অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের ফার্স্ট নেশন্স অস্ট্রেলিয়ান, ফার্স্ট পিপল, ইন্ডিজেনাস অস্ট্রেলিয়ান, এবঅরিজিনাল পিপল, এবঅরিজিনি (সম্প্রতি অপ্রচলিত)বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। এই মহাদেশীয় ভূমিতে ৬৫ হাজার বছরেরও বেশি সময়কাল ধরে বসবাস করে আসছেন। তারাই এই আদিভূমির ভূমিপুত্র।
১৭৮৮ সালের ২৬ জানুয়ারীতে ব্রিটিশ উপনিবেশকারীদের প্রথম নৌবহর আদিভূমি অস্ট্রেলিয়ার সিডনী উপকূলে নোঙর ফেলে। তারা এসে ব্রিটিশ আইন অনুযায়ী দাবী করে এই দেশটি একটি “টেরা নালিয়াস” অর্থাৎ এই দেশটি কারোর দখলকৃত নয়। কারোর অধিকৃত নয় দাবী করে তারা অস্ট্রেলিয়ায় ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপন করে।
এই দিনটিকে এদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে অস্ট্রেলিয়া ডে হিসাবে পালন করা হয়। স্বভাবতই আদিবাসীদের কাছে এই দিনটি উদযাপনের নয়, বরং শোক পালনের।
শোক দিবসের পটভূমি
১৯৩৮ সালের ২৬ জানুয়ারীতে যখন অস্ট্রেলিয়াজুড়ে প্রথম বৃটিশ নৌবহর অবতরণের ১৫০ বর্ষপূর্তি উদযাপিত হচ্ছিল, তখন জ্যাক প্যাটেন ও উইলিয়াম ফারগুসনের এর নেতৃত্বাধীন প্রগতিশীল আদিবাসী আন্দোলন এবং উইলিয়াম কুপারের নেতৃত্বাধীন অস্ট্রেলিয়ান এবঅরিজিন্স লীগ যৌথভাবে শোক দিবস কর্মসূচী পালন করেন।
উল্লেখ্য যে, সেই সময়ে আদিবাসীদের অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক হিসাবে গণ্য করা হত না। তারা ছিলেন “ফ্লোরা এন্ড ফনা” অর্থাৎ এই দেশের বাকী সব প্রানী আর উদ্ভিদের সমতূল্য, মানুষের সমমর্যাদারও নয়!
শোক দিবস পালনের মধ্য দিয়ে তারা অস্ট্রেলিয়ায় শ্বেতাঙ্গদের বৈষম্য-অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদ জানাতে চেয়েছিলেন। সেদিন তারা আদিবাসীদের পূর্ণাংগ নাগরিকের অধিকার দাবী করেন। যদিও তাদের সেই শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ আর তাদের দাবীগুলো সরকার আমলে নেয়নি।
স্বাধীনতা আর আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার হারানোর শোক, স্বদেশভূমি হারানোর শোক এবং ব্রিটিশ উপনিবেশের শুরু থেকে গণহত্যায় আপনজনদের হারানোর শোক নিয়ে সেদিন শোক দিবস পালন করা হয়েছিল। ।
সেদিনের সভায় উইলিয়াম কুপার বলেন, “আমাদের দিন বদলের সময় এসেছে। আমাদের দাবী-দাওয়ার জন্য কঠিন সংগ্রাম করতে হবে। সুযোগ পেলে আমরাও সবার সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলতে পারি। কমনওয়েলথ জুড়ে আদিবাসীদের অগ্রগতির জন্য আমাদের সকলের একযোগে কাজ করা উচিত।”
বিক্ষোভ সভার অন্যতম সংগঠক জ্যাক প্যাটেন সেদিন বক্তৃতায় বলেন,
