কাজ দেখে ভোট দিয়েছে। ঘৃণার হার হয়েছে। তিনি নন, জয়ের রেকর্ড ভেঙেছেন ওখলার মানুষ।
AAP candidate Amanatullah Khan from Okhla constituency shows the victory sign along with his supporters as his party leads in Delhi Assembly election. Source: Burhaan Kinu/Hindustan Times via Getty Images
বস্তুত, দিল্লিতে হ্যাটট্রিকের পথ প্রশস্ত হতেই অভিনন্দনের বন্যায় ভাসছেন আম আদমি পার্টির প্রধান এবং মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। তাঁকে ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী বলেছেন, দিল্লিতে গণতন্ত্রের জয় হয়েছে। মানুষ বুঝিয়ে দিয়েছে, তারা বিভাজনের রাজনীতি চায় না।তারা চায় শান্তির রাজনীতি, উন্নয়নের রাজনীতি।আপের দিল্লি জয়কে এ ভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেছেন, সব সময় বিভাজনের রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছে বিজেপি। মিথ্যে গুজব ছড়িয়ে তারা হিংসার রাজনীতি করছে। এটা ভালো ভাবে নেয় নি মানুষ। সেই কারণেই মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ড ও দিল্লিতে একে একে হারের মুখ দেখেছে বিজেপি। লোকসভা ভোটে ক্ষমতায় এলেও তার পর থেকে যেখানেই ভোট হয়েছে, সেখানেই হেরেছে বিজেপি।