রোববার দিল্লিতে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়।দুপুরে প্রথমে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ শুরু হয়।কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত হয়ে পড়ে যে, পাঁচটি মেট্রো স্টেশন বন্ধ করে দেওয়া হয়। রেললাইনের সিলামপুর ও পিংক লাইনের ওয়েলকাম, জাফরাবাদ, মৌজপুর-বাবরপুর ও গোকুলপুরী স্টেশন বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিশেষ পরিস্থিতি জানতে, দিল্লি মেট্রো ও দিল্লি ট্র্যাফিক পুলিশের ট্যুইটার হ্যান্ডেল চেক করার পরামর্শ দেওয়া হয় শহরবাসীকে। অশান্তির পরে রাস্তায় নামেন স্থানীয় বাসিন্দারা। পুলিশ এবং বিক্ষোভকারীদের মধ্যস্থতা করেন তাঁরা। উত্তেজিত যুবকদের বুঝিয়ে শান্ত করে বাড়িতে ফেরত পাঠান। স্থানীয় মসজিদ থেকেও লাউডস্পিকারে শান্তি বজায় রাখার আবেদন জানানো হয়। থমথমে পরিস্থিতি ছিল জামিয়া সংলগ্ন বাটলা হাউস, আবু ফজ়ল, জ়াকির নগর ও গফ্ফর মঞ্জিলে। বন্ধ ছিল অধিকাংশ দোকানপাটই। একই পরিস্থিতি ছিল পুরনো দিল্লি ও তার সংলগ্ন দরিয়াগঞ্জ, লাল কুঁয়া, কুরেশ নগরের মতো এলাকাতে ও।
মুসলিম অধ্যুষিত পুরনো দিল্লিতে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ থেকে যাতে হিংসা ছড়িয়ে না-পড়ে, তার জন্য আবেদন জানিয়েছেন জামা মসজিদের শাহি ইমাম সৈয়দ আহমেদ বুখারি। তিনি বলেছেন ,সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের সঙ্গে ভারতের মুসলমানদের কোনও সম্পর্ক নেই। পাশাপাশি এনআরসি প্রসঙ্গেও তাঁর বক্তব্য, এটি এখনও আইনে পরিণত হয়নি। কয়েক দিন আগে রাজ্যসভায় নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল পাস হয়েছে। এরপর থেকেই ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে শুরু হয়েছে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ। সেই আন্দোলনের প্রসঙ্গে শাহি ইমাম বলেছেন, আন্দোলন ভারতের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। তবে তা নিয়ন্ত্রণে করা উচিত কারণ ,প্রতিবাদ ভারতের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। কেউ মুসলিমদের এটা করা থেকে আটকাতে পারবে না।যদিও এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, এটা নিয়ন্ত্রিত ভাবে হওয়া উচিত। নিজেদের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে,নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইনে আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে ভারতে ২০১৫ সালের আগে আসা অমুসলিম শরণার্থীদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বিলটি রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর থেকেই উত্তর-পূর্ব ভারতের অসম -ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। ক্রমে তা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতেও।
সিলামপুর -সাফরাবাদের ঘটনার পর উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে বড় জমায়েতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। জারি করা হয়েছে ১৪৪ ধারা। ওই ঘটনায় ৬ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।দায়ের করা হয়েছে তিনটি অভিযোগ। ব্রিজ পুরী এলাকায় পাথ ছোড়ার ঘটনায় আরও একটি অভিযোগ দায়ের করেছে পুলিশ। পুলিশের দাবি, অপরাধের পুরনো রেকর্ড থাকা লোকেরাই বিক্ষোভে শামিল হয়েছিল।বুধবার নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায় দায়ের করা ৬০ পিটিশনের প্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় সরকারকে নোটিশ পাঠিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে জবাব দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারকে। তবে এই আইনের উপর স্থগিতাদেশের আর্জি খারিজ করে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।