“আজ শ্বেতাংগরা আনন্দ করছে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া রাষ্ট্রের ১৫০ তম জন্মদিনে আমাদের মত আদিবাসীদের আনন্দ উদযাপনের দিন নয়। আজকের সভায় আমাদের উদ্দেশ্য হল অস্ট্রেলিয়ার শ্বেতাঙ্গদের কাছে এই মহাদেশের আদিবাসীরা যে ভয়ানক পরিস্থিতির মধ্যে বাস করে তার বার্তা পৌঁছে দেওয়া।”
“আমরা আমাদের কন্ঠ তাদের কানে পৌঁছে দিতে চাই। আমাদেরকে পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী বানিয়ে রাখা যাবে না। শ্বেতাঙ্গরা মনে করে আমরা নীচু বর্গের, আমাদের কোন উন্নতি হবে না। অস্ট্রেলিয়া সামনে এগিয়ে চলেছে; আমরা পেছনে পড়ে থাকতে চাই না। আমাদেরকে সুযোগ দেওয়া হোক। আমাদেরকে পূর্ণাংগ নাগরিক অধিকার দেওয়া হোক।”
শোক দিবসের মধ্য দিয়ে যে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল তা চুড়ান্ত পর্যায়ে সিডনীর অস্ট্রেলিয়া হলে আয়োজিত সমাবেশে পরিণতি লাভ করে। এই কনফারেন্স ছিল অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে জাতীয় পর্যায়ে সমন্বিত প্রথম আয়োজন। অনেকের মতে এই কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আধুনিক অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী অধিকার আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল।
উইলিয়াম ফার্গুসন তার বক্তৃতায় বলেন,
“আমি আউটব্যাক (অস্ট্রেলিয়ার বিস্তীর্ন দূর্গম অঞ্চল) অঞ্চলের এবঅরিজিনাল রিজার্ভে থাকা আমার জ্ঞাতিদের দূর্দশা নিজের চোখে দেখে এসেছি। সময় এসেছে! আমাদের নিজেদের কিছু করতে হবে, জোরাল কন্ঠে আমাদের কথা শোনাতে হবে। এইজন্যেই আমরা এবঅরিজিন্স প্রগ্রেসিভ এসোসিয়েশন গঠন করেছি।“
সেদিন থেকে শোক দিবস দিনটি আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও তাদের মিত্ররা নিয়মিত পালন করে আসছেন। তাদের ধারাবাহিক আন্দোলনে সংবিধান সংশোধন এবং ১৯৬৭ সালের গণভোট অনুষ্ঠিত হয়।
তাঁবু দূতাবাস
১৯৭২ সালের ২৬ জানুয়ারী চারজন আদিবাসী পুরুষ ক্যানবেরার সংসদ ভবনের সামনে তাঁবু গেড়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। তাদের এই তাঁবুর নাম তারা দিয়েছিলেন এবঅরিজিনাল টেন্ট এম্বাসি বা আদিবাসীদের তাঁবু দূতাবাস।
তাঁদের এই শান্তিপুর্ণ বিক্ষোভ বিশ্বজোড়া দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং আদিবাসী ভূমি অধিকারের লড়াইকে বেগবান করে তোলে।
Radio Redfern was the main source of information for people wanting to join the protests. The broadcast included interviews and music from First Nations artists.
