সোমবার কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন ভারতীয় প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার তরুণ মজুমদার। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯১ বছর।
১৯৬২ সালে কাচের স্বর্গ ছবির জন্য প্রথম জাতীয় পুরস্কার পান পরিচালক তরুণ মজুমদার। মোট চারটি জাতীয় পুরস্কার জয়ী চলচ্চিত্র পরিচালককে কেন্দ্রীয় সরকার পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করে ১৯৯০ সালে।
READ MORE
নতুন এসবিএস রেডিও অ্যাপ ডাউনলোড করুন
১৯৩১ সালের ৮ জানুয়ারি ব্রিটিশ ভারতের অবিভক্ত বাংলার বগুড়ায় জন্ম পরিচালক তরুণ মজুমদারের। বাবা বীরেন্দ্রনাথ মজুমদার ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। পড়াশোনা কলকাতাতেই, সেন্ট পলস্ ক্যাথিড্রাল মিশন কলেজ এবং স্কটিশ চার্চ কলেজের ছাত্র তরুণ মজুমদার পরে রসায়ন নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন।
ফিল্ম জগতে পদার্পণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করার পরই। তবে ১৯৫৯ সালে প্রথম ফিল্ম পরিচালনায় আসেন তরুণ মজুমদার। উত্তম কুমার সুচিত্রা অভিনীত, চাওয়া পাওয়া ছবি দিয়ে। তখন তাঁর বয়স ২৮ বছর। তবে এই ছবিটির পরিচালনায় ছিল, যাত্রিক নামে একটি গোষ্ঠী। যার সদস্য ছিলেন শচীন মুখোপাধ্যায়, দিলীপ মুখোপাধ্যায়ের এবং তরুণ মজুমদার।
১৯৬৩ সাল পর্যন্ত এই যাত্রিক-এর সঙ্গেই ছবির পরিচালনা করেছেন তরুণ মজুমদার। তার পর আলাদাভাবে ছবি পরিচালনা শুরু করেন। ১৯৬২ সালে এই যাত্রিকের পরিচালনাতেই কাচের স্বর্গ ছবিটি তৈরি হয়। যা পরে জাতীয় পুরস্কার এনে দেয় পরিচালক তরুণ মজুমদারকে।
আসলে পুর্ববঙ্গের এক মফস্বল শহরের মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান যাবতীয় চেনা ছকের জীবিকা বা যাপনকে পাত্তা না দিয়ে ১৯৫০-এর দশকে সিনেমা তুলতে চেয়েছিলেন। ১৯৫৯ সালে শচীন এবং দিলীপ, দুই মুখোপাধ্যায়ের সংযোগে তৈরি হয়েছিল, যাত্রিক গোষ্ঠী। প্রথম ছবি, চাওয়া পাওয়া। উত্তম-সুচিত্রার রসায়নে বাণিজ্যিক সাফল্য অনিবার্য। কিন্তু তৃতীয় ছবিতেই ছক ভাঙলেন তরুণ মজুমদার। কাচের স্বর্গ-তে গ্ল্যামারের দিকে না হেঁটে সটান নিজের সহকর্মী দিলীপ মুখোপাধ্যায়কেই নিয়ে আসেন নায়কের ভূমিকায়।তরুণ মজুমদারের ছবি দেখতে ভিড় জমাতেন সব বয়সিরাই। কেননা, সকলের জন্যই কিছু না কিছু থাকত সেই ছবিগুলিতে। সবথেকে বড় কথা, অন্ধকার হলে নায়কের লার্জার দ্যান লাইফ-এর আবেদন ছাড়াও স্রেফ চেনা জীবনের গল্পকেও যে রূপকথা করে তোলা যায়, সেটাই তরুণ মজুমদারের ইউএসপি (ইউনিক সেলিং পয়েন্ট)।
Nehal Dutta with Tarun Majumdar. Source: Wikimedia Commons/Public Domain/Nehaldutta
বলা হয় এখন আর বাঙালির যৌথ পরিবার নেই। নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির স্কোয়ার ফুটে মাপা জীবনের বিপ্রতীপে তরুণবাবুর ছবিগুলি দেখলে আজ সমান্তরাল বিশ্বের কথা মনে হতে পারে। অথচ কয়েক দশক আগে এটাই ছিল বাঙালির চেনা জীবন। সেই জলছাপ খুঁজতে চাইলে দেখতেই হবে সংসার সীমান্তে, শ্রীমান পৃথ্বীরাজ, দাদার কীর্তি’র মতো ছবি।
দাদার কীর্তি’র নায়ক কেদারের পড়াশোনায় মাথা নেই। অনেক চেষ্টাতেও বিএ পরীক্ষায় আর পাশ করতে পারে না। বাবা রেগে গিয়ে তাঁকে পাঠিয়ে দিলেন বিহারে কাকার বাড়িতে। নেহাতই সরল কেদারের মনে ধরে সরস্বতীকে। আদ্যন্ত সিরিয়াস মেয়ে সরস্বতী। তবু কেদার যখন পিয়ানো বাজিয়ে গান গেয়ে ওঠে, তখন সেই পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকা তরুণীর দু’চোখে মনকেমনের মেঘ ভেসে ওঠে। এই প্রেমের মাঝে এসে দাঁড়ায় ভোম্বলদার মতো এক নিষ্ঠুর মানুষ। নিষ্ঠুর, তবু সে হৃদয়হীন নয়। শেষপর্যন্ত নিজের ভুল বুঝতে পেরে কেদার-সরস্বতীর অভিমানের পাথর ঠেলে সরিয়ে দেয় আমোদগেঁড়ে ভোম্বলদাই। গোটা ছবি জুড়ে ঝিকমিক করছে বাঙালিয়ানা। দোলখেলা থেকে শুরু করে বিজয়া সম্মিলনীর যে ডকুমেন্টেশন ধরা রয়েছে দাদার কীর্তি’তে তা তুলনাহীন। দেখলে মনে হয়, টাইম মেশিনে চড়ে কয়েক দশক আগের সেই আপাত শান্ত সময় থেকে ঘুরে আসতে।
সমালোচকরা বলেন, তরুণ মজুমদারের ছবির আরেক বড় শক্তি তার গান। বিশেষ করে রবীন্দ্রসংগীত। রবীন্দ্রনাথের গানকে বাণিজ্যিক ছবিতে ব্যবহার করাটা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। প্রযোজকদেরও নাকি প্রথম দিকে আপত্তি থাকত। আপাত ধীরগতির গান। কিন্তু সিচুয়েশন বুঝে প্রয়োগ করলে সাধারণ দর্শককেও মুগ্ধ করা যায়, তা প্রতিটি ছবিতেই প্রমাণ করে দিয়েছেন তরুণ মজুমদার। আলো ছবির একেবারে শেষে যখন মৃতা আলো চ্যাটার্জির গান বেজে ওঠে গ্রামাফোনে, তখন কার্যত একটা ম্যাজিক তৈরি হয়ে যায়। কিংবা দাদার কীর্তি ছবিতে, চরণ ধরিতে দিও গো আমারে। কিংবা পলাতক ছবির সেই গান, জীবনপুরের পথিক। এটা অবশ্য রবীন্দ্রসংগীত নয়। কিন্তু প্রয়োগকৌশলের নৈপুণ্যে তা অব্যর্থ হয়ে ওঠে ছিল।
একটা সময়, যে সময় সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেনের মতো পরিচালকরা সিনেমার জগতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, সেই সময়ে বড়পর্দায় পারিবারিক কাহিনি ফুটিয়ে তুলতে শুরু করেন তরুণ মজুমদার। পলাতক ছবির তৈরির পর যাত্রিক থেকে বেরিয়ে আসেন তরুণ মজুমদার। ১৯৬৫ সালে আলোর পিপাসা এবং একটুকু ভালবাসা নামের দু’টি সিনেমা তৈরি করেন তিনি। তারপর থেকে নিজের পরিচালনায় তৈরি করেছেন বালিকা বধূ, রাহগির, নিমন্ত্রণ, কুহেলি, শ্রীমান পৃথ্বীরাজ, গণদেবতা, দাদার কীর্তি, ভালবাসা ভালবাসা, আপন আমার আপন, আলো, চাঁদের বাড়ি’র মতো সিনেমা। সাহিত্যপ্রেমী ছিলেন তরুণ মজুমদার। বনফুল, বিমল কর, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো সাহিত্যিকের গল্প নিয়ে ছবি করতেন তরুণ মজুমদার।
READ MORE
এসবিএস বাংলা ফেসবুক নীতিমালা
২২ বছর ধরে কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন তরুণ মজুমদার। ৬ জুন শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাঁকে এসএসকেএম হাসপাতালে ভরতি করা হয়। মৃত্যুর আগে দেহ দানের অঙ্গীকার করেছিলেন। কিন্তু লিখিতভাবে সম্মতি দেওয়ার আগেই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। পরিচালকের শেষ ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে তাই, যেখানে শেষ চিকিৎসা হয়েছে, সেই এসএসকেএম হাসপাতালের অ্যানাটমি ডিপার্টমেন্টে দান করা হয়েছে প্রয়াত পরিচালকের পার্থিব দেহ, ডাক্তারি পড়ুয়াদের জন্যে। আর তার আগে শববাহী গাড়িতে চেপে শেষবারের মতো ঘুরে গিয়েছেন, টালিগঞ্জের ষ্টুডিও ফ্লোর। সেখানেও শোক জ্ঞাপনে ফুল দেওয়া যায় নি। পরিচালকই বারণ করে গিয়েছেন।
বিদায় জীবনপুরের পথিক। চাওয়া পাওয়া’র ঊর্ধ্বে মেঘ-বৃষ্টি-রোদ্দুরের যে খেলা প্রকৃতিতে, বাঙালির জীবনের সেই খেলাই তরুণ মজুমদার তুলে ধরতেন নিজের ছবিতে। বাঙালি, বলা ভাল মধ্যবিত্ত বাঙালি বলতে যে আর্কিটাইপ চোখের সামনে ফুটে ওঠে সেই বাঙালিকে চিনতে হলে আগামী দিনেও নতুন প্রজন্মকে দেখতে হবে তাঁর ছবি। দেখতেই হবে। দেখতে দেখতে বুঝতে পারবেন, বাঙালি একসময় এমনই ছিল। সেই হাসি-কান্না-অভিমান আর হৃদয় উপচে পড়া ভালবাসাকে সেলুলয়েডে ধরে রেখে দিয়ে গিয়েছেন তিনি। পলাতক, বালিকা বধূ থেকে, একেবারে শেষের ভালবাসার বাড়ি-তেও সেই ধারা অটুট ছিল।
এসবিএস বাংলার অনুষ্ঠান শুনুন রেডিওতে, এসবিএস বাংলা রেডিও অ্যাপ-এ এবং আমাদের ওয়েবসাইটে, প্রতি সোম ও শনিবার সন্ধ্যা ৬ টা থেকে ৭ টা পর্যন্ত। রেডিও অনুষ্ঠান পরেও শুনতে পারবেন, ভিজিট করুন: