Source: BBC Bengali
গত ৬ এপ্রিল সকালে বাংলাদেশের ফেনীর সোনাগাজীতে নুসরাত জাহান রাফি নামের এক মাদ্রাসা ছাত্রীকে , পরীক্ষা দিতে গেলে মাদ্রাসায় একদল তরুণ-তরুণী তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। দগ্ধ নুসরাত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ এপ্রিল রাতে তার মৃত্যু হয় ।পাঁচ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে বুধবার মৃত্যু হয় অগ্নিদগ্ধ মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত এর । একই মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের মামলা তুলে নিতে রাজি না হওয়ায় নুসরাত এর গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় ।
নুসরাত হত্যা মামলা :
এ ঘটনায় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে প্রধান আসামি করে আটজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত পরিচয় আরও ৪/৫ জনকে আসামি করে নুসরাতের ভাই সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন।
আলোচিত এ মামলায় এ পর্যন্ত ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে স্থানীয় পুলিশ ও পিবিআই। এরা হলেন ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদ দৌলা, পৌর কাউন্সিলর ও পৌর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম, শিক্ষক আবছার উদ্দিন, সহপাঠী আরিফুল ইসলাম, নূর হোসেন, কেফায়াত উল্যাহ জনি, মোহাম্মদ আলা উদ্দিন, শাহিদুল ইসলাম, অধ্যক্ষের ভাগনি উম্মে সুলতানা পপি, জাবেদ হোসেন, যোবায়ের হোসেন, নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন, মো. শামীম, কামরুন নাহার মনি ও আব্দুর রহিম শরিফ। এদের মধ্যে মামলার এজহারভুক্ত আট জনের সাতজন রয়েছেন। গ্রেপ্তারদের মধ্যে আসামি নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম ও আব্দুর রহিম শরিফ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
নুসরাত হত্যার বিচারের দাবি :
নুসরাত হত্যার বিচারের দাবিতে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বিক্ষোভে করে মহিলা পরিষদ।এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা কর্মসূচিতে নেমেছিল শিক্ষার্থীসহ নানা সংগঠন; তাদের দাবি ছিল, খুনিদের দৃষ্টান্তমূক শাস্তি দিতে হবে। নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার প্রতিবাদ ও মাদ্রাসা অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার শাস্তির দাবিতে ঢাকায় মানববন্ধন হয়েছে। দেশের অন্যতম শীর্ষ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করা হয় সেখানে পোড়ানো হয় মাদ্রাসা অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার কুশপুতুল। অন্যদিকে দেশের হাই কোর্ট হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে , নুসরাত হত্যা মামলার তদন্তে চোখ রাখবেন তারা। কোনো গাফিলতি দেখলেই হস্তক্ষেপ করবে উচ্চ আদালত।
নুসরাতের এই মৃত্যুর জন্য দায়ীদের শাস্তির অঙ্গীকার করেছেন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।ইতোমধ্যে তিনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে নুসরাতের হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। নুসরাতকে বাঁচাতে সিঙ্গাপুরে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা । কিন্তু তাকে স্থানান্তরের মতো পরিস্থিতি নেই বলে চিকিৎসকরা জানানোর পর দেশেইনুসরাতের চিকিৎসা করা হচ্ছিলো ।কিভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার হতেন খাতার পাতায় লিখে গেছেন নুসরাত:
Source: Getty Images
অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলার কাছে কীভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার হতেন নুসরাত তা নিজের খাতার পাতায় লিখে গেছেন ।
ওই অধ্যক্ষর বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের মামলা করার পর আগুনে জ্বলতে হয়েছে নুসরাতকে। পাঁচ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে শেষ নিঃশাস ত্যাগ করেন। নুসরাত মারা যাওয়ার আগেই ফেনীতে তার বাড়িতে ওই খাতাটি পায় পুলিশ।নুসরাত তার খাতার দুই পৃষ্ঠায় সহপাঠীদের উদ্দেশে অনেক কিছু লিখে গেছেন । অধ্যক্ষের মুক্তির পক্ষে তার যেসব সহপাঠি দাঁড়িয়েছিলেন, তাদের সমালোচনা করেছেন ওই লেখায়।
সহপাঠীদের উদ্দেশে নুসরাত তার খাতায় লিখেছিলো , “তোরা সিরাজুদ্দৌলা সম্পর্কে সব জানার পরও কিভাবে তার মুক্তি চাইতেছিস, তোরা জানিস না ঐদিন ক্লাসে কি হইছে, উনি আমার কোন জায়গায় হাত দিয়েছে এবং আর কোন জায়গায় হাত দেওয়ার চেষ্টা করছে। “উনি আমাকে বলছে, নুসরাত ঢং করিও না। তুই প্রেম করিস না, ছেলেদের সাথে প্রেম করতে ভাল লাগে? ওরা তোরে কি দিতে পারবে, আমি তোকে পরীক্ষার সময় প্রশ্ন দেব।” নুসরাতের হাতে লেখা দুই পৃষ্ঠার মধ্যে কিছু অংশে এরকম লেখা ছিল । দুই পৃষ্ঠায় গত ২৬ মার্চ ঘটে যাওয়া ঘটনার অনেক কিছু লিখেছেন নুসরাত।
নুসরাত হত্যাচেষ্টা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা, সোনাগাজী মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কামাল হোসেন বলেন, নুসরাতের খাতাটি মঙ্গলবার বিকালে তার বাড়ি থেকে উদ্ধার করেছেন তারা। তিনি বলেন, নুসরাতের ঘরে পড়ার টেবিলের বই-খাতা নাড়াচাড়া করতে গিয়ে একটি খাতার পৃষ্ঠা উল্টালে ওই লেখা দেখতে পান তিনি।
তাৎক্ষণিকভাবে তদন্ত কর্মকর্তা কামাল খাতাটি জব্দ করেন।এর পর তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, “নুসরাতের মামলায় এটি একটি ডকুমেন্ট হিসেবে কাজে লাগবে। পুলিশ এই লিখাগুলোর সত্যতা যাচাইয়ে যা যা করণীয় তা করবে। যাদের নাম আছে, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করবে।”খাতার লেখায় দিন-তারিখ উল্লেখ না থাকলেও বিষয়বস্তু বিবেচনায় এটি কয়েকদিন আগের বলে মনে করছেন তদন্ত কর্মকর্তা। হাসপাতালে নুসরাতের নিজের দেওয়া বক্তব্যের সঙ্গে ওই খাতার লেখার মিল রয়েছে। এটি অপরাধদের সনাক্ত ও অপরাধ প্রমাণে গুরুত্ব পাবে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত দল :
বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের অভিযোগ ও তদন্ত বিভাগের পরিচালক ফয়েজুল কবির বলেন, “বেশ কয়েকজন ছাত্রী, অভিভাবক, শিক্ষক, পুলিশসহ অনেকের সাক্ষ্য নিয়েছে তাদের তদন্ত দল।তিনি আরো বলেন “তদন্ত সাপেক্ষে আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে ২৭ মার্চের ঘটনার সঙ্গে ৬ এপ্রিল নুসরাতের গায়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার যোগসূত্র রয়েছে।” ফয়জুল কবিরের নেতৃত্বে তদন্ত দলের ২০ সদস্য সোনাগাজী মাদ্রাসায় যান। পরে তারা নুসরাতে বাড়ি সোনাগাজী উপজেলার উত্তর চরচান্দিয়া গ্রামে যান। সেখানে তারা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেন।
নুসরাত বলে গিয়েছিলেন, কোনো চাপেই সে নতি ষ্বীকার করবে না :