দ্বিশতবর্ষ পূর্তিকালীন প্রতিবাদ এবং “সারভাইভাল ডে”
১৯৮৮ সালের ২৬ জানিয়ারী অস্ট্রেলিয়া প্রথম নৌবহর অবতরনের দ্বিশতবর্ষপূর্তি উদযাপন করছিল। অস্ট্রেলিয়ানের জীবনে ঔপনিবেশিক ইতিবাচকতা এবং তার উদযাপনই ছিল সেই বিশেষ দিবসের মূল প্রতিপাদ্য। এই ঔপনিবেশিকতার সাথে পাল্লা দিতে ফার্স্ট ন্যাশন জনগোষ্ঠী এবং তাদের মিত্ররা সিডনীতে ৪০ হাজার মানুষের বিক্ষোভ মিছিল আয়োজন করে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর এটাই ছিল অস্ট্রেলিয়ার সর্ববৃহৎ লোকজমায়েত।
পুলিশী হেফাজতে আদিবাসীদের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে (১৯৮৭-১৯৯১) রয়্যাল কমিশন বিতর্ক নিয়ে তখন তীব্র অসন্তোষ ছিল। এই ক্ষুদ্ধতার সাথে যোগ হয়েছিল আদিবাসী ভূমি অধিকার এবং চুক্তির আন্দোলন।
১৯৮৮ সাল জুড়ে ফার্স নেশন্স জনগোষ্ঠী ২৬ জানুয়ারীকে অস্ট্রেলিয়া ডে’র পরিবর্তে “ইনভেজন ডে” বা আগ্রাসন দিবস ঘোষণা করে। এই উপলক্ষ্যে তারা পোষ্টার ছাপায়,
“সাদা অস্ট্রেলিয়ার একটা কালো ইতিহাস আছে — ১৯৮৮ সাল উদযাপন করবেন না!”
এবং
“অস্ট্রেলিয়া দিবস = আগ্রাসন দিবস ১৯৮৮”
“যে দর্শনে উজ্জিবিত হয়ে আমরা “মার্চ-৮৮” গঠন করেছি এবং যে দর্শন আমরা আজ প্রদর্শন করতে করতে চাই, তা হচ্ছে আমাদের টিকে থাকা! (সারভাইভাল) আমরা আমাদের জীবন বাঁচাতে পেরেছি, এটাই আমাদের উদযাপনের বিষয়।”
“শ্বেতাঙ্গদের আগমনকে কোনভাবেই একজন আদিবাসী উদযাপন করতে পারেন না। এ বিষয়ে অনেক বিতর্ক হতে পারে যে, একজন সুষ্ঠ বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি এদেশে শ্বেতাঙ্গদের আগমনকে কিছুতেই আনন্দের সাথে উদযাপন করতে পারেন না। কেননা তারা সাথে অস্ট্রেলিয়ায় গণহত্যা, সংস্কৃতি ও পৃথিবীতে ধ্বংসযজ্ঞের আগমন ঘটেছে। তারা অস্ট্রেলিয়ায় দূর্দশা, রোগ-ব্যাধি ও ভোগান্তি বয়ে এনেছে।”
—ক্রিস কার্কব্রাইট, এনএসডব্লিউ এবঅরিজিনাল ল্যান্ড রাইটস এক্ট এর রেজিস্ট্রার এবং মার্চ ৮৮ এর অন্যতম সদস্য।
বিক্ষোভকারীদের কথোপকথন সেদিন আদিবাসীদের মুখপাত্র রেডিও রেডফার্ণে সম্প্রচারিত হচ্ছিল।
একজন বিক্ষোভকারী বলেন,
“আমরা আজ আমাদের টিকে থাকাকে উদযাপন করতে চাই। আমাদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে চাই। আমরা আজ এই আনন্দ উদযাপন করতে চাই।”
অন্যজন বলেন,
“আমি ভেবেছিলাম আজকের দিনটি কেবলই শোকের দিন, কিন্তু আজ আমাদের আনন্দের দিনও বটে। শ্বেতাঙ্গদের আগ্রাসন-আক্রমণের ২০০ বছর চলছে, অথচ আজও আমরা টিকে আছি! আমাদের অবশ্যই এই টিকে থাকাকে (সারভাইভাল) উদযাপন করা উচিৎ।”
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জাতীয় দিবস হিসাবে ২৬ জানুয়ারী দিনটিকে পরিবর্তনের দাবী জোরাল হচ্ছে। মূলধারার জনগোষ্ঠীর মাঝে তারিখ পরিবর্তনের আন্দোলন আরো বেগবান হচ্ছে এবং আগ্রাসন দিবসের মিছিলে নতুন নতুন মানুষ সামিল হচ্ছেন।