বিদায় আলী যাকের

চলে গেলেন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব, একাত্তরের শবদসৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী যাকের। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে আলী যাকেরের কাজ করেছেন সামনের সারিতে থেকে।

Aly Zaker

Aly Zaker Source: Facebook

বাংলাদেশ যে চার মূলনীতি নিয়ে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র- এ চার নীতিকে আলী যাকের মনে প্রাণে ধারণ করতেন। দেশকে তিনি বুকে লালন করতেন। মুক্তিযুদ্ধের পর দেশকে পুনর্গঠনে যাঁরা কাজ করেছিলেন, আলী যাকের তাঁদের অন্যতম।

পরের প্রজন্মের জন্য মুক্তিযুদ্ধকে জাদুঘরে সাজিয়ে রাখার জন্য যেসব মানুষ কাজ করেছিলেন, তিনি তাঁদের একজন। দেশকে স্বাধীন একটি নাট্যাঙ্গন দিয়েছেন যাঁরা, আলী যাকের সেই নিবেবদিতপ্রাণ নাট্যজনদের অন্যতম।

পৈতৃক নিবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে। জন্ম চট্টগ্রামে ১৯৪৪ সালের ৬ নভেম্বর। বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে বাবার চাকরির সুবাদে ছেলেবেলায় এক শহর থেকে আরেক শহরে ঘুরে বেড়িয়েছেন আলী যাকের। ফেনী, খুলনা, কুষ্টিয়া ঘুরে বাবা যখন প্রাদেশিক সরকারের সচিব হলেন, তখন আলী যাকেরের পরিবার থিতু হয় ঢাকায়।

সেন্ট গ্রেগরি থেকে ম্যাট্রিক এবং নটরডেম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট করে আলী যাকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই জড়িয়ে পড়েন নাট্যচর্চায়, সেই সঙ্গে ছাত্র রাজনীতিতে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষ করে করাচিতে যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিজ্ঞাপনী সংস্থা ডব্লিউ এস ক্রফোর্ডাসে ট্রেইনি এক্সিকিউটিভ হিসেবে আলী যাকেরের কর্মজীবন শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আলী যাকের প্রথমে ভারতে গিয়ে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। চলচ্চিত্র পরিচালক ও সাংবাদিক আলমগীর কবির তাকে উদ্বুদ্ধ করেন প্রচারযুদ্ধে অংশ নিতে।

আলী যাকের যুক্ত হন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। যুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশে ফেরার পর ১৯৭২ সালে তিনি এশিয়াটিকের দায়িত্ব নেন, মৃত্যুর সময় তিনি কোম্পানির গ্রুপ চেয়ারম্যান ছিলেন।

১৯৭২ সালে আরণ্যকের ‘কবর’ নাটকে অভিনয় করেন আলী যাকের, শুরু হয় মঞ্চে তার পথচলার।সে নাটক দেখে পরে জিয়া হায়দার ও আতাউর রহমান তাকে নিয়ে যান তাদের দল নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে। মৃত্যু পর্যন্ত আলী যাকের এই নাট্যদলের সভাপতি ছিলেন।

মঞ্চে নূরলদীন, গ্যালিলিও ও দেওয়ান গাজীর চরিত্রে আলী যাকেরের অভিনয় এখনও দর্শক মনে রেখেছে। ‘বহুব্রীহি’, ‘তথাপি পাথর’, ‘আজ রবিবার’এর টিভি নাটকে অভিনয় করেও তিনি প্রশংসা পেয়েছেন।

‘অচলায়তন’, ‘বাকী ইতিহাস’, ‘সৎ মানুষের খোঁজে’, ‘তৈল সংকট’, ‘এই নিষিদ্ধ পল্লীতে’, ‘কোপেনিকের ক্যাপ্টেন’সহ বেশ কয়েকটি মঞ্চ নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন আলী যাকের। বেতারে অর্ধশতাধিক শ্রুতি নাটকেও কাজ করেছেন।

অভিনয়, নির্দেশনার বাইরে তিনি ছিলেন একজন নাট্যসংগঠক; পাশাপাশি যুক্ত ছিলেন লেখালেখির সঙ্গে। নাটকে অবদানের জন্য ১৯৯৯ সালে সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে।এছাড়া দীর্ঘ কর্মজীবনে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, মুনীর চৌধুরী পদক, নরেন বিশ্বাস পদকসহ বিভিন্ন সম্মাননা পেয়েছেন আলী যাকের।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি আলী যাকের যুক্তরাজ্যের রয়্যাল ফটোগ্রাফিক সোসাইটিরও সদস্য ছিলেন।

প্রয়াত এই অভিনেতার মরদেহ শুক্রবার বেলা ১১টার পর শেরেবাংলা নগরে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। জাদুঘর প্রাঙ্গণে আলী যাকেরের কফিন জাতীয় পতাকায় মুড়ে দেন জাদুঘরের ট্রাস্টিরা। প্রথমে কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে। পরে একাত্তরের শব্দসৈনিক এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানিয়ে দেওয়া হয় গার্ড অব অনার।

এরপর একে একে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টিরা, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়, আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট, ছায়ানট, থিয়েটার, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব শেষে আলী যাকেরের কফিন নিয়ে যাওয়া হয় বনানীতে তার কর্মস্থল এশিয়াটিক থ্রি সিক্সটি ডিগ্রির কার্যালয়ে। সেখানে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব।
এশিয়াটিক থেকে আলী যাকেরের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় বনানী কবরস্থানে। বিকাল পৌনে ৫টায় জানাজা শেষে সেখানেই তাকে দাফন করা হয়।


Share
Published 28 November 2020 11:13pm
By Ali Habib
Presented by Abu Arefin

Share this with family and friends