করোনাভাইরাস নিয়ে আছে নানা গুজব এবং মিথ! জানতে হবে সত্যিটা কি

mashed garlic, coronavirus myth, home remedies

Is garlic a cure for COVID-19? - probably not Source: Pixabay

করোনাভাইরাস নিরাময় নিয়ে মিথ এবং মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের সর্বত্র, আর এতে সমাজ এবং ব্যক্তি পর্যায়ে স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরী হয়েছে। এইসব অসত্য তথ্যের বিস্তার রোধে যেসব মেডিকেল মিথ প্রচলিত এই প্রতিবেদনে তা খণ্ডন করা হয়েছে। এসবিএস এএনইউ-এর মেডিসিন এন্ড ইনফেকসাস ডিসিজের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর সঞ্জয় সেনানায়েকে'কে প্রশ্ন করেছে, করোনাভাইরাস নিয়ে যেসব মিথ কমিউনিটিতে ছড়িয়ে পড়েছে সে বিষয়ে বিজ্ঞান কি বলে। এ প্রতিবেদনটি শুনতে উপরের অডিও প্লেয়ারের লিংকটিতে ক্লিক করুন।


মিথ ১: স্বাস্থ্যবান তরুণদের ভাইরাস সংক্রমণ হলে কিছু হবে না, শুধুমাত্র বৃদ্ধ এবং যারা অন্যান্য স্বাস্থ্য জটিলতায় ভুগছেন তাদের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ।

প্রফেসর সেনানায়েকে বলেন:

"আমরা জানি যে কোভিড সংক্রমণের কারণে বৃদ্ধদের মধ্যে যারা বিশেষ করে ৬৫ বা ৭০ উর্দ্ধ ব্যক্তিরা স্বাস্থ্য জটিলতায় ভুগছেন, তারাই সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছেন। তবে, আমরা এটাও দেখেছি যে তরুণ এবং স্বাস্থ্যবান ব্যক্তিরাও কোভিড আক্রান্ত হয়ে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছে, কাউকে ইনটেনসিভ কেয়ারে নেয়া হয়েছে, এমনকি মৃত্যুও ঘটেছে। অতএব, তরুণ স্বাস্থ্যবান ব্যক্তিদের গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্ভাবনা কম থাকলেও, তারা যে ঝুঁকিমুক্ত তা বলা যাবে না। অনেক ব্যক্তিই কোভিড আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন যারা বেশ স্বাস্থ্যবান ছিলেন।”

মিথ ২: সূর্যের ইউভি বা আলট্রা ভায়োলেট রশ্মি করোনাভাইরাস মেরে ফেলতে পারে, তাই সানবাথ করলে ভাইরাস থেকে নিরাপদ থাকা যাবে।

প্রফেসর সেনানায়েকে বলেন:

"কিছু প্রমান আছে যে ইউভি লাইট ফ্লু’য়ের মত ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, তবে সেটার পক্ষে কোন শক্ত প্রমান নেই। দেখা গেছে যে, ইউভিসি নামক এক প্রকারের আলট্রা ভায়োলেট লাইট হয়তো করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে ভালো কাজ করতে পারে, তবে তাতে বিপদও আছে। একটি বিশেষ ধরণের আল্ট্রা ভায়োলেট রশ্মি আছে যা ফার-ইউভিসি বলে পরিচিত, সেটা নিয়ে পরীক্ষা চলছে। এটা মানব শরীরের জন্য হয়তো বিপদজনক নয়, কিন্তু ভাইরাস এবং ব্যাক্টেরিয়ার ক্ষেত্রে তা বিপদজনক। যদিও এখনো মানব শরীরে এর প্রভাব নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা হয়নি।"

মিথ ৩: রসুন খাওয়া, ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট সেবন, অথবা হারবাল এবং ঘরে বানানো টোটকা করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করতে পারে।

প্রফেসর সেনানায়েকে বলেন:

"এ বিষয়ে খুব বেশি বৈজ্ঞানিক প্রমান নেই। আপনি যদি রসুন বা এ ধরণের টোটকা ইত্যাদি সেবন করে ভালো বোধ করেন, তাতে সমস্যা নেই, কিন্তু এটা কোভিড রোধ করবে এমনটা ভাবার কারণ নেই। “

মিথ ৪: গরম পানি, এলকোহল অথবা লেবুর রস মিশ্রিত পানি পান করলে ভাইরাস থেকে গলাকে মুক্ত রাখা যায়।

প্রফেসর সেনানায়েকে বলেন:

"গরম পানি এবং লেবুর রস মিশ্রিত পানি আপনার গলার জন্য হয়তো ভালো হবে, কিন্তু এটি ভাইরাস মেরে ফেলতে পারবে না। এটার কোন এন্টি-ভাইরাল গুন্ নেই।"

মিথ ৫: ফুসফুসে সংক্রমণ করার আগে ভাইরাস কয়েকদিন গলায় থাকে, এবং গরম আবহাওয়ায় এটি ধ্বংস হয়, তাই ভাইরাসে সংক্রমিত হলে গরম পানি পান করে তা রোধ করা যায়।

প্রফেসর সেনানায়েকে বলেন:

"ভাইরাস সংক্রমণ গলা বা নাক থেকে শুরু হয় না, কিন্তু এর আগে যেমন গরম পানি পান করা সম্পর্কে বলা হয়েছে, এ ক্ষেত্রে এমন কোন প্রমান পাওয়া যায়নি যে মাউথওয়াশ বা গরম পানি ভাইরাস মেরে ফেলতে পারে।"

মিথ ৬: বারবার পানি পান করলে ভাইরাস পাকস্থলীতে ফ্লাশ হয়ে যায়, যেখানে পাকস্থলীর এসিড ভাইরাস মেরে ফেলতে পারে, এতে উইন্ডপাইপের মাধ্যমে ভাইরাস ফুসফুসে যেতে পারে না।

প্রফেসর সেনানায়েকে বলেন:

"এক্ষেত্রে এমন কোন প্রমান নেই। প্রচুর পানি পান করার বেশ কিছু স্বাস্থ্যগত উপকারিতা আছে, কিন্তু তাতে কোভিড ১৯ উপশম হয় না। অনেক কোভিড ১৯ রোগীর মলেও ভাইরাস পাওয়া গেছে, তাই পাকস্থলীর এসিড সবসময়েই ভাইরাস মেরে ফেলতে পারে না।"

মিথ ৭: হুইস্কির মত শক্তিশালী এলকোহলিক স্পিরিট সেবনে গলা পরিষ্কার হয় এবং তা ভাইরাস মেরে ফেলে।

প্রফেসর সেনানায়েকে বলেন:

"না, এমন কোন প্রমান নেই যে, উচ্চমাত্রার এলকোহলিক ড্রিংক ভাইরাস মেরে ফেলতে পারে, বরং এটা করতে গিয়ে শরীরের জন্য তা আরো খারাপ হবে। আমার মনে হয় এই গুজবটি ছড়িয়েছে এজন্য যে আলকোহলিক স্যানিটাইজার ব্যবহার করে হাতের ভাইরাস মেরে ফেলা যায়, কিন্তু তা হাতের জন্য, আপনার শরীরের ভেতরের জন্য নয় - দু'টো সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার।'

মিথ ৮: এন্টি-এইচআইভি ড্রাগ PrEP করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে আমাকে রক্ষা করতে পারে

প্রফেসর সেনানায়েকে বলেন:

"এই গুজবটি ছড়িয়েছে কারণ, লোপিনাভির-রিটনাভির নামের এইচআইভি ওষুধ দুটোর সংমিশ্রণ কোভিড ১৯-এর জন্য ব্যবহার হচ্ছে। তবে, একটি ট্রায়ালের ফলাফল নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিনে প্রকাশ পেয়েছিলো যা ছিল হতাশাব্যঞ্জক। আমাদের দেখতে হবে অন্যান্য গবেষণাগুলো কি বলে। যদিও এই এইচআইভি ওষুধগুলো কোভিড ১৯-এর জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে, তার মানে এই নয় অন্য সকল এইচআইভি ওষুধ কোভিড-এর বিরুদ্ধে কার্যকর।"

মিথ ৯: এন্টি-ম্যালারিয়াল ড্রাগ হাইড্রোক্সি ক্লোরোকুইন কোভিড ১৯ উপশম করে

প্রফেসর সেনানায়েকে বলেন:

"এটার তদন্তের প্রয়োজন আছে, কারণ ল্যাবে এই ওষুধে ভাইরাসের ওপর কোন কার্যকারিতার প্রমান পাওয়া যায় নি, অন্যদিকে একটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখা গেছে যে এটি ভাইরাস মেরে ফেলেছে, ভাইরাসের ওপর এর ভালো প্রভাব আছে, আবার অন্য আরেক গবেষণায় ভাইরাসের ওপর এর কোন প্রভাব পাওয়া যায়নি। হাইড্রোক্সি ক্লোরোকুইন-এর আরেকটি সমস্যা হলো এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে, এটি হার্টবিট অস্বাভাবিক করে দিতে পারে। "

মিথ ১০: বার বার গরম পানি দিয়ে গোসল করলে করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

প্রফেসর সেনানায়েকে বলেন:

"এমন কোন প্রমান নেই যে বার বার গরম পানি দিয়ে গোসল করে করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যাবে।"

মিথ ১১: স্যালাইন সলুশন দিয়ে সাইনাস ধুলে করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়।

প্রফেসর সেনানায়েকে বলেন:

"আপনার নাক বন্ধ হলে তা খুলতে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু সেটি করোনাভাইরাস মারতে পারবে না। "

মিথ ১২: 5G মোবাইল নেটওয়ার্ক-এর মাধ্যমে কোভিড ১৯ ছড়ায়।

প্রফেসর সেনানায়েকে বলেন:

