মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ খুনি এখনো পালিয়ে আছেন। এঁদের মধ্যে এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী কানাডায় ও এ এম রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। অন্য তিনজন খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম ও মোসলেম উদ্দিনের অবস্থান সম্পর্কে সরকারের কাছে নিশ্চিত কোনো তথ্য নেই। এ ছাড়া ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আরেক আসামি আজিজ পাশা ২০০২ সালে পলাতক অবস্থায় জিম্বাবুয়েতে মারা যান।
মাজেদকে গত ৭ এপ্রিল ভোরে গ্রেপ্তার করার পর আদালতে তোলা হলে বিচারক তাকে কারাগারে পাঠান। এর পরপরই তার দণ্ড কার্যকরের আনুষ্ঠানিকতাগুলো শুরু করে সরকার।
আদালত পরদিন তার মৃত্যু পরোয়ানা জারি করলে কারা কর্তৃপক্ষ তাকে তা পড়ে শোনায়। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সময় বহু বছর আগেই পেরিয়ে যাওয়ায় আবদুল মাজেদের সামনে সেই সুযোগ ছিল না।
ফাঁসির দড়ি এড়ানোর শেষ চেষ্টা হিসেবে বুধবার সন্ধ্যায় তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষার আবেদন করেন। সেদিন রাতেই রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ তা নাকচ করে দিলে মাজেদের দণ্ড কার্যকরের বিষয়টি কেবল সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
শুক্রবার বিকালে কেরানীগঞ্জ কারাগারে গিয়ে মাজেদের সঙ্গে শেষ দেখা করেন আসেন তাঁর স্ত্রী সালেহা বেগম। ফাঁসি কার্যকরের প্রস্তুতি নেওয়ার পর লাশ নেওয়ার জন্য শনিবার রাতে আবার তাঁদের কারাগারে ডাকা হয়।
কারা-কর্তৃপক্ষ সন্ধ্যার পর থেকেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আনুষ্ঠানিকতাগুলো এগিয়ে নিতে থাকে। কারাগারের ফাঁসির মঞ্চও প্রস্তুত করা হয়, নিয়ম অনুযায়ী তওবা পড়ানো হয় ফাঁসির আসামিকে।
অতিরক্ত আইজি প্রিজন্স, ডিআইজি প্রিজন্স, সিনিয়র জেল সুপার, ঢাকার সিভিল সার্জন, কারাগারের দুজন সহকারী সার্জন, ঢাকা জেলার পুলিশ সুপারের প্রতিনিধি, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ওসি রাত ১১টার মধ্যে কারাগারে প্রবেশ করেন। মৃতদেহ রাখার জন্য আগেই কফিন এনে রাখা হয়।সব আনুষ্ঠানিকতা সেরে রাত ১২টা ১ মিনিটে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো হয় বঙ্গন্ধুর খুনি মাজেদকে।
২০১৬ সালের ১০ এপ্রিল উদ্বোধন হওয়া এ কারাগারে এটাই ছিল কোনো আসামির ফাঁসি কার্যকরের প্রথম ঘটনা।
কে এই আবদুল মাজেদ?
আবদুল মাজেদের বাবার নাম আলী মিয়া চৌধুরী, মায়ের নাম মেহেরজান বেগম, বাড়ি ভোলার বোরহানউদ্দিনের কালীগঞ্জের বাটমারায়।
মাজেদের স্ত্রী সালেহা বেগম, চার মেয়ে ও এক ছেলে ঢাকা সেনানিবাসের এক নম্বর রোডের একটি বাসায় বসবাস করছেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর রোডে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন মাজেদ। তখন তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপুর পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর মাজেদ কর্নেল (অব.) সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খানসহ আরো কয়েকজনের সঙ্গে রেডিও স্টেশন নিয়ন্ত্রণে রাখার দায়িত্বে ছিলেন। অন্য খুনিদের সঙ্গে দেশত্যাগের আগ পর্যন্ত বঙ্গভবনে ‘বিভিন্ন দায়িত্ব’ ছিল তার।
পরে হত্যাকাণ্ডে জড়িত অন্য সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে ব্যাংকক হয়ে লিবিয়ায় চলে যান মাজেদ। তখনকার সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের নির্দেশেই তারা সে সময় নিরাপদে দেশ ছেড়ে যান বলে উল্লেখ করা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে।
মাজেদরা লিবিয়ায় ছিলেন তিন মাস। এরপর ‘পুরস্কার হিসেবে’ তাদের বিভিন্ন দূতাবাসে দায়িত্ব দেওয়া হয়। মাজেদকে পাঠানো হয় সেনেগাল দূতাবাসে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৮০ সালের ২৬ মার্চ আবদুল মাজেদকে বিআইডব্লিউটিসিতে চাকরি দেওয়া হয়। সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসর নিয়ে উপসচিবের মর্যাদায় তিনি বিআইডব্লিউটিসিতে যোগ দেন।
পরে তাকে তখনকার যুব উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের ‘ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট’ শাখার পরিচালক করা হয়। এরপর দেওয়া হয় তখনকার জাতীয় সঞ্চয় পরিদপ্তরের পরিচালকের দায়িত্ব।
ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর হেমায়েত উদ্দিন খান হিরণের বরাত দিয়ে বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত দুই দশকের বেশি সময় ভারতে আত্মগোপনে ছিলেন মাজেদ। সেখানে তিনি থাকতেন কলকাতায়। মার্চের মাঝামাঝি সময়ে তিনি দেশে ফেরেন।
তবে কীভাবে তিনি দেশে ফিরলেন এবং এরপর গত প্রায় তিন সপ্তাহ কোথায় ছিলেন- তা এখনও স্পষ্ট নয়।