নুসরাতের দেহের ৮০ শতাংশে আগুনে পুড়ে গিয়েছিলো সে অবস্থায় নুসরাত বলে গিয়েছিলেন, কোনো চাপেই সে নতি ষ্বীকার করবে না। অবমাননার বিচারের দাবি করে যাবেন আমরণ । নুসরাত সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসা থেকে আলিম পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছিলেন।ওই মাদ্রসার অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ এনে গত মার্চে সোনাগাজী থানায় একটি মামলা করে নুসরাতের পরিবার।অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধেই শ্লীলতাহানির মামলার পর সেই মামলা তুলে না নেওয়ায় অধ্যক্ষের অনুসারীরা গত শনিবার মাদ্রাসার ছাদে ডেকে নিয়ে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় বলে নুসরাত নিজেই বলে গেছেন। ১১ এপ্রিল সন্ধ্যায় নিজ গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে দাফনের আগে তার জানাজায় ছিল মানুষের ঢল।নুসরাতের বাবা মাওলানা এ কে এম মুসা নিজেই নুসরাতের জানাজায় ইমামতি করেন।
Source: Bdnews24
১২ জন ছিল নুসরাত হত্যার পরিকল্পনায় :
ফেনীর সোনাগাজীতে আগুনে পুড়িয়ে মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির হত্যার ঘটনায় সরাসরি জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন মো. আবদুর রহিম । এ নিয়ে মোট তিনজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলেন।ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম শরাফ উদ্দিন আহমেদের আদালতে দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে আবদুর রহিম । ঢাকার কামরাঙ্গীর চর এলাকা থেকে আবদুর রহিমকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায় , আবদুর রহিম স্বীকারোক্তিতে বলেন, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার নির্দেশে নুসরাতকে হত্যার জন্য গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগানো হয়। এ জন্য ২৮ ও ৩০ মার্চ দুই দফা কারাগারে থাকা মাদ্রাসার অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করা হয়। ৪ এপ্রিল সকালে ‘অধ্যক্ষ সাহেব মুক্তি পরিষদের’ সভা করা হয়। রাতে ১২ জনের এক সভায় হত্যার পরিকল্পনা চূড়ান্ত ও দায়িত্ব বণ্টন করা হয়। তাঁর (রহিম) দায়িত্ব পড়ে মাদ্রাসার গেটে। সেখানে নুর উদ্দিন, আবদুল কাদেরও ছিলেন। মাদ্রাসার ছাদে বোরকা পরে ছিলেন শাহাদাত, জোবায়ের ও জাবের। এ ছাড়া ছাদে ছিলেন মণি ও পপি।
মামলার অপর দুই আসামি নুর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন ওরফে শামীম এবং মো. আবদুর রহিম তিনজনই স্বীকারোক্তিতে একই ধরনের কথা বলেছেন।
তদন্ত দলের ঘটনাস্থল পরিদর্শন
নুসরাত হত্যাকাণ্ড ও স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় পুলিশ সদর দপ্তর থেকে একটি তদন্ত দল বুধবার বিকেলে সোনাগাজী মাদ্রাসা ও নুসরাতদের বাড়ি পরিদর্শন করে। পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া বিভাগের ডিআইজি মো. রুহুল আমিন তদন্ত দলের নেতৃত্বে দেন।তদন্ত দলে আরো ছিলেন পুলিশ সুপার মো. মোস্তফা কামাল, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবু সুফিয়ান, মাহমুদা আক্তার, পরিদর্শক মো. সালা উদ্দিন। এ ছাড়া ফেনীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার উক্য সিং, সোনাগাজী সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (সার্কেল) সাইকুল আহমেদ ভূঁইয়া, সোনাগাজী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (চলতি দায়িত্বে) মো. কামাল হোসেন।পুলিশ মহাপরিদর্শকের নির্দেশে তদন্ত দল সোনাগাজীতে এসেই তদন্ত শুরু করে। দুই দিন সোনাগাজীতে থেকে নুসরাত হত্যাকাণ্ড ও পুলিশের দায়িত্ব পালনে কোনো অবহেলা ছিল কি না এবং এ ধরনের ঘটনা যাতে পুনরায় আর না ঘটে, সে বিষয়ে করণীয় নিয়ে তদন্ত করে ঢাকায় গিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে প্রতিবেদন দাখিল করবেন বলে জানান ডিআইজি মো. রুহুল আমিন।