জলবায়ূ পরিবর্তনজনিত কারণে উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষিজমিতে লবনাক্ততার মাত্রা দিনদিন বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে জলাবদ্ধতা। বাড়ছে তাপমাত্রা, খরা এবং অনাকাঙ্খিত বৃষ্টিপাত। এই সমস্ত কারণে উপকূলের কৃষকরা শুকনো মৌসুমে চাষাবাদ করে কাঙ্খিত ফসল ঘরে তুলতে পারছে না। ফলে উপকূলের বেশীরভাগ কৃষক শুকনো মৌসুমে চাষাবাদে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। সারা বছর শুধুমাত্র বৃষ্টির মৌসুমে একটি ফসল আমন ধান করেই কৃষকদের সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। বাকী সময় অর্থাৎ পুরো শুকনো মৌসুমে হাজার হাজার হেক্টর জমি পতিত থাকছে।
উপকূলীয় অঞ্চলে মুগ ডাল উৎপাদন Source: Dr M G Neogi
শুষ্ক মৌসুমে এই সমস্ত পতিত জমিতে লাভজনক ফসল ফলানোর লক্ষ্যে অস্ট্রেলিয়া এবং বাংলাদেশের কৃষি বিজ্ঞানীরা যৌথভাবে গবেষণা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছেন। এই কার্যক্রমের আওতায় বিজ্ঞানীবৃন্দ লবনাক্ততা ও প্রতিকূলতা সহিষ্ণু ডাল ও গম ফসলের জাত উদ্ভাবন করছেন, যা উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষক পরিবারে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় অবদান রাখবে। প্রকল্পের কার্যক্রম বাস্তবায়নে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ণ অস্ট্রেলিয়া, এবং অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান CSIRO সরাসরি সম্পৃক্ত। অস্ট্রেলিয়ার ACIAR ( Australian Centre for International Agricultural Research ) এবং বাংলাদেশের KGF ( Krishi Gobeshona Foundation ) এই প্রকল্পে অর্থ সহায়তা করছে।
গত বছর এবং এ বছর অর্থাৎ ২০১৮ এবং ২০১৯ সনে বরিশাল, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা এবং সাতক্ষীরা উপকূল অঞ্চলে স্থানীয় কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের নিজস্ব জমিতে এবং কৃষকের মাঠে সরাসরি কৃষকের অংশগ্রহনে মুগ, মশুর, মটর, খেসারী এবং কাউপি বা ফেলন ডালের গবেষণা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। মূল উদ্দেশ্য ছিল প্রতিকূলতা সহিষ্ণু ডাল ফসলের জাত চিহ্নিত করা। সেই সাথে উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা, যাতে উপকূল অঞ্চলের কৃষক উদ্ভাবিত জাত ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্বল্প খরচে তাদের পতিত জমিতে লাভজনক ফসল উৎপাদন করতে পারে এবং পরিবারের পুষ্টির নিশ্চয়তা বৃদ্ধি করতে পারে।
বর্তমানে শুধু পটুয়াখালী জেলায় প্রায় ৯০ হাজার হেক্টর জমিতে মুগডাল চাষ হচ্ছে। কৃষকদের কাছে গ্রহনযোগ্য, ব্যবহার উপযোগী এবং সাশ্রয়ী প্রযুক্তি উদ্ভাবনের লক্ষ্যে এই প্রকল্প বারি সিডার মেশিন দিয়ে মুগডাল চাষাবাদের উপর গবেষনা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। প্রচলিত পদ্ধতিতে মুগডাল চাষাবাদের জন্য ১ বিঘা জমি তৈরী করতে ৩-৪ দিন সময় লাগে এবং এক থেকে দুই হাজার টাকা খরচ হয়। গবেষনায় দেখা গেছে, সিডার মেশিন দিয়ে অনায়াসে মাত্র ১ ঘন্টায় ১ বিঘা জমিতে একই সাথে জমি চাষ, লাইনে বীজ বপন এবং সাথে সাথে বীজ ঢেকে দেয়া হচ্ছে। এতে খরচ হচ্ছে মাত্র ৪০০-৫০০ টাকা।
কৃষক ও কৃষিবিজ্ঞানীদের অংশগ্রহনমূলক এই গবেষনায় কৃষক জানিয়েছেন, শুধু মাত্র সিডার মেশিন দিয়ে মুগডাল চাষাবাদ করলে দ্বিগুনেরও বেশি ফলন ঘরে আসছে।
প্রকল্পের আওতায় মুগ ফসলের বিভিন্ন পোকা-মাকড় দমনের উপর গবেষনা হচ্ছে। দেখা গেছে, মুগ গাছে ফুল ধরা শুরু হলে থ্রিপস পোকার আক্রমন হয়। এছাড়াও ফুল ও ফল ছিদ্রকারী পোকা-মাকড় গাছের ফুল ও ফল নষ্ট করে দেয়। পরিবেশ সম্মত উপায়ে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই সমস্ত পোকা-মাকড় ও রোগ-বালাই দমনের উপর গবেষনা হচ্ছে।
থ্রিপস পোকা নীল ও সাদা রং এর প্রতি সহজেই আকৃষ্ট হয়। তাই, নীল আঠালো ফাঁদ ব্যবহার করে এ ধরনের পোকা দমনে সফলতা পাওয়া যাচ্ছে। ফল ছিদ্রকারী পোকা দমনে সেক্স ফেরোমন ফাঁদ কার্যকর ভূমিকা রাখছে। আশা করা হচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে বিষাক্ত কীটনাশক ব্যবহার না করেই কৃষকরা পরিবেশসম্মত জৈব বালাইনাশক এবং সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মুগ ফসলের পোকা-মাকড় ও রোগ-বালাই দমন করা সম্ভব হবে।
এছাড়া মুগ ফসলের আগাছা দমনের বিভিন্ন পদ্ধতির উপর গবেষণা হচ্ছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের ব্যবহার উপযোগী একটি সহজ কম ব্যয় সাপেক্ষ কার্যকর আগাছা দমন পদ্ধতি কৃষকদের দিতে সক্ষম হবে বলে সংশ্লিষ্ট কৃষিবিজ্ঞানীরা মনে করেন।
এছাড়া মুগ ফসল চাষাবাদ ব্যবস্থাপনা নিয়েও গবেষনা হচ্ছে। ৩০ সেন্টিমিটার দূরত্বে লাইনে বীজ বপন এবং প্রতি বর্গমিটারে ৩৫টি গাছ থাকলে ভাল ফলন পাওয়া যেতে পারে বলে গবেষকরা মনে করছেন। এছাড়া উপকুল অঞ্চলে জানুয়ারী মাসের মাঝামাঝি থেকে জানুয়ারীর শেষ পর্যন্ত মুগ ডালের বীজ বপনে বেশী ফলন পাওয়া যেতে পারে বলে গবেষণায় প্রতীয়মান হচ্ছে।
এই গবেষনা কার্যক্রমের আওতায় আর্থ-সামাজিক তথ্য-উপাত্তে দেখা যায় - মুগডাল চাষাবাদে পরিবারের নারী-পুরুষ সবাই সরাসরি জড়িত। পুরুষ সদস্যরা জমিচাষ ও নিড়ানী কাজে জড়িত থাকলেও মহিলারা মুগডালের ছেই তোলা থেকে শুরু করে ছেই রোদে শুকানো, মাড়াই করা, পরিস্কার করা, মুগ কালাই রোদে দেয়া, ঘরে সংরক্ষন করা সহ সব কাজ করে থাকেন।
এখন পর্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ধান-গম ভাঙ্গানোর মত মুগডাল ভাঙ্গানোর মেশিন নাই। সে কারণে মুগডাল চাষীরা কম মূল্যে মুগ কালাই ফড়িয়াদের কাছে বিক্রী করে দিতে বাধ্য হয়। এই সমস্যা থেকে উত্তোরনে প্রকল্প থেকে গ্রামে ডাল ভাঙ্গানের ২/৩ টি ছোট মিল স্থাপন করার কথা চিন্তা করা হচ্ছে, যে মিনি-মিল ACIAR পূর্বের প্রকল্পে উদ্ভাবন করা হয়েছে।
এই প্রকল্পের উদ্ভাবিত প্রযুক্তিগুলো উপকূলীয় অঞ্চলের দরিদ্র কৃষক পরিবারের স্বার্থে বাংলাদেশ সরকার তাদের নিজস্ব কার্যক্রমে অর্ন্তভূক্ত করবে এবং কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের মাধ্যমে উপকূল অঞ্চলে সম্প্রসারন করে গরীব কৃষক পরিবারের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এবং তাদের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় অবদান রাখবে। এক্ষেত্রে ACIAR এবং KGF তাদের কারিগরি সহায়তার হাত বাড়াতে পারে। এই কর্মযজ্ঞে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইউনিভার্সিটি অব ওয়েষ্টার্ন অষ্ট্রেলিয়ার ডেপুটি প্রজেক্ট লিডার ড. এম. জি. নিয়োগী।