মামবলার পরবর্তী শুনানি ২২ জানুয়ারি।যাঁরা পিটিশন দাখিল করেছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ, ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লিগ ও অসমে শাসক বিজেপির শরিক দল অসম গণ পরিষদ। প্রধান বিচারপতি এসএ বোবদের নেতৃত্বে তিন বিচারপতির বেঞ্চে মামলাগুলির শুনানি হয়েছে। বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন বিচারপতি বিআর গাভাই ও বিচারপতি সূর্য কান্ত। পিটিশনগুলিতে বলা হয়েছে, সংবিধান অনুযায়ী নাগরিকত্বে অনুমোদন পাওয়ার ভিত্তি কখনওই ধর্ম হতে পারে না।আবেদনকারীদের দাবি, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন, সংবিধানের মূল ভিত্তির বিরোধী কারণ এই নতুন আইনে বেআইনি শরণার্থীদেরও ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিক হিসেবে মেনে নেওয়া হচ্ছে। এতে লঙ্ঘন করা হচ্ছে সংবিধানের মৌলিক অধিকার।
রবিবার বাসে আগুন ও জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশি অভিযানের পর থেকেই দিল্লির পরিবেশ উত্তপ্ত। রোববার রাতে দিল্লির জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযান চালায় পুলিশ। বিনা অনুমতিতে গায়ের জোরে পুলিশ ক্যাম্পাসে ঢুকে শিক্ষার্থীদের ব্যাপক মারধর করেছে বলে অভিযোগ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রক্টর ওয়াসিম আহমেদ খান। এমনকি জোর করে ক্যাম্পাস থেকে শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মীদের বের করে দেওয়া হয়েছে বলেও তার দাবি। সেই সঙ্গে ছাত্রীদের শৌচাগারে ঢুকিয়ে মারধরেরও অভিযোগ রয়েছে।এদিকে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া ও আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশি হামলার প্রতিবাদে হার্ভার্ড, ইয়েল, কলাম্বিয়া, স্টানফোর্ডসহ দেশ-বিদেশের অন্তত ১৯টি বিশ্ববিদ্যালয় সংহতি জানিয়ে ক্যাম্পাসে পুলিশি হামলার নিন্দা জানিয়েছে। জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের চলা আন্দোলনে সংহতি ও হামলা তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা। এদিকে পুলিশ বলেছে, জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় সংঘর্ষের ঘটনায় ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে তারা কেউই শিক্ষার্থী নন।
সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন ইস্যুতে ভারতে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ পর্যন্ত আন্দোলন হয়েছে সেগুলো হলো, দিল্লির জহরলাল নেহেরু ও দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, হায়দারবাদের মওলানা আজাদ ন্যাশনাল উর্দু ইউনিভার্সিটি, মুম্বাইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেস,মাদ্রাজের আইআইটি ইনস্টিটিউট, চন্ডীগড়ের পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি ও ব্যাঙ্গালুরের আইআইএসসি। প্রতিবাদ হয়েছে কলকাতাতেও। যাদবপুর এবং প্রেসিডেন্সি বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রতিবাদে পথে নেমেছে। অন্যদিকে ,ভোটার কার্ড থাকা মানেই নাগরিকত্বের প্রমাণ নয় বলে দাবি করেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তাঁর মতে, একমাত্র নাগরিক পঞ্জিতে (এনআরসি) নাম থাকলে তবেই প্রমাণিত হবে, কোনও ব্যক্তি ভারতের নাগরিক এবং সেই কারণেই গোটা দেশে দ্রুত এনআরসি তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাঁর সরকার।স্বভাবতই, বিরোধীদের প্রশ্ন, এত দিন ধরে যাঁরা ভোটাধিকার প্রয়োগ করে এলেন, তাঁরা যদি নাগরিক না-হন, তা হলে কারা এ দেশের নাগরিক? কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায় স্পষ্ট,অসমের এনআরসি-র ধাঁচে গোটা দেশে নাগরিক পঞ্জি তৈরি করা হবে বলে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।আগামী ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের মধ্যে সেই কাজ সেরে ফেলা হবে বলে দিন কয়েক আগেই জানিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।