"আমি ঠিক বুঝতে পারি না, কিভাবে 5G প্রযুক্তি ভাইরাস ছড়ায়, এই কথার কোন বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। কোভিড এমন সব দেশ এবং প্রত্যন্ত এলাকায় শনাক্ত হচ্ছে যাদের কোন 5G নেটওয়ার্কই নেই। "

মিথ ১৩: 5G নেটওয়ার্ক ইমিউন সিস্টেমকে দুর্বল করে দেয়, এবং এটাই কোভিড মহামারী ছড়িয়ে পড়ার কারণ।

প্রফেসর সেনানায়েকে বলেন:

"এমন কোন প্রমান নেই যে, 5G রেডিয়েশন ইমিউন সিস্টেমকে দুর্বল করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী।"

আমরা প্রফেসর সেনানায়েকে'কে আমাদের শ্রোতা-দর্শকদের আগ্রহ আছে এমন বিষয়ে কিছু প্রশ্ন করেছিলাম:

আমরা কি সুপারমার্কেটে গিয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারি?

"তাত্ত্বিকভাবে আমরা জানি, ড্রপলেটের মাধ্যমে ভাইরাস ছড়ায়। মানুষ যখন কাশে কিংবা হাঁচি দেয়, তখন ড্রপলেট ছড়িয়ে পড়ে। এবং এটা বস্তুর উপরিভাগে পড়ে, যেখানে সেটি বেঁচে থাকে। তাত্ত্বিকভাবে এটি সম্ভব যে আপনি সুপারমার্কেটে গিয়ে কিছু স্পর্শ করলে সংক্রমিত হতে পারেন, যেমন সুপারমার্কেটের ট্রলি, অথবা কাউন্টার। তাই যখনি আমরা বাইরে কমিউনিটিতে যোগ দেই, আমাদের এটা নিশ্চিত করতে হবে যে আমরা যেন বার বার স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার রাখি। আবার এটাও লক্ষ রাখতে হবে যে আপনি কিছু একটা ধরেছেন মানেই এটা নয় যে আপনি সংক্রমিত হয়েছেন। কিন্তু আপনার নিজেকে সংক্রমণমুক্ত রাখতে হবে, এজন্যই হ্যান্ড স্যানিটাইজার অথবা সাবান পানি দিয়ে হাত ধুয়ে নিন। কারণ এভাবেই আপনার হাতের ভাইরাস মরে যাবে, এবং আপনি যদি আপনার মুখ, নাক অথবা চোখ স্পর্শ করেন, তখন কোন ভাইরাস থাকবে না।"

কোভিড আক্রান্ত কেউ যদি দূর থেকে হাঁচি দেয়, তাতে কি আমি সংক্রমিত হতে পারি?

"একটি গবেষণায় দেখা গেছে, আপনি যদি হাঁচি বা কাশি দেন তাহলে তা ৮ মিটার পর্যন্ত যেতে পারে, কিন্তু এটা শুধু একটা গবেষণার ফল। এখন তাই আমরা মনে করছি যে মানুষজন যদি একে অপরের থেকে ১.৫ মিটার দূরে থাকে তবে কেউ কাশি বা হাঁচি দিলেও তা সংক্রমণের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হবে না। "

একজন সংক্রমিত ব্যক্তি যদি হাঁচি বা কাশি না দেন তাহলেও কি তারা ভাইরাস ছড়াতে পারে?

"জনস্বাস্থ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে ক্লোজ কন্টাক্ট দু'ভাবে হয়: একটি হচ্ছে আপনি যদি কারো সাথে মুখোমুখি ১৫ মিনিট থাকেন অথবা একটি আবদ্ধ ঘরে কারো সাথে দু'ঘন্টার বেশি থাকেন (আপনাদের মধ্যে ১.৫ মিটার দূরত্ব থাকলেও)।"

জড় বস্তুর ওপর ভাইরাস পড়লে তার ঝুঁকি কতোটুকু?

"এতে ঝুঁকি অনেক কম হলেও এতেও সংক্রমণের সম্ভাবনা আছে এবং আপনি যদি কোন কিছুর উপরিভাগে স্পর্শ করেন, যা কিছু আগেই কেউ স্পর্শ করে গেছে, তাতেও ভাইরাস থাকার সম্ভাবনা থেকে যায়। কিন্তু কেউ যদি দু'দিন আগে স্পর্শ করে তবে ঝুঁকি অনেক কম হবে। "

জড় বস্তুর ওপর ভাইরাস কতক্ষন বেঁচে থাকে এবং হাতে কতক্ষন থাকে ?

"আমরা জানি যে ভাইরাস কপার মেটালের ওপর চার ঘন্টা, কাগজ বা কার্ডবোর্ডের ওপর ২৪ ঘন্টা, এবং স্টেইনলেস স্টিল এবং প্লাস্টিকের ওপর ৭২ ঘন্টা থাকে। হাতের ওপর কতক্ষন থাকে এ বিষয়ে এখনো কিছু জানা যায় নি।"


Share