এর মধ্যেই তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী তথা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টানা ৩ দিন ধরে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। তিনি বলেছেন,দেশের প্রত্যেকেই, সবাই নাগরিক, সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের আদর্শ সামনে রেখে কাউকেই বাংলা ছাড়তে দেওয়া হবে না।সংবিধান মেনে সবকিছু করতে হয়, সেই সংবিধান মানছে না কেন্দ্রীয় সরকার। সংখ্যার জোরে আইন পাশ করানো যায় না, কাউকে বাংলা ছাড়তে দেবেন না বলে হুমকি দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর দু দিন আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে অভিযোগ করেছেন,নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রাজ্যে যে হিংসাত্মক বিক্ষোভ হচ্ছে, বিরোধীরা তাকে পরোক্ষে প্রশ্রয় দিচ্ছে।তাঁর মন্তব্য,যারা আগুন লাগাচ্ছে, টেলিভিশনে তাদের দেখা যাচ্ছে।পোশাক দেখেই তাদের চেনা যাচ্ছে। এরপর থেকেই প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য ,বিভাজন সৃষ্টিকারী বলে অভিযোগ করেছেন বিরোধী নেতারা। এই বিতর্কে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে তীব্র আক্রমণ করেছেন তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নাগরিকত্ব আইন বিরোধী মিছিল শুরুর আগে বক্তব্যে তৃণমূল নেত্রীবলেছেন, অসম-ত্রিপুরা সর্বত্র আন্দোলন হচ্ছে। পেঁয়াজের দাম ২০০ টাকায় পৌঁছেছে। আলু-পেঁয়াজ জ্বলছে। দেশ জ্বলছে। এরপরই, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নাম না করে তৃণমূল নেত্রীর তোপ, উনি পোশাক নিয়ে কথা বলছেন।পোশাক ঠিক করে না বিক্ষোভকারীদের পরিচয়।পোশাক দেখে মানুষ চেনা যায় না।
স্বভাবতই,এরপর তৃণমূল কংগ্রেস ও বিরোধীদের নতুন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।তাঁর দাবি, সব পাকিস্তানিকেই ভারতীয় নাগরিক করতে চায় বলে জানিয়ে দিক কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস ও বিরোধীরা। রাহুল-সোনিয়া গান্ধীর দল, কংগ্রেস মুসলিমদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে বলেও তোপ দেগেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কংগ্রেস ও তার শরিকদের প্রতি একটা খোলা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে চান। দম থাকলে তাঁরা খোলাখুলি ঘোষণা করুক যে, তারা প্রত্যেক পাকিস্তানি নাগরিককে ভারতীয় নাগরিকত্ব দিতে প্রস্তুত। তারপর দেশ তাদের জবাব দিয়ে দেবে। প্রধানমন্ত্রী মোদীর কটাক্ষ, দেশে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়ার রাজনীতিতে অভ্যস্ত কংগ্রেস। তাঁর কথায়, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন আনা হয়েছে আর কংগ্রেস আবারও মিথ্যে বলছে। দেশের কোনও নাগরিকের উপর কোনও প্রভাব ফেলবে না নাগরিকত্ব আইন।দেশের কোনও ধর্মের কোনও নাগরিকের উপর নাগরিকত্ব আইন প্রভাব ফেলবে না, এটা তিনি দেশবাসীকে আশ্বাস দিচ্ছেন। এই আইন নিয়ে কোনও ভারতীয়ের চিন্তার কিছু নেই। এই আইন শুধু তাঁদের জন্য,যাঁদের ভারত ছাড়া যাওয়ার কোনও জায়গা নেই, অথচ তাঁরা বছরের পর বছর ধরে মামলার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন।